লগইন করুন
খৃস্টীয় প্রচারকগণ বলেন, কুরআন যেমন লাখলাখ মানুষ পড়ে, বিকৃত করা যায় না, তেমনি তাওরাত-ইঞ্জিলও বিকৃত করা সম্ভব ছিল না। কথাগুলি একেবারে ভিত্তিহীন। কারণ সর্বশেষ ওহী হিসেবে আল্লাহ কুরআনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যা পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলির ক্ষেত্রে করেন নি। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(ক) কুরআন মূলতই লিখিত বই নয় বরং অগণিত মানুষের মুখস্থ বই। অবতরণের শুরু থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণ তা মুখস্থ করেছেন। প্রতি সপ্তাহে, মাসে ও বৎসরে তাহাজ্জুদে, তারাবীহে ও তিলাওয়াতে অগণিতবার খতম করেছেন। সকল যুগেই একই অবস্থা। কুরআনের লিখিতরূপ শুধু সহায়ক মাত্র। পক্ষান্তরে তাওরাত-ইঞ্জিল কখনোই মুখস্থ করা হয়নি এবং মুখস্থ করা সম্ভবও নয়।
(খ) কুরআন প্রথম অবতরণ থেকেই প্রতিটি মুমিনের প্রতিদিনের পাঠ্য বই। প্রতিদিন নিজের নামাযে, জামাতে নামাযে ও সাধারণভাবে প্রত্যেক মুমিন তা তিলাওয়াত করেন বা শুনেন। পক্ষান্তরে তাওরাত-ইঞ্জিল কখনোই সাধারণ মানুষের পাঠ্য বই ছিল না। বরং কতিপয় “ধর্মগুরু” বা “পুরোহিত” বছরে দু-একটি অনুষ্ঠানে বা প্রয়োজনে তা পড়তেন। সাধারণ মানুষের জন্য বাইবেল পাঠ নিষিদ্ধ ছিল। কয়েকশত বৎসর আগেও “বাইবেল” পাঠ করলে আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো।
(গ) মূসা (আঃ) তাওরাতের একটি মাত্র কপি ‘নিয়ম সিন্দুকের” মধ্যে রেখে গিয়েছেন, প্রতি সাত বৎসর পরপর তা পড়ার জন্য। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর শতবৎসরের মধ্যেই ইয়াহূদীরা তাঁর ধর্ম ত্যাগ করে শির্ক কুফরে লিপ্ত হয়। এভাবে তাওরাতের পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। শতশত বৎসর পরে লোকমুখের প্রচলনে তা লেখা হয়।
(ঘ) যীশুর শিষ্যগণ তাঁর ইঞ্জিল লিখেন নি। কারণ তিনি তাঁদেরকে বলেছিলেন যে, তাঁরা জীবিত থাকতেই কিয়ামত হবে (১৬/২৭-২৮)। শিষ্যগণ এ কথাই বিশ্বাস ও প্রচার করতেন যে, তাঁরা জীবিত থাকতেই কিয়ামত হবে (১ থিষলনীকীয় ৪/১৫-১৭; ১ করিন্থীয় ১৫/৫১-৫২) এজন্য আল্লাহর কালাম লিখতে নিষেধ করা হয়েছে: “আর তিনি আমাকে কহিলেন, তুমি এ গ্রন্থের ভাববাণীর বচন সকল মুদ্রাঙ্কিত করিও না (লিখিও না); কেননা সময় সন্নিকট।” (প্রকাশিত বাক্য ২২/১০-১১)
(ঙ) খৃস্টান গবেষকগণ একমত যে, যীশুর তিরোধানের পরে দুইশত বৎসরের মধ্যে প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির কোনো নামও কোথাও পাওয়া যায় না। এ সময়ে খৃস্টানগণ অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে বিভিন্ন দেশে খৃস্টধর্ম প্রচার করেছেন, কিন্তু কেউই যীশুর ইঞ্জিলের কোনো লিখিত রূপ সংরক্ষণ করেন নি। প্রথম শতাব্দীর মধ্যেই এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে খৃস্টান চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিশপ নিযুক্ত হয়েছে। এ সকল বিশপের অনেক চিঠি ও বই এখনো সংরক্ষিত আছে। কিন্তু সেগুলোতে প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির কোনো নামও উল্লেখ নেই। ২০০ বৎসর পর্যন্ত কোনো চার্চে কোনো ইঞ্জিল শরীফ সংরক্ষিত রাখা বা পঠিত হওয়া তো দূরের কথা এগুলির কোনো উল্লেখই পাওয়া যায় না। অর্থাৎ মথি, মার্ক, লূক ও যোহনের লেখা ইঞ্জিল নামে কোনো পুস্তক যে পৃথিবীতে বিদ্যমান এ কথাটিই ২০০ বছর পর্যন্ত কেউ জানত না। এটি কোনো বিতর্কিত তথ্য নয়, বরং সকল খৃস্টান কর্তৃক স্বীকৃত সত্য।
