লগইন করুন
[সিফাত বিষয়ে আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায়ের মতবাদের খণ্ডন]
আহলে তা‘তীলের কেউ কেউ আল্লাহ তা‘আলার সকল সিফাতের ক্ষেত্রে এই রূপক অর্থ নেওয়ার নীতি অনুসরণ করে, অথবা তারা আল্লাহর নামসমূহকেও এ নীতির আওতায় শামিল করে। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা ভিন্ন পথ ধরেন অর্থাৎ কিছু সিফাতকে সাব্যস্ত করেন আবার কিছু সিফাতকে অসাব্যস্ত করেন। যেমন আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায়। তাদের বুদ্ধি-বিবেচনার আলোকে যেটি বোধগম্য মনে হয়েছে সেটি তারা সাব্যস্ত করে, আবার যেটি তাদের কাছে অবোধ্যগম্য মনে হয়েছে তা তারা নাকচ করে দিয়েছে।
তাদের জন্য আমাদের বক্তব্য হলো: আপনার বুদ্ধি-বিবেচনার বোধগম্যতার নিরিখে যা নাকচ করে দিয়েছেন, তা বুদ্ধি-বিবেচনার দলিল দিয়েই প্রমাণ করা যায়, পাশাপাশি ওহীর প্রমাণ তো আছেই।
এর উদাহরণ: তারা ‘ইরাদাহ’ অর্থাৎ ‘ইচ্ছা’র সিফাতকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেন। পক্ষান্তরে ‘রহমত’ অর্থাৎ ‘করুণা’র সিফাতকে নাকচ করে দেন। ‘ইচ্ছা’র সিফাতকে তারা ওহী ও যুক্তি এ উভয়টির আলোকে সাব্যস্ত করেন। তন্মধ্যে
ওহী থেকে সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে তাদের দলিল হলো, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يُرِيدُ ٢٥٣ ﴾ [البقرة: ٢٥٣]
কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা করেন। (সূরা আল বাকারা: ২: ২৫৩)
পক্ষান্তরে সেটা সাব্যস্ত করার জন্য তাদের পক্ষ থেকে যুক্তির দলিল হলো: সৃষ্টিকুলের বিভিন্নতা এবং প্রতিটি সৃষ্টিকে আলাদা সত্তা ও গুণ প্রদান করা এ কথারই প্রমাণ যে আল্লাহ তা‘আলা ‘ইচ্ছা’র গুণে গুণান্বিত।
কিন্তু তারা আল্লাহর জন্য রহমত বা ‘করুণা’র গুণকে এ যুক্তিতে নাকচ করে দিয়েছে যে, করুণা করার দাবি হলো, যার প্রতি করুণা করা হবে তার জন্য করুণাকারী নরম হয়ে যাবেন। আর এই নরম হয়ে যাওয়া আল্লাহর ক্ষেত্রে অসম্ভব, অকল্পনীয় বিষয়। [সুতরাং তাদের মতে রহমত গুণ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা যাবে না]
এরপর তারা যেসব আয়াত ও হাদীসে রহমতের কথা আছে সেসব আয়াত ও হাদীসকে তাবিল তথা অপব্যাখ্যা করে বলেন যে এখানে রহমতের অর্থ ‘কর্ম’ অথবা ‘কর্ম’ করার ইচ্ছা। অতএব তারা الرحيم (আর রাহীম) শব্দের অর্থ করেন, ‘নিয়ামতদাতা’, অথবা ‘নিয়ামত প্রদানের ইচ্ছাকারী’।
এদের জন্য আমাদের বক্তব্য হলো: ‘রহমত’ গুণটি আল্লাহ তা‘আলার জন্য ওহী দ্বারা প্রমাণিত। আর সংখ্যা ও ধরনের বিবেচনায় রহমত গুণটি যতভাবে সাব্যস্ত হয়েছে, ‘ইচ্ছা’ সিফাতটি ততভাবে সাব্যস্ত হয়নি। তা নাম হিসেবে এসেছে, যেমন:
﴿ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ٣ ﴾ [الفاتحة: ٣]
পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। (আল ফাতিহা: ৩)
সিফাত হিসেবে এসেছে, যেমন:
