কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা ষষ্ঠ অধ্যায় - স্বীয় নাফসের সাথে মুসলিম বান্দার আদবসমূহ ইসলামহাউজ.কম
(ঘ) মুজাহাদা (المجاهدة ):

আর ‘মুজাহাদা’ হলো মুসলিম ব্যক্তি জেনে রাখবে যে, তার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার ‘নাফস’, যা স্বভাবতই খারাপ কাজের প্রতি আকৃষ্ট, ভালো কাজ থেকে পলায়নমান এবং মন্দ কাজের উস্কানিদাতা বা নির্দেশদাতা; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَمَآ أُبَرِّئُ نَفۡسِيٓۚ إِنَّ ٱلنَّفۡسَ لَأَمَّارَةُۢ بِٱلسُّوٓءِ

“আর আমি নিজকে নির্দোষ মনে করিনা, কেননা, নিশ্চয় মানুষের নাফস খারাপ কাজের নির্দেশ দিয়েই থাকে।”[1] আর এ ‘নাফস’ পছন্দ করে শান্তিতে ও স্থায়ীভাবে আরামে থাকেতে, ভালোবাসে অবসর সময় কাটাতে এবং স্বীয় প্রবৃত্তিকে সমূলে তাৎক্ষণিক বা নগদ ভোগবিলাসে আকৃষ্ট করতে, যদিও তাতে তার মরণ ও দুর্ভাগ্য বা দুঃখ-কষ্টের বিষয়টি নিহিত রয়েছে।

সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি যখন এ বিষয়টি বুঝতে পারবে, তখন সে নিজেকে প্রস্তুত করবে তার ‘নাফস’কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ও সাধনা করার জন্য; ফলে সে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে, অস্ত্রধারণ করবে তার বিপক্ষে এবং সিদ্ধন্ত গ্রহণ করবে তার বুদ্ধিহীনতা বা অস্থিরচিত্ততা এবং লোভ লালসাসমূহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। ফলে তার ‘নাফস’ যখন শান্তি পছন্দ করবে, তখন সে তাকে তার সুযোগ করে দিবে। আর যখন লোভ লালসার প্রতি আগ্রহী হবে, তখন সে তার জন্য তা হারাম করে দিবে; আর যখন কোনো আনুগত্য বা ভালো কাজ করার ক্ষেত্রে ত্রুটি করবে বা বিরত থাকবে, তখন তাকে শাস্তি দিবে এবং তিরস্কার করবে, তারপর যে (ভালো) কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা করতে তাকে বাধ্য করবে এবং যা কাজা বা বর্জন করেছে, তার কাযা আদায় করতে বাধ্য করবে। সে তার জন্য এ পদ্ধতি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না তার মন প্রশান্তি লাভ করবে ও পবিত্রতা অনুভব করবে; আর এটাই স্বীয় ‘নাফস’-এর জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের চেষ্টা ও সাধনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ

“আর যারা আমাদের পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, আমরা তাদেরকে অবশ্যই আমাদের পথসমূহের হিদায়াত দিব। আর নিশ্চয় আল্লাহ মুহসিনদের সঙ্গে আছেন।”[2]

আর মুসলিম ব্যক্তি যখন আল্লাহর জন্য তার ‘নাফস’কে প্রস্তুত করবে, যাতে তা পবিত্র, পরিশুদ্ধ ও প্রশান্ত হয় এবং হয় আল্লাহ তা‘আলার করুণা ও সন্তুষ্টির অধিকারী, তখন সে বুঝতে পারবে যে, এটাই হলো সৎকর্মশীল ও সত্যিকার মুমিনগণের পথ; ফলে সে তাদের অনুসরণ করে পথ চলবে এবং পরিভ্রমণ করবে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত জেগে নফল সালাত আদায় করতেন, এমনকি তাতে তাঁর দুই কদম মুবারক ফুলে পেটে যেত এবং তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন:

« أَفَلا أُحِبُّ أنْ أكُونَ عَبْداً شَكُوراً » . (مُتَّفَقٌ عَلَيهِ).

“আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়াটাকে পছন্দ করব না?”[3] আর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:

« والله ، لقد رأيت أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم وما أرى شيئا يشبههم كانوا يصبحون شعثاً غبراً صُفراً قد باتوا لله سجداً وقياماً ، يتلون كتاب الله يراوحون بين أقدامهم و جباههم ، و كانوا إذا ذُكر الله مادوا كما يميد الشجر فى يوم الريح ، وهملت أعينهم حتى تبل ثيابهم » .

“আল্লাহর কসম! আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহাবীগণকে দেখেছি এবং আমি তাঁদের মত কোনো সৃষ্টিকে দেখিনি— তাঁদের সকাল হতো আউলা কেশে ধূলা মাখানো বেশে ফ্যকাশে চেহারায়, তাঁরা রাতযাপন করেন আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদারত ও দাঁড়ানো অবস্থায়; তাঁরা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করতেন পালাক্রমে তাঁদের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে ও কপাল মাটিতে রেখে সিজদারত অবস্থায়; আর তাঁদের যখন আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, তখন তাঁরা এমনভাবে আন্দোলিত হয়, যেমনিভাবে ঝড়ের দিনে গাছপালা আন্দোলিত হয় এবং তাঁদের চোখের অশ্রুতে ভেসে তাঁদের কাপড়সমূহ ভিজে যেত।”[4]

আর আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “যদি তিনটি জিনিস না থাকত, তাহলে আমি একদিনও বেঁচে থাকাটাকে পছন্দ করতাম না: ১. প্রচণ্ড তাপের সময় আল্লাহর জন্য তৃষ্ণার্ত থাকা (অর্থাৎ সাওম পালন করা), ২. মধ্য রাতে আল্লাহকে সিজদা করা, এবং ৩. এমন সম্প্রদায়ের সাথে উঠা-বসা করা, যারা এমনভাবে বাছাই করে ভালো ভালো কথা বলে, যেমনিভাবে (খাওয়ার সময়) ভালো ভালো ফলগুলো বাছাই করা হয়।”[5]

আর ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জামায়াতে আসরের সালাত আদায় করতে না পারার কারণে নিজেকে নিজে তিরস্কার করেন এবং এ কারণে তিনি দুই লক্ষ দিরহাম মূল্যের জমি সাদকা করে দেন।[6]

আর আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা যখন কোনো সালাত জামায়াতে আদায় করতে ব্যর্থ হতেন, তখন তিনি ঐ রাতের পুরোটাই জেগে থাকতেন এবং পরের দিন মাগরিবের সালাত আদায় করা পর্যন্ত দিনের বেলায়ও ঘুমাতেন না, এমনকি রাতের আকাশে তারা উদয় হওয়ার পর তিনি দু’টি গোলাম আযাদ করে দিতেন।[7] আর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন:

« رحم الله أقواما يحسبهم الناس مرضى ، وما هم بمرضى »

“আল্লাহ ঐসব সম্প্রদায়ের প্রতি রহম করুন, জনগণ যাদেরকে অসুস্থ মনে করে, অথচ তারা অসুস্থ নন।”[8] আর এগুলো হলো স্বীয় নাফসের উন্নয়নে কঠোর সাধনার কিছু নমুনা।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« خَيرُ النَّاسِ مَنْ طَالَ عُمُرهُ ، وَحَسُنَ عَمَلُهُ » . (رواه الترمذي ).

“সেই ব্যক্তি উত্তম, যার বয়স দীর্ঘকাল ব্যাপী এবং কাজ সুন্দর।”[9] আর উয়াইস আল-কারনী রহ. বলতেন:

« هذه ليلة الركوع فيحيى الليل كله في ركعة ، وإذا كانت الليلة الآتية قال : هذه ليلة السجود فيحيى الليل كله في سجدة » .

