লগইন করুন
মানবসত্তার স্বাভাবিক গতি ও ধারা বহমান রাখতে মানসিক প্রশান্তি ও চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। শরীয়ত তা অস্বীকার তো করেই না, বরং উৎসাহ প্রদান করে। ইসলাম বৈধ চিত্তবিনোদনের শুধু বৈধতাই দেয় না; বরং তাগিদও দেয়। আর এই প্রশান্তি অর্জনের মাধ্যমে প্রশান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ মানসিকতার উদ্ভব ঘটে। মানুষের জীবনে ব্যাপক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে এবং এর কারণে জীবনযাত্রা সুন্দর ও সাবলীল হয়। কারণ, বৈধ বিনোদন, অন্যের সঙ্গে মেলামেশা, ভাবের আদান-প্রদান, দেখা-সাক্ষাৎ, হাসি-কৌতুক ইত্যাদি আচরণ দ্বারা মানুষের অন্তর আনন্দে পূর্ণ হয়ে ওঠে এবং ইবাদতে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হয়। কেননা মানুষের অন্তর ক্লান্ত ও পলায়নপর।
সুতরাং সে যদি সর্বদা নফসকে তার স্বভাবের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে রাখে তবে তা ক্লান্তিকর হয়ে যাবে এবং অন্তর দ্বারা কাজ আদায় করে নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে কোনো কোনো সময় যদি বৈধ বিনোদন করা হয় তবে তা শক্তিশালী হয় এবং জাগতিক ও পারলৌকিক যে কোনো কাজ আদায় করে নেয়ার যোগ্য বলে প্রমাণিত হয়।
আর একথা চিরসত্য যে, বৈধ উপায়ে বিনোদনের মাধ্যমে মানুষের প্রাণ জীবন্ত হয়ে ওঠে। কর্মস্পৃহা সৃষ্টি হয়। ক্লান্তি-গ্লানী বিদূরিত হয়। আর এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া জৈবিক চাহিদা পূরণ। জৈবিক চাহিদা পূরণে আত্মার বিনোদন হাসিল হয় এবং কর্মক্লান্তি দূর হয়। বৈধ বিবাহে মনো-দৈহিক প্রশান্তি হাসিল হয়। বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলা কুরআনেও তুলে ধরেছেন। ইরশাদ করেছেন,
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١ ﴾ [الروم: ٢١]
‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।’ (সূরা আর-রূম, আয়াত : ২১)
ইসলামে কেউ ইবাদত-বন্দেগীতে ডুবে থেকে স্ত্রীকে ভুলে থাকবে, স্ত্রীর প্রতি উদাসীনতা দেখাবে এমন অবকাশ রাখা হয়নি। সাহাবীজীবনের চমৎকার একটি ঘটনায় দেখুন কী শিক্ষা দেয়া হয়েছে। আবূ মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
«دَخَلَتِ امْرَأَةُ عُثْمَانَ بْنِ مَظْعُونٍ عَلَى نِسَاءِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَرَأَيْنَهَا سَيِّئَةَ الْهَيْئَةِ، فَقُلْنَ: مَا لَكِ، مَا فِي قُرَيْشٍ رَجُلٌ أَغْنَى مِنْ بَعْلِكِ، قَالَتْ: مَا لَنَا مِنْهُ شَيْءٌ؟ أَمَّا نَهَارُهُ فَصَائِمٌ، وَأَمَّا لَيْلُهُ فَقَائِمٌ، قَالَ: فَدَخَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَكَرْنَ ذَلِكَ لَهُ، فَلَقِيَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فقَالَ: » يَا عُثْمَانُ، أَمَا لَكَ فِي أُسْوَةٍ «؟، قَالَ: وَمَا ذَاكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ، فِدَاكَ أَبِي وَأُمِّي؟، قَالَ: » أَمَّا أَنْتَ فَتَقُومُ اللَّيْلَ وَتَصُومُ النَّهَارَ، وَإِنَّ لِأَهْلِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّ لِجَسَدِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، صَلِّ وَنَمْ، وَصُمْ وَأَفْطِرْ «، قَالَ: فَأَتَتْهُمُ الْمَرْأَةُ بَعْدَ ذَلِكَ عَطِرَةً كَأَنَّهَا عَرُوسٌ، فَقُلْنَ لَهَا: مَهْ، قَالَتْ: أَصَابَنَا مَا أَصَابَ النَّاسُ».
