নাজাত প্রাপ্ত দলের আকীদাহ প্রশ্ন এবং তাঁর উত্তরসমুহ হাফেয বিন আহমাদ আল-হাকামী (রহঃ)
প্রশ্নঃ (১৮৫) طيرة পাখি উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করা বা কোন জিনিষকে শুভ-অশুভ লক্ষণ মনে করার হুকুম কী? এ সব কুসংস্কার দূর করার পদ্ধতি কী?

উত্তরঃ طيرة (তিয়ারা) পাখি উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করা বা কোন জিনিষকে শুভ-অশুভ লক্ষণ কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ্ তাআ’লা বলেনঃ

فَإِذَا جَاءَتْهُمْ الْحَسَنَةُ قَالُوا لَنَا هَذِهِ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوا بِمُوسَى وَمَنْ مَعَهُ أَلَا إِنَّمَا طَائِرُهُمْ عِنْدَ اللَّهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُون

‘‘যখন তাদের সুখ শান্তি ও কল্যাণ হত, তখন তারা বলতঃ এটা তো আমাদের জন্যে, আর যদি তাদের কষ্ট ও বিপদাপদ হত, তখন তারা ওটাকে মুসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মন্দ ভাগ্যের কারণ রূপে নিরূপন করত। তোমরা জেনে রেখো যে, তাদের অকল্যাণ আল্লাহরই নিয়ন্ত্রনাধীন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখে না’’। (সূরা আরাফঃ ১৩১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

(لاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ)

‘‘একজনের রোগ অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হয়না। ‘তিয়ারা’ এর মাধ্যমে অর্থাৎ পাখী উড়িয়ে বা পাখীর ডাক শুনে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণের নিয়ম ইসলামে নেই। ‘হামা’ বা হুতুম পেঁচার ডাকও কোন অকল্যাণ বয়ে আনে না। সফর মাসকে অশুভ মনে করাও ঠিক নয়’’।[1]

‘তিয়ারা’ হচ্ছে, প্রাচীনকালে আরবদের মধ্যে এ অভ্যাস প্রচলিত ছিল যে, তাদের কেউ কোন কাজ শুরু করার সময় বা কোথাও যাত্রা করার সময় পাখি উড়াতো। পাখি যদি ডান দিকে উড়ে যেত, তবে যাত্রা শুভ মনে করে যাত্রা বা কাজ চালিয়ে যেত। আর যদি দেখত পাখি বাম দিকে উড়ে যাচ্ছে তবে কুলক্ষণ মনে করে যাত্রা বিরত রাখত বা কাজে অগ্রসর হতনা। মোটকথা হচ্ছে, যে কোন জিনিষ দেখা, কোন কথা শুনা বা জানার মাধ্যমে কুলক্ষণ মনে করাকে ‘তিয়ারা’ বলা হয়। ইসলামে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করা সম্পূর্ণ হারাম।

‘হামাহ’এর ব্যাখ্যা দু’ধরণের হতে পারে। (ক) এমন রোগ, যা একজনকে আক্রমণ করে অন্যজনের নিকট সংক্রমিত হয়। (খ) ‘হামাহ’ বলা হয়, আরবদের ধারণা মতে এমন এক শ্রেণীর পাখিকে, যে গভীর রাতে নিহত ব্যক্তির বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার পরিবারের লোকদেরকে ডাকাডাকি করে এবং প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উৎসাহ দেয়। কেউ কেউ ধারণা করে যে, এটি নিহত ব্যক্তির রূহ পাখির আকৃতি ধরে উপস্থিত হয়েছে। এই পাখিটিকে আমাদের পরিভাষায় হুতুম পেঁচা বলা হয়। তৎকালিন আরবরা এ পাখির ডাককে কুলক্ষণ মনে করত। কারো ঘরের পাশে এসে এ পাখি ডাকলে তারা বিশ্বাস করত যে, সে মৃত্যু বরণ করবে।

‘সাফার’ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। (১) আরবী সফর মাস। আরবরা এ মাসকে অকল্যাণের মাস মনে করত। (২) এটি উটের এক ধরণের রোগের নাম, যা এক উটের শরীর থেকে অন্য উটের শরীরে সংক্রমিত হয়। (৩) সফর মাসকে আরবরা কখনো হারাম মাসের সাথে গণনা করত। আবার কখনো হালাল মাস হিসাবে গণ্য করত। এটি আরবদের গোমরাহী মূলক একটি আচরণ।

তবে উল্লেখিত ব্যাখ্যাগুলোর মধ্যে গ্রহণযোগ্য কথা হল, জাহেলী সমাজের লোকেরা সফর মাসকে অমঙ্গলের মাস মনে করত। মূলতঃ কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণে সময় বা মাসের কোন প্রভাব নেই। ছফর মাস অন্যান্য মাসের মতই। তাতে কল্যাণ-অকল্যাণ আল্লাহর নির্ধারণ অনুযায়ীই হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও কিছু মূর্খ লোক কোন কোন বাংলা সনের কোন মাসকে কুলক্ষণের মাস মনে করে থাকে।

