কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা সপ্তম অধ্যায় - মানুষ তথা সৃষ্টির সাথে আদব ইসলামহাউজ.কম
(ঝ) জীবজন্তুর সাথে আচরণ:

মুসলিম ব্যক্তি অধিকাংশ প্রাণীকেই সম্মানিত সৃষ্টি বলে বিবেচনা করে; সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তার প্রতি করুণা করার কারণে সেও তার প্রতি দয়া বা করুণা করবে এবং তার প্রতি নিম্নোক্ত আদবসমূহ রক্ষা করে চলবে:

১. যখন তার ক্ষুধা ও পিপাসা হয়, তখন খাবার ও পানীয়’র ব্যবস্থা করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

فِي كُلِّ ذَاتِ كَبِدٍ حَرَّاءَ أَجْرٌ

“প্রাণী মাত্রকেই পানি পান করানোর মধ্যে সাওয়াব রয়েছে।”[1] তিনি আরও বলেন:

« مَنْ لا يَرْحم لا يُرْحَمْ » . (رواه الطبراني و البخاري بلفط آخر).

“যে ব্যক্তি অনুকম্পা প্রদর্শন করবে না, তার প্রতিও অনুকম্পা প্রদর্শন করা হবে না।”[2] নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

« ارْحَمُوا مَنْ فِي الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ » . (رواه الترمذي ).

“তোমরা পৃথিবীতে যারা আছে, তাদের প্রতি দয়া কর, তাহলে আকাশে যিনি আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।”[3]

২. তার প্রতি দয়াপরবশ ও সহানুভূতিশীল হওয়া; কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদেরকে দেখলেন— তারা একটি জীবন্ত পাখিকে ধরে এনে তাদের তীর নিক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গ্রহণ করে তার প্রতি তীর নিক্ষেপ করছে, তখন তিনি বললেন:

« لعن الله من اتخذ شيئًا فيه روح غرضًا » . (رواه البخارى ومسلم).

“আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তির উপর অভিশাপ বর্ষণ করুন, যে জীবন্ত প্রাণীকে (তীর নিক্ষেপের) লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।”[4] তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম চতুষ্পদ জন্তুকে হত্যা করার জন্য আটক করে রাখতে নিষেধ করেছেন। আবার কোনো একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতে পেলেন একটি মা পাখি তার বাচ্চাদের খোঁজে বৃত্তাকারে উড়ছে, যে বাচ্চাগুলো সাহাবীগণ তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে এসেছে, এমতাবস্থায় তিনি বললেন:

« مَنْ فَجَعَ هَذِهِ بِوَلَدِهَا ؟ رُدُّوا وَلَدَهَا إِلَيْهَا » . (رواه أبو داود ).

“কে এ পাখিটিকে তার সন্তান হারোনোর ব্যদনায় কষ্ট দিচ্ছে? তোমরা তার বাচ্চাকে তার নিকট ফিরিয়ে দাও।”[5]

৩. তাকে যবেহ বা হত্যা করার সময় দয়া প্রদর্শন করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« إنَّ الله كَتَبَ الإحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ فَإذَا قَتَلْتُم فَأحْسِنُوا القِتْلَة ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأحْسِنُوا الذِّبْحَةَ ، وَليُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَه ، وَلْيُرِح ذَبِيحَتَهُ » . (رواه مسلم ).

“আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ‘ইহসান’ অত্যাবশ্যক করেছেন; সুতরাং তোমরা যখন কতল করবে, দয়ার্দ্রতার সাথে কতল করবে; আর যখন যবেহ করবে, তখন দয়ার্দ্রতার সাথে যবেহ করবে; আর তোমাদের সকলেই যেন তার ছুরি ধার দিয়ে নেয় এবং তার যবেহকৃত প্রাণীকে কষ্ট না দেয়।”[6]

৪. তাকে কোনো প্রকার শাস্তি না দেওয়া, চাই সে শাস্তি অভুক্ত রাখার মাধ্যমে হউক, অথবা প্রহার করার মাধ্যমে হউক, অথবা সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপানোর মাধ্যমে হউক, অথবা তার অঙ্গহানির মাধ্যমে হউক, অথবা আগুনে পোড়ানোর মাধ্যমে; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« عُذِّبَتِ امْرَأَةٌ في هِرَّةٍ سَجَنَتْها حَتَّى مَاتَتْ ، فَدَخَلَتْ فِيهَا النَّارَ ، لاَ هِيَ أَطْعَمَتْهَا وَسَقَتْهَا ، إذْ حَبَسَتْهَا ، وَلاَ هِيَ تَرَكَتْهَا تَأكُلُ مِنْ خَشَاشِ الأَرْضِ » . (رواه البخاري ).