‘উসমান ইবন মাযঊন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)র স্ত্রী মলিন বদন এবং পুরাতন কাপড়ে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের কাছে এলেন। তাঁরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এই অবস্থা কেন? কুরাইশদের মাঝে তোমার স্বামী থেকে ধনী কেউ নেই। তিনি বললেন, তার কাছে কি আমার কিছু পাওয়ার আছে? তার তো দিন কাটে সিয়ামে আর রাত কাটে কিয়ামে (সালাতে)। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশ করলেন। তখন তাঁরা তাঁর কাছে বিষয়টি আলোচনা করলেন। অতপর উসমান ইবন মাযঊনের সঙ্গে সাক্ষাত হলে তিনি তাকে বললেন, “আমার মধ্যে কি তোমার জন্য কোনো আদর্শ নেই?” উসমান ইবন মাযঊন বললেন, কী বলেন? আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবানী হোন! রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি কি রাতে কিয়ামে আর দিনে সিয়ামে লিপ্ত থাকো না? অথচ তোমার ওপর তোমার স্ত্রীর হক রয়েছে, আর তোমার ওপর তোমার শরীরেও হক রয়েছে। তুমি (রাতে) সালাত আদায় করবে, আবার ঘুমাবে। তেমনি (দিনে) সাওম পালন করবে আবার ভাঙ্গবেও।” বর্ণনাকারী বলেন, তারপর আরেকদিন তার স্ত্রী পরিচ্ছন্ন ও সুবাসিত অবস্থায় এলেন যেন নববধূ। রমণীকুল বললেন, বাহ। ওই মহিলা বললেন, আমাকেও তাই পেয়েছে যা মানুষকে পায়। (অর্থাৎ স্বামী সঙ্গসুখ) [সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩১৬]
আরেকটি চমকপ্রদ শিক্ষণীয় ঘটনায়ও এ শিক্ষা পাওয়া যায়। আবূ জুহাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
آخَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ سَلْمَانَ، وَأَبِي الدَّرْدَاءِ، فَزَارَ سَلْمَانُ أَبَا الدَّرْدَاءِ، فَرَأَى أُمَّ الدَّرْدَاءِ مُتَبَذِّلَةً، فَقَالَ لَهَا: مَا شَأْنُكِ؟ قَالَتْ: أَخُوكَ أَبُو الدَّرْدَاءِ لَيْسَ لَهُ حَاجَةٌ فِي الدُّنْيَا، فَجَاءَ أَبُو الدَّرْدَاءِ فَصَنَعَ لَهُ طَعَامًا، فَقَالَ: كُلْ؟ قَالَ: فَإِنِّي صَائِمٌ، قَالَ: مَا أَنَا بِآكِلٍ حَتَّى تَأْكُلَ، قَالَ: فَأَكَلَ، فَلَمَّا كَانَ اللَّيْلُ ذَهَبَ أَبُو الدَّرْدَاءِ يَقُومُ، قَالَ: نَمْ، فَنَامَ، ثُمَّ ذَهَبَ يَقُومُ فَقَالَ: نَمْ، فَلَمَّا كَانَ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ قَالَ: سَلْمَانُ قُمِ الآنَ، فَصَلَّيَا فَقَالَ لَهُ سَلْمَانُ: إِنَّ لِرَبِّكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَلِنَفْسِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَلِأَهْلِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، فَأَعْطِ كُلَّ ذِي حَقٍّ حَقَّهُ، فَأَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «صَدَقَ سَلْمَانُ»