উপরে বর্ণিত ভ্রান্ত বিশ্বাস খন্ডন করতে গিয়ে কোন কোন মানুষ যখন ছফর মাসে কোন কাজ সমাধা করে, তখন সেই তারিখ লিখে রাখে এবং বলে কল্যাণের মাস ছফর মাসের অমুক তারিখে কাজটি সমাধা হল। এটি এক বিদ্আত দ্বারা অন্য বিদ্আতের এবং এক অজ্ঞতা দ্বারা অন্য অজ্ঞতার চিকিৎসা করার শামিল। এটি কল্যাণের মাসও নয় এবং অকল্যাণের মাসও নয়। এই জন্যই কোন কোন বিদ্বান পেঁচার ডাক শুনে (خيرا ان شاء الله) ‘‘আল্লাহ চাহেতো ভাল হবে’’ এ কথা বলার প্রতিবাদ করেছেন। ভাল বা খারাপ কোন কিছুই বলা যাবে না। সে অন্যান্য পাখির মতই ডাকে।

উপরের চারটি বিষয়ের প্রভাবকে হাদীছে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় আল্লাহর উপর ভরসা করা সকল মু’মিনের উপর আবশ্যক। এতে ঈমান মজবুত হবে। এ সমস্ত কুসংস্কারের সামনে মুমিন ব্যক্তি কখনো দুর্বল হবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য একটি সহীহ হাদীছে বলেনঃ

(الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ)

‘‘পাখী উড়িয়ে বা পাখীর ডাক শুনে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণ করা শির্ক’’।[2] আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বদ নযর দূর করার মাধ্যম বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ ‘‘আল্লাহর উপর ভরসা করার মাধ্যমেই আল্লাহ্ তাআলা অমঙ্গল দূর করেন’’। অন্য এক সহীহ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

(إِنَّمَا الطِّيَرَةُ مَا أَمْضَاكَ أَوْ رَدَّكَ)

‘‘তোমাকে যে জিনিষ গন্তব্য স্থানের দিকে নিয়ে যায় অথবা গন্তব্য স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হতে বিরত রাখে, তাই হচ্ছে তিয়ারা’’।[3] আহমাদ বিন হাম্বাল স্বীয় মুসনাদে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর হতে বর্ণনা করেন যে,

(مَنْ رَدَّتْهُ الطِّيَرَةُ مِنْ حَاجَةٍ فَقَدْ أَشْرَكَ)

‘‘যে ব্যক্তিকে কুলক্ষণের ধারণা স্বীয় প্রয়োজন হতে ফিরিয়েছে সে শির্ক করেছে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেনঃ উহার কাফ্ফারাহ্ কি? তিনি বললেন তা হল এই দু’আটি বলাঃ

(اللهم لاخَيْرَ إلاَّ خَيْرُكَ ، ولاطِيْرَ إلاَّ طِيَرُكَ ، ولا اله غَيْرُكَ)

‘‘হে আল্লাহ্! তোমার কল্যাণ ব্যতীত আর কোন কল্যান নেই। তোমার পক্ষ থেকেই অকল্যান হয়ে থাকে অন্য কারো পক্ষ থেকে নয়। অর্থাৎ অকল্যাণ সাধনের আপনিই একমাত্র মালিক। আপনার ইচ্ছার বাইরে কেউ অকল্যাণ আনয়ন করতে পারে না। আর আপনি ব্যতীত আর কোন সত্য উপাস্য নেই’’।[4] উরওয়া বিন আমের (রাঃ) হতে বর্নিত তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নিকটে শুভ-অশুভের কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বলেনঃ

(أَحْسَنُهَا الْفَأْلُ وَلاَ تَرُدُّ مُسْلِمًا فَإِذَا رَأَى أَحَدُكُمْ مَا يَكْرَهُ فَلْيَقُلِ اللَّهُمَّ لاَ يَأْتِي بِالْحَسَنَاتِ إلاَّ أَنْتَ وَلاَ يَدْفَعُ السَّيِّئَاتِ إِلاَّ أَنْتَ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِكَ)

‘‘এগুলোর মধ্যে উত্তম বিষয় হল ফাল গ্রহণ অর্থাৎ কোন কাজ শুরু করার সময় ভাল ধারণা পোষণ করা। মূলতঃ ইহা কোন মুসলিমকে তার কর্ম সম্পাদন করা হতে বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হতে ফিরিয়ে দেয় না। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অপছন্দ বস্ত্ত দর্শন করে তাহলে সে যেন বলেঃ

(اللهم لاَيأْتِيْ باِلحَسَناَتِ إلاَّ أنتَ ، ولاَيَدْفَعُ السَّيِّئاَتِ إلاَّ أنتَ ، ولاحول ولا قوة إلا بِكَ)

হে আল্লাহ্! আপনি ছাড়া কল্যান আনয়ন কারী কেউ নেই এবং মন্দকে প্রতিহত কারী আপনি ব্যতীত কেউ নেই। আর গুনাহ্ হতে বিরত থাকা এবং আনুগত্যের উপর অটল থাকার সামর্থ আপনার মাধ্যমেই হয়ে থাকে।[5]

[1] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত্ তিবব, মুসলিমঃ কিতাবুস্ সালাম।


[2] - মুসনাদে আহমাদ, (১/৪৪০), হাকেম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান, তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুস্ সাইর। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ হাদীছটি হাসান সহীহ। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ৪২৯।

[3] - মুসনাদে আহমাদ, (১/২৩৯)। আহমাদ শাকের হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন, দেখুনঃ (৩/২৩৯) হাদীছ নং- ১৮২৪)

[4] - মুসনাদে আহমাদ, (২/২২০)। আহমাদ শাকের হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ (১২/১০) হাদীছ নং- ৭০৪৫। ইমাম আলবানী (রঃ)ও হাদীছটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১০৬৫।

[5] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুত তিবব। হাদীছটি যঈফ। দেখুনঃ ইমাম আলবানী কর্তৃক রচিত ‘আল-কালিমুত তায়্যিব, হাদীছ নং-২৫৩।