“এক মহিলাকে একটি বিড়ালের কারণে শাস্তি দেয়া হয়েছে— সে বিড়ালটিকে একাধারে বেঁধে রাখায় মারা গিয়েছিল, যার কারণে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। যখন সে তাকে আটকিয়ে রেখেছিল, তখন সে তাকে না খাদ্য ও পানীয় দিয়েছে, না তাকে যমীনের পোকা মাকড় খাওয়ার জন্য ছেড়ে দিয়েছে।”[7] তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো এক পিঁপড়া অধ্যুষিত অঞ্চল দিয়ে পথ চলার সময় দেখতে পেলেন তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, তখন তিনি বলেন:

« مَنْ حَرَّقَ هَذِهِ ؟ ». قُلْنَا : نَحْنُ . قَالَ « إِنَّهُ لاَ يَنْبَغِى أَنْ يُعَذِّبَ بِالنَّارِ إِلاَّ رَبُّ النَّارِ» . (رواه أبو داود ).

“কে এগুলোকে পুড়িয়ে মারছে? আমরা বললাম: আমরা মারছি; তিনি বললেন: আগুনের মালিক (আল্লাহ তা‘আলা) ব্যতীত কারও জন্য আগুন দ্বারা শাস্তি দেয়া সমীচীন নয়।”[8]

৫. ক্ষতিকর প্রাণীকে হত্যা করা বৈধ, যেমন— হিংস্র বা পাগলা কুকুর, বাঘ, সাপ, বিচ্ছু, ইঁদুর ইত্যাদি; কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« خَمْسٌ فَوَاسِقُ يُقْتَلْنَ فِى الْحِلِّ وَالْحَرَمِ : الْحَيَّةُ ، وَالْغُرَابُ الأَبْقَعُ ، وَالْفَارَةُ ، وَالْكَلْبُ الْعَقُورُ ، وَالْحُدَيَّا » . (رواه البخاري و مسلم ).

“পাঁচ প্রকার প্রাণী বেশি অনিষ্টকারী, এদেরকে হারাম শরীফের বাইরে ও ভিতরে হত্যা করা যায়: সাপ, চিত্রা কাক, ইঁদুর, পাগলা কুকুর ও চিল।”[9] অনুরূপভাবে বিচ্ছুকে হত্যা ও লা‘নত করার বিষয়টিও নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়েছে।

৬. জনস্বার্থে বা প্রশাসনিক প্রয়োজনে উট, ছাগল ও গরুর মত চতুষ্পদ জন্তুর কানে দাগ বা চিহ্ন দেওয়া বৈধ; কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর নিজ হাতে যাকাতের উটে চিহ্ন দিতে দেখা গেছে। তবে উট, ছাগল ও গরুর মত চতুষ্পদ জন্তু ব্যতীত অন্যান্য জীবজন্তুর গায়ে দাগ বা চিহ্ন দেওয়া বৈধ নয়; কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম চেহারায় দাগ দেওয়া একটি গাধাকে দেখে বললেন:

« لَعَنَ اللَّهُ الَّذِى وَسَمَ هَذَا فِى وَجْهِهِ » . (رواه مسلم ).

“আল্লাহর অভিশাপ ঐ ব্যক্তির প্রতি, যে এ প্রাণীটির চেহারায় দাগ দিয়েছে।”[10]

৭. এসব জন্তুতে আল্লাহর ‘হক’ সম্পর্কে জানা, যাতে যখন তা যাকাতযোগ্য হয়, তখন তার যাকাত আদায় করা যায়।

৮. আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য বাদ দিয়ে এগুলো নিয়ে ব্যস্ত না থাকা, অথবা এগুলোর কারণে তাঁর স্মরণে উদাসীন না হওয়া; কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُلۡهِكُمۡ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُكُمۡ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِۚ

“হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে।”[11] তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোড়া প্রসঙ্গে বলেছেন:

« الْخَيْلُ ثلاثةٌ : لِرَجُلٍ أَجْرٌ ، وَلِرَجُلٍ سِتْرٌ ، وَعلَى رَجُلٍ وِزْرٌ ، فأمَّا الَّذِي هِيَ لَهُ أَجْرٌ ، فَرَجُلٌ رَبَطَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ ، فَأَطَالَ لَهَا فِي مَرْجٍ أوْ رَوْضَةٍ ، فَمَا أَصَابَتْ فِي طِيَلِهَا ذَلِكَ مِنَ الْمَرْجِ وَالرَّوْضَةِ ، كَانَتْ لَهُ حَسَنَاتٌ ، فَلَوْ أَنَّهَا قَطَعَتْ طِيَلَهَا ذَلِكَ ، فَاسْتَنَّتْ شَرَفًا أو شَرَفَيْنِ ، كَانَتْ آثارُهَا وَأَرْوَاثُها حَسَنَاتٍ لَهُ ، وَلَوْ أَنَّهَا مَرَّتْ بِنَهْرٍ ، فَشَرِبَتْ مْنهُ ، وَلَمْ يُرِدْ أَنْ يَسْقِيَ بِهِ كَانَ ذَلِكَ لَهُ حَسَنَاتٍ ، فَهِيَ لِذلِكَ أَجْرٌ . وَرَجُلٌ رَبَطَهَا تَغَنِّيًا وَتَعَفُّفًا ، وَلَمْ يَنْسَ حَقَّ اللَّهِ فِي رِقَابِهَا وَلا ظُهُورِهَا ، فَهِيَ لِذَلِكَ سِتْرٌ . وَرَجُلٌ رَبَطَهَا فَخْرًا وَرِيَاءً وَنِوَاءً لِأَهْلِ الإِسْلامِ ، فَهِيَ عَلَى ذَلِكَ وِزْرٌ » . (رواه البخاري ).

“ঘোড়া তিন প্রকার: (ঘোড়া পালন) একজনের জন্য পুণ্য, আরেক জনের জন্য (দারিদ্র্য ঢেকে রাখার বা আযাব থেকে) আবরণ স্বরূপ এবং অপর আরেক জনের জন্য পাপের কারণ। সে ব্যক্তির জন্য পুণ্য, যে আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদ করার জন্য) ঘোড়াকে সদা প্রস্তুত রাখে এবং সে ব্যক্তি যখন লম্বা দড়ি দিয়ে ঘোড়াটি কোনো চারণভূমি বা বাগানে বেঁধে রাখে, তখন ঐ লম্বা দড়ির মধ্যে চারণভূমি বা বাগানের যে অংশ পড়বে তত পরিমাণ সাওয়াব সে পাবে; যদি ঘোড়াটি দড়ি ছিড়ে ফেলে এবং দুই একটি টিলা পার হয়ে কোথাও চলে যায়, তাহলে তার পদচিহ্ন ও গোবরগুলোও তার জন্য সাওয়াব হিসেবে গণ্য হবে; যদি কোনো নদী-নালায় গিয়ে পানি পান করে, মালিক যদিও পানি পান করানোর ইচ্ছা করে নাই, তাও তার নেক আমল বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি নিজের স্বচ্ছলতার জন্য দারিদ্র্যের গ্লানি ও পরমুখাপেক্ষীতা থেকে নিজকে রক্ষা করার জন্য ঘোড়া পালন করে এবং তার গর্দান ও পিঠে আল্লাহর যে হক রয়েছে তা ভুলে না যায় (অর্থাৎ যাকাত আদায় করে) তবে এই ঘোড়া তার জন্য আযাব থেকে রক্ষাকারী আবরণ স্বরূপ। আর যে ব্যক্তি অহঙ্কার, লোক দেখানো ও ইসলামের অনুসারীদের সাথে শত্রুতার জন্য ঘোড়া লালন-পালন করে, তাহলে এ ঘোড়া তার জন্য পাপের বোঝা হবে।”[12]

সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের কারণেই জীবজন্তুর সাথে এ আদবসমূহ রক্ষা করে চলবে; আর এসব আদব পালন করার দ্বারা নির্দেশ পালন হবে ইসলামী শরী‘য়তের ! পালন হবে দয়া ও করুনার বিধিবিধান ! পালন হবে মানুষ অথবা জীবজন্তুসহ প্রতিটি সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত সার্বজনীন কল্যাণকর আইনকানুন !।

>
[1] আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদিস নং- ১৭৫৮৪

[2] ত্ববারনী রহ. হাদিসটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী রহ. ভিন্ন শব্দে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।

[3] তিরমিযী, হাদিস নং- ১৯২৪

[4] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ২৬৭৭ এবং তিনি হাদিসটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।

[5] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ২৬৭৭ এবং তিনি হাদিসটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।

[6] মুসলিম, হাদিস নং- ৫১৬৭

[7] বুখারী, হাদিস নং- ৩২৯৫

[8] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ২৬৭৭ এবং হাদিসটি সহীহ।

[9] বুখারী, হাদিস নং- ৩১৩৬; মুসলিম, হাদিস নং- ২৯১৯

[10] মুসলিম, হাদিস নং- ৫৬৭৪

[11] সূরা আল-, আয়াত:

[12] বুখারী, হাদিস নং- ২২৪২, ২৭০৫ ও ৩৪৪৬