‘নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালমান ও আবূ দারদা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)র মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করেছিলেন। সালমান আবূ দারদার সঙ্গে সাক্ষাত করতে গেলেন আর উম্মে দারদা (আবূ দারদার স্ত্রী)কে ময়লা কাপড় পরা দেখতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার তোমার অবস্থা কী?! তিনি বললেন, ‘আপনার ভাই আবূ দারদার দুনিয়ার চাহিদা নেই।’ এর মধ্যে আবূ দারদা এলেন এবং তাঁর (সালমানের) জন্য খাবার তৈরি করলেন। বললেন, ‘তুমি খেয়ে নাও, আমি সিয়াম পালন করছি।’সালমান বললেন, ‘তুমি না খেলে আমি খাচ্ছি না।’ বাধ্য হয়েই তাকে খেতে হলো।
যখন রাত হলো, আবূ দারদা (রাতের সালাতের জন্য) উঠে পড়লেন। সালমান বললেন, ‘ঘুমাও’। তিনি ঘুমালেন। পুনরায় আবূ দারদা উঠলে সালমান আবার বললেন, ‘ঘুমাও’। রাতের শেষ দিকে সালমান তাকে বললেন, ‘এখন ওঠো (সালাত আদায় করো)’। অতপর তাঁরা উভয়ে সালাত আদায় করলেন। অতপর সালমান আবূ দারদাকে বললেন, ‘তোমার ওপর তোমার রবের হক রয়েছে, তোমার ওপর তোমার আত্মার হক রয়েছে, তোমার ওপর তোমার স্ত্রীর হক রয়েছে, কাজেই প্রত্যেককে তার প্রাপ্য হক প্রদান করা উচিত।’ পরে আবূ দারদা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন এবং একথা তাঁর কাছে উল্লেখ করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সালমান সত্য বলেছে।’ [বুখারী : ১৯৬৮]
সুস্থ চিত্তবিনোদনে শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কর্মক্লান্তি দূর করার বিষয়টি পুণ্যবান পূর্বসুরীদের বক্তব্য দ্বারাও প্রমাণিত। মানসিক প্রশান্তির জন্য সুস্থ বিনোদনের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন,
«رَوِّحُوا الْقُلُوبَ فَإِنَّهَا إذَا أُكْرِهَتْ عَيَتْ»
‘তোমরা অন্তরকে প্রশান্তি দাও। কেননা, একাধারে তাকে অপছন্দনীয় কাজে বাধ্য করা হলে তা অন্ধ হয়ে যাবে।’
রবিআতুর রায় রহিমাহুল্লাহ বলতেন,
المروءة ست خصال : ثلاثة في الحضر وثلاثة في السفر ، ففي الحضر تلاوة القرآن وعمارة مساجد الله واتخاذ القرى في الله ، والتي في السفر ، فبذل الزاد ، وحسن الخلق ، وكثرة المزاح في غير معصيةٍ.
‘মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে ছয়টি কাজে। মুকিম থাকা অবস্থায় তিন কাজে এবং সফরে থাকা অবস্থায় তিন কাজে। মুকিম অবস্থার তিন কাজ হচ্ছে, কুরআন তিলাওয়াত, মসজিদ নির্মাণ ও আবাদ এবং আল্লাহ তা‘আলার ওয়াস্তে মেহমানদারী করা। আর সফরের তিন কাজ হচ্ছে, পাথেয় খরচ, উত্তম ব্যবহার এবং পাপ না হলে অধিকহারে হাসি-মসকরা করা।’
তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে, মানুষ যেহেতু সফরে সচরাচর স্ত্রীসঙ্গ থেকে বিরত থাকে তাই ওই সময় তার স্বাভাবিকতা রক্ষার জন্য হাসি-মজাক করবে। পক্ষান্তরে গৃহে অবস্থানকালে যেহেতু স্ত্রীসঙ্গ পায় এবং মন একারণে প্রশান্ত থাকে তাই সফরে সাধারণ হাসি-ঠাট্টা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বিখ্যাত তাবেয়ী ও মুহাদ্দিস ইবনে সীরীন রহিমাহুল্লাহ খুবই হাসিখুশি লোক ছিলেন। তিনি এই পরিমাণ হাসতেন যে, হাসতে হাসতে তাঁর লালা গড়িয়ে পড়ত! বর্ণিত আছে-
كان ابن سيرين كثير الضحك بالنهار كثير البكاء بالليل. قال غالب القطان : أتيتُ ابن سيرين يوماً ، فسألت عن هشام ، فقال : توفي البارحة أما شعرت ،فقلت : إنا لله وإنا إليه راجعون ، فضحك ، فقلت : لعله أراد النوم.