﴿ وَرَبُّكَ ٱلۡغَفُورُ ذُو ٱلرَّحۡمَةِۖ﴾ [الكهف: ٥٨]
আর তোমার রব ক্ষমাশীল, দয়াময়। (আল কাহ্ফ: ১৮: ৫৮)
এবং ক্রিয়াপদ হিসেবে এসেছে। যেমন:
﴿وَيَرۡحَمُ مَن يَشَآءُۖ﴾ [العنكبوت: ٢١]
এবং যাকে ইচ্ছা দয়া করবেন। (আল আনকাবুত: ২৯: ২১)
এর পাশাপাশি রহমত সিফাতটি যুক্তির মাধ্যমেও প্রমাণ করা যায়। আর তা এভাবে যে, বান্দাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতসমূহ অনবরত বর্ষিত হওয়া এবং তাদের ওপর থেকে আপদ-বিপদ উঠিয়ে নেওয়া এ কথার প্রমাণ যে আল্লাহ তা‘আলা রহমতের গুণে গুণান্বিত। আর এ নিয়ামত বর্ষিত হওয়া এবং বিপদ উঠে যাওয়ার বিষয়টি ইচ্ছার গুণের তুলনায় রহমতের গুণকে অধিক পরিষ্কারভাবে বুঝায়; কেননা এ বিষয়টি সাধারন মানুষ ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সবার কাছেই স্পষ্ট। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার সঙ্গে তা সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি কেবল বিশেষ ব্যক্তিদের কাছেই পরিষ্কার।
আর রহমত গুণটিকে এই অজুহাতে নাকচ করে দেওয়া যে, তা মেনে নিলে বলতে বাধ্য হতে হয় যে, যিনি রহমকারী তিনি নরম হয়ে যান, অতএব তা আল্লাহর ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য। এ কথার জবাব হলো: যদি উল্লিখিত কারণে ‘রহমত’ সিফাতকে নাকচ করে দেওয়া হয়, তবে অভিন্ন কারণে ‘ইচ্ছা’ সিফাতকেও নাকচ করে দেওয়া যাবে; কেননা ইচ্ছা বলা হয়, এমন বিষয়ের প্রতি ইচ্ছাকারীর ঝুঁকে পড়া যার দ্বারা সে কোনো উপকারসাধন অথবা ক্ষতিকর বিষয়কে দমন করতে চান। অতএব ‘ইচ্ছা’র দাবি হলো প্রয়োজনগ্রস্ত থাকা। আর আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রয়োজন থেকে পবিত্র।
উত্তরে যদি বলা হয়: আপনি ‘ইচ্ছা’র যে সংজ্ঞা দিলেন তাতো হলো সৃষ্টিজীবের ইচ্ছার সংজ্ঞা, তাহলে বলব যে রহমতের ব্যাপারে আপনারা যা বলেন, সেটাও তো সৃষ্টিজীবের রহমতের বর্ণনা। সৃষ্টিকর্তার রহমত তো সম্পূর্ণ ভিন্ন, যার হাকীকত মানুষের জানা নেই।
এই আলোচনা দ্বারা আহলে তা‘তীল তথা সিফাত-বাতিলকারী সম্প্রদায়ের সকল বক্তব্যই খণ্ডিত হয়ে গেল, হোক সাধারণ তা‘তীল অথবা বিশেষ তা‘তীল।
অতএব এটা এখন স্পষ্ট যে আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায় আল্লাহর (যে সব) নাম ও সিফাত (সাব্যস্ত করে তা) সাব্যস্ত করতে গিয়ে মুতাযিলা ও জাহমিয়া সম্প্রদায়ের যুক্তি খণ্ডনের ক্ষেত্রে যা বলেন তা দিয়ে আসলে তাদের যুক্তি খণ্ডিত হয় না। আর তা দু কারণে:
এক. মুতাযিলা ও জাহমিয়া সম্প্রদায়ের যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে যে পথে গমন করা হলো, সেটা হলো বিদ‘আতী পথ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সালাফ ও ইমামগণ এ পথের ওপর ছিলেন না। আর মুতাযিলা ও জাহমিয়াদের বিদআতকে অপর বিদআত দিয়ে দমন সমুচিত নয়, বরং বিদআতকে সুন্নত দিয়ে দমন করতে হয়।