“এটা হলো রুকূ‘ করার রাত, ফলে তিনি এক রুকূ‘তে গোটা রাত কাটিয়ে দিতেন; আর যখন পরবর্তী রাত আসত, তখন তিনি বলতেন: এটা হলো সিজদা করার রাত, ফলে তিনি এক সিজদাতেই গোটা রাত কাটিয়ে দিতেন।”[10]

আর সাবিত আল-বানানী রহ. বলেন: আমি এমন কয়েকজন ব্যক্তিকে পেয়েছি, যাদের একজন সালাত আদায় করতেন, অথচ তিনি হামাগুড়ি দেয়া ছাড়া তাঁর নিজ বিছানায় আসতে পারতেন না। আবার তাদের একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতেন, এমনকি দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তার দুই পা ফুলে যেত এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে তার চেষ্টা-সাধনা এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, যদি তাকে বলা হত: আগামী কাল কিয়ামত, তবুও তিনি অতিরিক্ত কিছু পাওয়ার চিন্তা করতেন না। আবার তাদের কেউ কেউ যখন শীতকাল আসত, তখন তিনি ঘরের ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যাতে ঠাণ্ডা বাতাসের আঘাতে তার ঘুম না আসে; আবার যখন গরমকাল আসত, তখন তিনি ঘরের ছাদের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যাতে গরমের কারণে তার ঘুম না আসে। আবার কেউ কেউ সিজদারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতেন।[11]

আর মসরূক রহ. এর স্ত্রী বলেন: “সালাতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে মাসরূক রহ.কে তাঁর দুই পা ফুলা অবস্থায় দেখা যেত; আল্লাহর কসম! আমি যদি তাঁর সালাতে দাঁড়ানো অবস্থায় তাঁর পেছনে বসতাম, তাহলে তাঁর প্রতি সহমর্মিতার কারণে আমি কেঁদে ফেলতাম।”[12]

আর তাদের কারো বয়স যখন চল্লিশে উপনিত হত, তখন তিনি তার বিছানা গুটিয়ে ফেলতেন, তারপর তিনি তার উপর আর কখনও ঘুমাতেন না।[13]

আরও বর্ণিত আছে যে, পূর্ববর্তী সৎব্যক্তিগণের মধ্য থেকে কোনো এক পবিত্রা নারী, যাকে অক্ষম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বলা হত, তিনি যখন রাতের শেষ ভাগে উপনীত হতেন, তখন তিনি করুণ স্বরে ডাকতেন:

« إليك قطع العابدون دجى الليالى يستبقون إلى رحمتك ، وفضل مغفرتك ، فبك يا إلهى أسألك لا بغيرك أن تجعلنى في أول زمرة السابقين ، وأن ترفعنى لديك في عليين ، في درجة المقربين ، وان تلحقنى بعبادك الصالحين ، فأنت أرحم الرحماء ، وأعظم العظماء ، وأكرم الكرماء ، يا كريم ! » .

“হে আমার প্রভু! রাতের অন্ধকারে বান্দাগণ সবকিছু বয়কট করে তোমার দিকে আসে, তারা তোমার রহমত ও ক্ষমার দিকে দৌড়ায়; আতএব, হে আমার আল্লাহ! আমি তুমি ভিন্ন অন্য কারও কাছে নয়, শুধু তোমার কাছে আবেদন করছি যে, তুমি আমাকে অগ্রগামীদের প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত করে নাও, আমাকে তোমার নিকট-‘ইল্লীনে উঠায়ে নাও, আমাকে তোমার নিকটতম বান্দাগণের মর্যাদায় উন্নীত কর এবং আমাকে তোমার সৎ বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত কর; কেননা, তুমি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়াবান, মহামহীয়ান, সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল, হে মহনুভব!।”[14] অতঃপর সে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং ফযর পর্যন্ত দো‘য়া ও ক্রন্দন করতে থাকে।[15]

>
[1] সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৩

[2] সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ৬৯

[3] বুখারী, হাদিস নং- ৪৫৫৭; মুসলিম, হাদিস নং- ৭৩০২

[4] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২৩

[5] প্রাগুক্ত

[6] প্রাগুক্ত

[7] প্রাগুক্ত

[8] আল-গাযালী রহ. তাঁর ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ্ দীন’, গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘মারফু’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন (৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪০৮)।

[9] তিরমিযী, হাদিস নং- ২৩২৯

[10] আল-গাযালী রহ., ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ্ দীন’ , ৭ম খণ্ড, পৃ. ৬৩

[11] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২৪

[12] প্রাগুক্ত

[13] প্রাগুক্ত

[14] আল-গাযালী রহ., ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ্ দীন’ , ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪১৪

[15] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২৪