‘ইবনে সীরীন রহিমাহুল্লাহ দিনে অধিক হাসিখুশি লোক ছিলেন। আর রাতে ছিলেন অত্যধিক ক্রন্দনকারী। গালেব আলকাত্তান রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি একবার ইবনে সীরীন রহিমাহুল্লাহুর কাছে আগমন করলাম এবং হিশাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে তিনি বললেন, তুমি জানো না, গতরাতে তিনি মারা গেছেন! তাঁর কথা শুনে আমি إنا لله وإنا إليه راجعون বললাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! তিনি আমার জবাব শুনে হেসে উঠলেন। তখন আমার বোঝার বাকি থাকল না যে, তিনি এ কথা বলে ‘হিশাম রাতে ঘুমিয়েছেন’ এ কথাটি বুঝিয়েছেন! কেননা, ঘুমকেও মৃত্যুর ভাই বলা হয়। [বাগবী, শারহুস সুন্নাহ : ১৩/১৮৩]
মোটকথা, ইসলাম মানুষকে তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম চালু রাখতে বৈধ বিনোদনের অবকাশ দিয়েছে এবং সময় বিশেষে তাগিদও দিয়েছে। তাই একথা বলার সুযোগ নেই যে, ইসলাম কেবলই ইবাদত-বন্দেগী তলব করার ধর্ম, এখানে মানবিক চাহিদা, প্রকৃতিগত বাসনার কোনো মূল্য নেই। তবে হ্যাঁ, ইসলাম মানবিক চাহিদার সবগুলো বস্তুকে বৈধপন্থায় অর্জনের পক্ষপাতী।
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর আশা করি কারো এব্যাপারে দ্বিধা-সংকোচ থাকার কথা নয়। অবশ্য ইসলাম মানুষকে বাঁধনহারা হওয়ার অনুমতি দেয় না। বৈধ চিত্তবিনোদন করতে গিয়ে নামাজ-কালাম ঠিক রেখে, সতর রক্ষা ও শরীয়তের অন্যান্য যাবতীয় বিধান পালন করে কেউ যদি কিছু খেলাধূলায় লিপ্ত হয় তবে শরীয়ত তাকে সেটার অবকাশ দেবে। কিন্তু তাই বলে বিনোদনের উপকরণকে ইসলাম বিশ্বয়ানের রূপ দেয়ার অবকাশ দেয়নি।
খেলাধূলাকে বিশ্বায়নের রূপ দেয়ার ক্ষতি যে কত ভয়াবহ তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। তারা দেখেছেন, বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় যুব ও তরুণ সম্প্রদায়ই নয়, পৌঢ়-বৃদ্ধরাও খেলাজ্বরে আক্রান্ত হয়, দেশের মানচিত্রে বিদেশী পতাকা টাঙানোর নির্লজ্জ বেহায়াপনা শুরু হয়। মোবাইল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন অপশন ও সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে, কখনও দুয়েকটা ফ্রি টিকিট দেয়ার কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা বাগিয়ে নেয়। খেলা চলার সময় টিভির সামনে গেড়ে বসে গোটা জাতি। সাংসারিক, ব্যক্তিগত ও দীনী কাজ সব থমকে যায়। নামাজি ব্যক্তিকেই নামাজ কাজা কিংবা জামাত তরক করতে দেখা যায়। কিন্তু এসব ক্ষতি মাড়িয়ে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে ক্ষতি খেলাধূলার বিশ্বায়নের কারণে সৃষ্টি হয়, তা হলো নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মুসলিম দেশগুলো। কারণ, বিদেশী ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বহু আগেই ব্যভিচারের বাজার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ইসলামী মনীষীগণ চেষ্টা করছেন তাদের মা-বোনদেরকে এই জঘন্য পাপবৃত্তি থেকে বাঁচিয়ে ও দূরে রাখতে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের সেই চেষ্টা ও প্রাণপণ মেহনত ব্যাহত হচ্ছে। খেলাধূলার বিশ্বায়নের কারণে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ব্যভিচারের খড়কুটো ভেসে আসছে, যা প্রতিহত করা সাধারণত ব্যক্তি উদ্যোগে আদৌ সম্ভব নয়। এর বাস্তব প্রমাণ বাংলাদেশের বিপিএলের বিদেশী খেলোয়াড়দের সঙ্গে কতিপয় টিভি মডেলের শারীরিক সম্পর্কের পরিকল্পিত ন্যাক্কারজনক ঘটনা।
খবরে প্রকাশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলংকার দু’জন নিগ্রো খেলোয়াড়ের সঙ্গে এদেশের কয়েকজন টিভি মডেল ও টিভি উপস্থাপিকা (নাম প্রকাশ করা হলো না) অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হন। ঘটনার বিবরণ ও বর্ণনা খুবই বেদনায়দায়ক। একজন মুসলিমের তার জন্য দেশের নাগরিকদের এভাবে বিদেশীদের হাতে ইজ্জত লুণ্ঠনের ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু খেলাধূলোকে বাঁচাতে হলে ইজ্জত এভাবে একটু বিলিয়ে দিতে হবেই- বলে মনে করেন এতদসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা! তাদের ভাষ্য মতে, ঠিক মতো নারী সরবরাহ না করা হলে বিদেশী খেলোয়াড়রা খেলতে আসতে চায় না, আসর জমে না! সুতরাং খেলাধূলার এই বিশ্বায়নের যুগে খেলাধূলা বাঁচাতে হলে প্রয়োজনে লক্ষ নারীর ইজ্জত-সতীত্ব মারতেও কোনো আপত্তি নেই!