দ্বিতীয়ত: মুতাযিলা ও জাহামিয়া সম্প্রদায় অভিন্ন ধরনের যুক্তির আশ্রয় নিয়ে আশ‘আরী ও মাতুরিদীদের বক্তব্যকে খণ্ডন করতে পারে যে যুক্তির আশ্রয় নিয়ে আশ‘আরী ও মাতুরিদীরা আহলে সুন্নাতের মতকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছে। তারা বলতে পারে যে: আপনারা যুক্তিভিত্তিক দলিলের আশ্রয় নিয়ে সিফাত নাকচ করাকে নিজেদের জন্য বৈধ করে নিয়েছেন এবং ওহীর দলিল দ্বারা যা প্রমাণিত হয়েছে তা আপনার তাবিল করেছেন। তাহলে আমরা যুক্তিভিত্তিক দলিলের আশ্রয়ে যা নাকচ করলাম এবং ওহীর দলিলকে যেভাবে তাবিল করলাম তা আমাদের ক্ষেত্রে অবৈধ ভাবার কারণ কি? আপনারও বুদ্ধিনির্ভর যুক্তি দেন আমরাও বুদ্ধিনির্ভর যুক্তি দিই। তাহলে আমাদের বুদ্ধি অশুদ্ধ এবং আপনাদের বুদ্ধি শুদ্ধ হওয়ার কারণ কি? অতএব আমাদের কথা অস্বীকার করার জন্য স্রেফ মনোবৃত্তির অনুসরণ ছাড়া আপনাদের কাছে কোনো প্রমাণই দেখছি না।
এটি একটি অকাট্য যুক্তি এবং জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের পক্ষ থেকে আশ‘আরী ও মাতুরিদীদের বাকরুদ্ধ করার মতো প্রমাণ। এ যুক্তি-প্রমাণ খণ্ডানোর একটিই পথ, আর তা হলো সালাফদের মাযহাব যারা এ পথকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন এবং আল্লাহর জন্য ওইসব নাম ও সিফাত সাব্যস্ত করেন যা আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য তাঁর কিতাবে সাব্যস্ত করেছেন অথবা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে সাব্যস্ত করেছেন। যে সাব্যস্তকরণ প্রক্রিয়ায় নেই কোনো তুলনা নির্ধারণ অথবা আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ আর না আছে কোনো অর্থশূণ্যকরণ অথবা বিকৃতিসাধন। আসলে আল্লাহ তা‘আলা যদি কারো জন্যে আলোর ব্যবস্থা না করেন তাহলে নিজ থেকে কেউ আলোর ব্যবস্থা করতে পারেন না। ইরশাদ হয়েছে:
﴿وَمَن لَّمۡ يَجۡعَلِ ٱللَّهُ لَهُۥ نُورٗا فَمَا لَهُۥ مِن نُّورٍ ٤٠ ﴾ [النور: ٤٠]
আর আল্লাহ যাকে নূর দেন না তার জন্য কোনো নূর নেই। (সূরা আন-নূর: ২৪: ৪০)
দ্রষ্টব্য: উল্লিখিত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে,
প্রত্যেক মু‘আত্তিল (সিফাতের বাহ্যিক অর্থ বাতিলকারী) ব্যক্তিই ‘মুমাচ্ছিল’ (অর্থাৎ সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে তুলনাকারী) অনুরূপভাবে প্রত্যেক মুমাচ্ছিল (সৃষ্টিজীবের গুণাগুণের সঙ্গে আল্লাহর গুণাগুণের তুলনাকারী) ব্যক্তিই মু‘আত্তিল (সিফাতকে অর্থহীনকারী)।
তন্মধ্যে মু‘আত্তিল (সিফাতকে অর্থশূণ্যকারী) কিভাবে তা তা‘তীল (অর্থহীন) করে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। এখন থেকে যায় মু‘আত্তিল (সিফাতের বাহ্যিক অর্থ বাতিলকারী ব্যক্তি) কিভাবে মুমাচ্ছিল (আল্লাহর সিফাতকে সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে তুলনাকারী) সেটা প্রসঙ্গে। এ ব্যাপারে বলা যায় যে, সিফাতকে অর্থহীনকারী এ জন্যই তা অর্থহীন করে যে তার ধারণা মতে, বাহ্যিক অর্থ রেখে দিলে আল্লাহর সিফাত সৃষ্টিজীবের সিফাততুল্য হয়ে যায়, এ কারণেই সে তা অর্থহীন করে দেয়। অতএব সে প্রথমে সৃষ্টিজীবের সঙ্গে তুলনা করছে এবং পরে বাতিলকরণ প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিচ্ছে।