(চ) এরপর সমাজে অগণিত ইঞ্জিল প্রকাশ পেতে থাকে। যাজকগণ এ সকল ইঞ্জিলের মধ্য থেকে তাঁদের পছন্দসই ইঞ্জিলগুলোকে ‘সঠিক’ (canonical) এবং বাকি ইঞ্জিলগুলোকে “সন্দেহজনক” (non-canonical/ Apocryphal) বলে দাবী করেন। কোনটি সঠিক এবং কোনটি সন্দেহজনক তা নিয়েও তাদের মতভেদের অন্ত নেই। আবার “সঠিক” ইঞ্জিলগুলির পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যেও অগণিত বৈপরীত্য বিদ্যমান।
(ছ) খৃস্টান প্রচারকগণ বলতে চান যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের ৩০ বৎসর পরে উসমান (রা) কুরআন সংকলন করেন। ত্রিশ বৎসরে বিকৃতির সম্ভাবনা ছিল! যাদের ধর্মগ্রন্থ ৩০০ বৎসর পরে সংকলিত তারা ত্রিশ বৎসর নিয়ে চিন্তা করেন! তাদের এ কথা পুরোটাই মিথ্যা। আমরা আগেই বলেছি, কুরআন মূলত মুখস্থ বই। প্রায় সকল মুসলিম তা মুখস্থ রাখতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়েই সাহাবীগণ তা লিখেও রাখতেন। ১১ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পরের বৎসর ১২ হিজরীতে আবূ বকর (রা) কুরআনের লিখিত পাণ্ডুলিপি সংকলন করে রাখেন। যখন ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিসর বিভিন্ন দেশের অগণিত মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন তখন নতুন মুসলিমদের জন্য লিখিত কুরআনের প্রয়োজন হতো। অনেকে নিজের ইচ্ছামত কারো মুখে শুনে কুরআন লিখতে শুরু করেন। এতে ভুল পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এজন্য ২৩ হিজরী সালে, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের ১২ বৎসরের মাথায় উসমান (রা) খলীফা হওয়ার পরে আবূ বকর (রা)-এর পাণ্ডুলিপিটিকে কয়েকটি কপি করে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র প্রেরণ করেন।
(জ) খৃস্টানগণ বলেন, উসমানের (রা) সময়ে কুরআনের এক কপি রেখে অন্যান্য কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়; কাজেই কুরআনের বিকৃতির সম্ভাবনা আছে। আপনি বলুন, বর্তমানে যদি কুরআনের সবকপি পুড়িয়ে ফেলা হয় তাহলে কি কুরআন বিকৃত হবে? না হাফিযগণ অবিকৃতভাবেই তা তিলাওয়াত করবেন? বর্তমান সময়ের চেয়ে সাহাবীদের যুগে কুরআন মুখস্থ করার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। হাজার হাজার হাফিয সাহাবী-তাবিয়ী মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে ছিলেন। আরবী লিখনপদ্ধতির ভুলে যেন লিখিত কুরআনের মধ্যে কোনো ভুল ঢুকে না পড়ে এজন্য উসমান (রা) আবূ বকর (রা)-এর সংকলিত পাণ্ডুলিপিটির কয়েকটি কপি সর্বত্র প্রেরণ করেন এবং নির্দেশ দেন যে, এ পাণ্ডুলিপির সাথে যে সকল লিখিত কুরআনের মিল হবে না, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে, যেন অ-হাফিয সাধারণ মুসলিম ভুল পড়া থেকে রক্ষা পান।