বস্তুতঃ খেলাধূলার বিশ্বায়নে মুসলমানের যে ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে তা হলো নারীদের ইজ্জত-আব্রুর ক্ষতি। বাংলাদেশের সম্মানীত নারীদের ইজ্জত-আব্রু আরো অনেকভাবেই বিদেশীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছে এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় লোকেরাই বলতে গেলে অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই নারীদের এই সম্মানে আঘাত হানছেন। অকুতোভয় বীর সাংবাদিক জনাব মাহমুদুর রহমান সাহেব তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যেসব বিদেশীকে কূটনীতিকের দায়িত্ব প্রদান করা হয় তারা কাজে যোগ দেয়ার আগেও কাঁদে, বিদায় নেয়ার সময়ও কাঁদে। একটি অনুন্নত, সুযোগ-সুবিধাহীন দেশ মনে করে কাজে যোগ দেয়ার আগে ক্রন্দন করে আর কাজে যোগ দেয়ার পর এদেশের নারীসুখে অভ্যস্থ হয়ে ওঠায় বিদায় নেয়ার সময় চরম ‘বঞ্চনা’র দুঃখে ক্রন্দন করে।’
প্রতিটি দেশের কূটনীতিকরা বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা ভোগ করে থাকে। সেই নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে যেনতেন লোকের তাদের কাছে পৌঁছা সম্ভব নয়। সুতরাং যে কেউ তাদের কাছে পৌঁছতে হলে ঊর্ধ্বতন লোকদের সহযোগিতা অবশ্যই প্রয়োজন। সুতরাং এদেশের নারীদের ইজ্জত-আব্রু বিনষ্ট করার দায় কেবলই ওই নারীদের, না যারা তাদেরকে সেখানে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেয় তাদেরও? এভাবে দেশের ইজ্জত নষ্ট করা কি দেশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার মতো অপরাধ নয়? দেশের স্বাধীনতা নাগরিকদের ইজ্জতের জন্যই, সেই ইজ্জতই যদি রক্ষিত না হয়, তবে সেদেশের স্বাধীনতার মাহাত্ম্য থাকলো কোথায়?
সারকথা, মানুষ তার কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব করবে- এটি ইসলাম অনুমোদন করে না। তার কোনো আচরণ সমাজের শালীনতা চর্চা ও শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট করবে- এটাও ইসলামে সমর্থিত নয়। মুসলমানের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কথা ও কাজ হবে আল্লাহর নির্দেশনা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্মল আদর্শ অনুযায়ী। যে ধরনের বিনোদন মানুষকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত করে এবং সীমা লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানুষকে বেপরোয়া জীবনযাপনে ধাবিত করে তা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয় ইসলাম। যারা বিরত হবে না তাদের জন্য শাস্তির কথা বলে কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَشۡتَرِي لَهۡوَ ٱلۡحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًاۚ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ عَذَابٞ مُّهِينٞ ٦ ﴾ [لقمان: ٦]
‘একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তাদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।‘ (সূরা লোকমান, আয়াত : ৬)
আরেক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ ٱلۡفَٰحِشَةُ فِي ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ١٩ ﴾ [النور: ١٩]
‘নিশ্চয় যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জানো না।’ (সূরা আন-নূর, আয়াত : ১৯)