এবার আসা যাক মুমাচ্ছিল (আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে তুলনাকারী) এর প্রসঙ্গে। তুলনাকারী একদিকে সে তুলনাকারী অপরদিকে সে সেগুলোকে অর্থহীন ধারণাকারী। বস্তুত সে তিন কারণে এগুলোকে অর্থহীনকারী হিসেবে পরিণত হয়েছে:
এক. সে খোদ ওই টেক্সটকেই অর্থহীন করে দিয়েছে যার দ্বারা সিফাত প্রমাণ করা হয়। কেননা সে এ টেক্সটকে এমনভাবে বুঝেছে যার দ্বারা সৃষ্টিজীবের সঙ্গে আল্লাহর তা‘আলার তুলনা হয়ে যায়। যদিও এ টেক্সটে আদৌ কোনো তুলনা নেই; কেননা তা আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে এমনভাবে সাব্যস্ত করছে যেমনভাবে তা আল্লাহর জন্য উপযোগী।
দুই. সে প্রত্যেক ওই টেক্সটকে অন্তঃসারশূণ্য করে দিয়েছে যার দ্বারা সৃষ্টিজীবের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার তুলনাহীনতা প্রমাণিত হয়।
তিন. সে আল্লাহ তা‘আলাকে তাঁর যথাযথ ওয়াজিব পূর্ণাঙ্গ গুণাবলী থেকে বিমুক্ত করে দিয়েছে, কারণ, সে অপূর্ণাঙ্গ মাখলুকের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলাকে তুলনা করেছে।[সিফাত বিষয়ে আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায়ের মতবাদের খণ্ডন]
আহলে তা‘তীলের কেউ কেউ আল্লাহ তা‘আলার সকল সিফাতের ক্ষেত্রে এই রূপক অর্থ নেওয়ার নীতি অনুসরণ করে, অথবা তারা আল্লাহর নামসমূহকেও এ নীতির আওতায় শামিল করে। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা ভিন্ন পথ ধরেন অর্থাৎ কিছু সিফাতকে সাব্যস্ত করেন আবার কিছু সিফাতকে অসাব্যস্ত করেন। যেমন আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায়। তাদের বুদ্ধি-বিবেচনার আলোকে যেটি বোধগম্য মনে হয়েছে সেটি তারা সাব্যস্ত করে, আবার যেটি তাদের কাছে অবোধ্যগম্য মনে হয়েছে তা তারা নাকচ করে দিয়েছে।
তাদের জন্য আমাদের বক্তব্য হলো: আপনার বুদ্ধি-বিবেচনার বোধগম্যতার নিরিখে যা নাকচ করে দিয়েছেন, তা বুদ্ধি-বিবেচনার দলিল দিয়েই প্রমাণ করা যায়, পাশাপাশি ওহীর প্রমাণ তো আছেই।
এর উদাহরণ: তারা ‘ইরাদাহ’ অর্থাৎ ‘ইচ্ছা’র সিফাতকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেন। পক্ষান্তরে ‘রহমত’ অর্থাৎ ‘করুণা’র সিফাতকে নাকচ করে দেন। ‘ইচ্ছা’র সিফাতকে তারা ওহী ও যুক্তি এ উভয়টির আলোকে সাব্যস্ত করেন। তন্মধ্যে
ওহী থেকে সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে তাদের দলিল হলো, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يُرِيدُ ٢٥٣ ﴾ [البقرة: ٢٥٣]
কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা করেন। (সূরা আল বাকারা: ২: ২৫৩)
পক্ষান্তরে সেটা সাব্যস্ত করার জন্য তাদের পক্ষ থেকে যুক্তির দলিল হলো: সৃষ্টিকুলের বিভিন্নতা এবং প্রতিটি সৃষ্টিকে আলাদা সত্তা ও গুণ প্রদান করা এ কথারই প্রমাণ যে আল্লাহ তা‘আলা ‘ইচ্ছা’র গুণে গুণান্বিত।
কিন্তু তারা আল্লাহর জন্য রহমত বা ‘করুণা’র গুণকে এ যুক্তিতে নাকচ করে দিয়েছে যে, করুণা করার দাবি হলো, যার প্রতি করুণা করা হবে তার জন্য করুণাকারী নরম হয়ে যাবেন। আর এই নরম হয়ে যাওয়া আল্লাহর ক্ষেত্রে অসম্ভব, অকল্পনীয় বিষয়। [সুতরাং তাদের মতে রহমত গুণ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা যাবে না]
এরপর তারা যেসব আয়াত ও হাদীসে রহমতের কথা আছে সেসব আয়াত ও হাদীসকে তাবিল তথা অপব্যাখ্যা করে বলেন যে এখানে রহমতের অর্থ ‘কর্ম’ অথবা ‘কর্ম’ করার ইচ্ছা। অতএব তারা الرحيم (আর রাহীম) শব্দের অর্থ করেন, ‘নিয়ামতদাতা’, অথবা ‘নিয়ামত প্রদানের ইচ্ছাকারী’।
এদের জন্য আমাদের বক্তব্য হলো: ‘রহমত’ গুণটি আল্লাহ তা‘আলার জন্য ওহী দ্বারা প্রমাণিত। আর সংখ্যা ও ধরনের বিবেচনায় রহমত গুণটি যতভাবে সাব্যস্ত হয়েছে, ‘ইচ্ছা’ সিফাতটি ততভাবে সাব্যস্ত হয়নি। তা নাম হিসেবে এসেছে, যেমন:
﴿ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ٣ ﴾ [الفاتحة: ٣]
পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। (আল ফাতিহা: ৩)
সিফাত হিসেবে এসেছে, যেমন:
﴿ وَرَبُّكَ ٱلۡغَفُورُ ذُو ٱلرَّحۡمَةِۖ﴾ [الكهف: ٥٨]
আর তোমার রব ক্ষমাশীল, দয়াময়। (আল কাহ্ফ: ১৮: ৫৮)
এবং ক্রিয়াপদ হিসেবে এসেছে। যেমন:
﴿وَيَرۡحَمُ مَن يَشَآءُۖ﴾ [العنكبوت: ٢١]
এবং যাকে ইচ্ছা দয়া করবেন। (আল আনকাবুত: ২৯: ২১)
এর পাশাপাশি রহমত সিফাতটি যুক্তির মাধ্যমেও প্রমাণ করা যায়। আর তা এভাবে যে, বান্দাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতসমূহ অনবরত বর্ষিত হওয়া এবং তাদের ওপর থেকে আপদ-বিপদ উঠিয়ে নেওয়া এ কথার প্রমাণ যে আল্লাহ তা‘আলা রহমতের গুণে গুণান্বিত। আর এ নিয়ামত বর্ষিত হওয়া এবং বিপদ উঠে যাওয়ার বিষয়টি ইচ্ছার গুণের তুলনায় রহমতের গুণকে অধিক পরিষ্কারভাবে বুঝায়; কেননা এ বিষয়টি সাধারন মানুষ ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সবার কাছেই স্পষ্ট। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার সঙ্গে তা সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি কেবল বিশেষ ব্যক্তিদের কাছেই পরিষ্কার।
আর রহমত গুণটিকে এই অজুহাতে নাকচ করে দেওয়া যে, তা মেনে নিলে বলতে বাধ্য হতে হয় যে, যিনি রহমকারী তিনি নরম হয়ে যান, অতএব তা আল্লাহর ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য। এ কথার জবাব হলো: যদি উল্লিখিত কারণে ‘রহমত’ সিফাতকে নাকচ করে দেওয়া হয়, তবে অভিন্ন কারণে ‘ইচ্ছা’ সিফাতকেও নাকচ করে দেওয়া যাবে; কেননা ইচ্ছা বলা হয়, এমন বিষয়ের প্রতি ইচ্ছাকারীর ঝুঁকে পড়া যার দ্বারা সে কোনো উপকারসাধন অথবা ক্ষতিকর বিষয়কে দমন করতে চান। অতএব ‘ইচ্ছা’র দাবি হলো প্রয়োজনগ্রস্ত থাকা। আর আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রয়োজন থেকে পবিত্র।
উত্তরে যদি বলা হয়: আপনি ‘ইচ্ছা’র যে সংজ্ঞা দিলেন তাতো হলো সৃষ্টিজীবের ইচ্ছার সংজ্ঞা, তাহলে বলব যে রহমতের ব্যাপারে আপনারা যা বলেন, সেটাও তো সৃষ্টিজীবের রহমতের বর্ণনা। সৃষ্টিকর্তার রহমত তো সম্পূর্ণ ভিন্ন, যার হাকীকত মানুষের জানা নেই।
এই আলোচনা দ্বারা আহলে তা‘তীল তথা সিফাত-বাতিলকারী সম্প্রদায়ের সকল বক্তব্যই খণ্ডিত হয়ে গেল, হোক সাধারণ তা‘তীল অথবা বিশেষ তা‘তীল।
অতএব এটা এখন স্পষ্ট যে আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায় আল্লাহর (যে সব) নাম ও সিফাত (সাব্যস্ত করে তা) সাব্যস্ত করতে গিয়ে মুতাযিলা ও জাহমিয়া সম্প্রদায়ের যুক্তি খণ্ডনের ক্ষেত্রে যা বলেন তা দিয়ে আসলে তাদের যুক্তি খণ্ডিত হয় না। আর তা দু কারণে:
এক. মুতাযিলা ও জাহমিয়া সম্প্রদায়ের যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে যে পথে গমন করা হলো, সেটা হলো বিদ‘আতী পথ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সালাফ ও ইমামগণ এ পথের ওপর ছিলেন না। আর মুতাযিলা ও জাহমিয়াদের বিদআতকে অপর বিদআত দিয়ে দমন সমুচিত নয়, বরং বিদআতকে সুন্নত দিয়ে দমন করতে হয়।
দ্বিতীয়ত: মুতাযিলা ও জাহামিয়া সম্প্রদায় অভিন্ন ধরনের যুক্তির আশ্রয় নিয়ে আশ‘আরী ও মাতুরিদীদের বক্তব্যকে খণ্ডন করতে পারে যে যুক্তির আশ্রয় নিয়ে আশ‘আরী ও মাতুরিদীরা আহলে সুন্নাতের মতকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছে। তারা বলতে পারে যে: আপনারা যুক্তিভিত্তিক দলিলের আশ্রয় নিয়ে সিফাত নাকচ করাকে নিজেদের জন্য বৈধ করে নিয়েছেন এবং ওহীর দলিল দ্বারা যা প্রমাণিত হয়েছে তা আপনার তাবিল করেছেন। তাহলে আমরা যুক্তিভিত্তিক দলিলের আশ্রয়ে যা নাকচ করলাম এবং ওহীর দলিলকে যেভাবে তাবিল করলাম তা আমাদের ক্ষেত্রে অবৈধ ভাবার কারণ কি? আপনারও বুদ্ধিনির্ভর যুক্তি দেন আমরাও বুদ্ধিনির্ভর যুক্তি দিই। তাহলে আমাদের বুদ্ধি অশুদ্ধ এবং আপনাদের বুদ্ধি শুদ্ধ হওয়ার কারণ কি? অতএব আমাদের কথা অস্বীকার করার জন্য স্রেফ মনোবৃত্তির অনুসরণ ছাড়া আপনাদের কাছে কোনো প্রমাণই দেখছি না।
এটি একটি অকাট্য যুক্তি এবং জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের পক্ষ থেকে আশ‘আরী ও মাতুরিদীদের বাকরুদ্ধ করার মতো প্রমাণ। এ যুক্তি-প্রমাণ খণ্ডানোর একটিই পথ, আর তা হলো সালাফদের মাযহাব যারা এ পথকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন এবং আল্লাহর জন্য ওইসব নাম ও সিফাত সাব্যস্ত করেন যা আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য তাঁর কিতাবে সাব্যস্ত করেছেন অথবা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে সাব্যস্ত করেছেন। যে সাব্যস্তকরণ প্রক্রিয়ায় নেই কোনো তুলনা নির্ধারণ অথবা আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ আর না আছে কোনো অর্থশূণ্যকরণ অথবা বিকৃতিসাধন। আসলে আল্লাহ তা‘আলা যদি কারো জন্যে আলোর ব্যবস্থা না করেন তাহলে নিজ থেকে কেউ আলোর ব্যবস্থা করতে পারেন না। ইরশাদ হয়েছে:
﴿وَمَن لَّمۡ يَجۡعَلِ ٱللَّهُ لَهُۥ نُورٗا فَمَا لَهُۥ مِن نُّورٍ ٤٠ ﴾ [النور: ٤٠]
আর আল্লাহ যাকে নূর দেন না তার জন্য কোনো নূর নেই। (সূরা আন-নূর: ২৪: ৪০)
দ্রষ্টব্য: উল্লিখিত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে,
প্রত্যেক মু‘আত্তিল (সিফাতের বাহ্যিক অর্থ বাতিলকারী) ব্যক্তিই ‘মুমাচ্ছিল’ (অর্থাৎ সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে তুলনাকারী) অনুরূপভাবে প্রত্যেক মুমাচ্ছিল (সৃষ্টিজীবের গুণাগুণের সঙ্গে আল্লাহর গুণাগুণের তুলনাকারী) ব্যক্তিই মু‘আত্তিল (সিফাতকে অর্থহীনকারী)।
তন্মধ্যে মু‘আত্তিল (সিফাতকে অর্থশূণ্যকারী) কিভাবে তা তা‘তীল (অর্থহীন) করে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। এখন থেকে যায় মু‘আত্তিল (সিফাতের বাহ্যিক অর্থ বাতিলকারী ব্যক্তি) কিভাবে মুমাচ্ছিল (আল্লাহর সিফাতকে সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে তুলনাকারী) সেটা প্রসঙ্গে। এ ব্যাপারে বলা যায় যে, সিফাতকে অর্থহীনকারী এ জন্যই তা অর্থহীন করে যে তার ধারণা মতে, বাহ্যিক অর্থ রেখে দিলে আল্লাহর সিফাত সৃষ্টিজীবের সিফাততুল্য হয়ে যায়, এ কারণেই সে তা অর্থহীন করে দেয়। অতএব সে প্রথমে সৃষ্টিজীবের সঙ্গে তুলনা করছে এবং পরে বাতিলকরণ প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিচ্ছে।
এবার আসা যাক মুমাচ্ছিল (আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে তুলনাকারী) এর প্রসঙ্গে। তুলনাকারী একদিকে সে তুলনাকারী অপরদিকে সে সেগুলোকে অর্থহীন ধারণাকারী। বস্তুত সে তিন কারণে এগুলোকে অর্থহীনকারী হিসেবে পরিণত হয়েছে:
এক. সে খোদ ওই টেক্সটকেই অর্থহীন করে দিয়েছে যার দ্বারা সিফাত প্রমাণ করা হয়। কেননা সে এ টেক্সটকে এমনভাবে বুঝেছে যার দ্বারা সৃষ্টিজীবের সঙ্গে আল্লাহর তা‘আলার তুলনা হয়ে যায়। যদিও এ টেক্সটে আদৌ কোনো তুলনা নেই; কেননা তা আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে এমনভাবে সাব্যস্ত করছে যেমনভাবে তা আল্লাহর জন্য উপযোগী।
দুই. সে প্রত্যেক ওই টেক্সটকে অন্তঃসারশূণ্য করে দিয়েছে যার দ্বারা সৃষ্টিজীবের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার তুলনাহীনতা প্রমাণিত হয়।
তিন. সে আল্লাহ তা‘আলাকে তাঁর যথাযথ ওয়াজিব পূর্ণাঙ্গ গুণাবলী থেকে বিমুক্ত করে দিয়েছে, কারণ, সে অপূর্ণাঙ্গ মাখলুকের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলাকে তুলনা করেছে।