আল্লাহ তা‘আলার নান্দনিক নাম ও গুণসমগ্র: কিছু আদর্শিক নীতিমালা প্রথম অধ্যায়: আল্লাহর নাম বিষয়ক নীতিমালা ইসলামহাউজ.কম
ষষ্ঠ নীতিমালা: আল্লাহর নামসমূহ সুনির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমিত নয়

কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রসিদ্ধ একটি হাদীসে বলেছেন:

«أسألك بكل اسم هو لك، سميت به نفسك، أو أنزلته في كتابك، أو علمته أحداً من خلقك، أو استأثرت به في علم الغيب عندك»

‘হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে প্রত্যেক ওই নাম দ্বারা প্রার্থনা করছি যা আপনার, যে নাম আপনি নিজেকে দিয়েছেন, অথবা আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন, অথবা আপনি আপনার সৃষ্টিজীবের কাউকে শিখিয়েছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কাছে, আপনার গায়েবী ইলমে একান্তভাবে রেখে দিয়েছেন।’ হাদীসটি ইমাম আহমদ, ইবনে হিববান এবং ইমাম হাকেম বর্ণনা করেছেন আর হাদীসটি সহীহ।[1]

বলার অপেক্ষা রাখে না যে আল্লাহ তা‘আলা তার গায়েবী ইলমে যা একান্তভাবে রেখে দিয়েছেন তা কারও পক্ষেই হিসেব করে দেখা অথবা তা আয়ত্বে আনা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।

আর যে হাদীসটিতে আল্লাহ তা‘আলার নিরানব্বই নামের কথা এসেছে অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:

«إن لله تسعة وتسعين اسماً، مائة إلا واحداً، من أحصاها دخل الجنة»

‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলার নিরানব্বইটি, একটি বাদে একশটি, এমন নাম রয়েছে, যে ব্যক্তি তা ইহসা[2] (তথা যথাযথভাবে কার্যে পরিণত) করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’[3] এ হাদীসটি নিরানববই সংখ্যায় আল্লাহর নাম সীমিত হওয়াকে বুঝাচ্ছে না। যদি সীমিত হওয়া বুঝাত তবে হাদীসের ভাষ্য এমন হত: ‘নিশ্চয় আল্লাহর নাম নিরানব্বইটি, যে তা ইহসা করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ অথবা এ জাতীয় কোনো ভাষ্য।

তাহলে হাদীসের অর্থ হলো: এ সংখ্যার বাস্তবতা, যে ব্যক্তি এই সংখ্যায় আল্লাহর নামগুলোর বাস্তব অর্থ কাজে লাগাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতএব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ‘যে ব্যক্তি তা ইহসা (যথার্থভাবে কার্যে পরিণত) করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ এর পূর্ববর্তী বাক্যের পরিপূরক বাক্য। এটি কোনো স্বনির্ভর আলাদা বাক্য নয়। এর উদাহরণ হলো আপনি যদি বলেন: আমার কাছে একশ’ টাকা আছে যা আমি দান করার জন্য গণনা করে রেখেছি, তাহলে এ কথার অর্থ এটা নয় যে আপনার কাছে এ ছাড়া অন্য কোনো টাকা নেই। বরং এর অর্থ হলো আপনার কাছে আরো টাকা আছে, তবে দান করার জন্য একশ’ টাকা গণনা করে রেখেছেন।

এ নামগুলো কোন্ কোন্‌ নাম তা নির্ণয় করে সহীহ কোনো হাদীস বর্ণিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে নাম নির্দিষ্ট করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে হাদীসটি এসেছে তা দুর্বল।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. ‘আল ফাতাওয়া’ গ্রন্থে বলেন,‘এই নামগুলো সুনির্দিষ্ট করণের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কোনো বাণী উল্লিখিত হয়নি। এ ব্যাপারে হাদীস বিশেষজ্ঞদের ঐক্যমত্য রয়েছে।[4] ইমাম ইবনে তাইমিয়া এর পূর্বে বলেছেন, (নিরানব্বইটি নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে) তা আল ওয়ালীদ নামক এক বর্ণনাকারী তার শামদেশীয় একজন শায়খের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন। ইমাম ইবনে হাজার তার গ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’- তে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম ওয়ালীদ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটিকে পরিত্যাগ করেছেন। এ পরিত্যাগ করার কারণ শুধু এটা নয় যে, এ হাদীসটি ওয়ালীদ এককভাবে বর্ণনা করেছেন, বরং হাদীসটিতে মতদ্বৈততা ও অসঙ্গতি রয়েছে, হাদীসটিতে তাদলীস ও অন্য কারও বক্তব্য তাতে অনুপ্রবিষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।’[5]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুনির্দিষ্ট কোনো হাদীসে যেহেতু এ নিরানব্বইটি নাম উল্লেখ করেননি, তাই সালাফদের মধ্যে এ নামগুলো সুনির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে মতানৈক্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের থেকে নানামুখী বর্ণনা উল্লিখিত হয়েছে। যাই হোক, আমি কুরআন হাদীস ঘেঁটে আল্লাহ তা‘আলার নিরানব্বইটি নাম এখানে একত্র করেছি। নামগুলো আমি দু’ভাগে ভাগ করেছি। প্রথম ভাগ হলো কুরআন থেকে এবং দ্বিতীয় ভাগ হলো সুন্নাহ থেকে।

প্রথমত: কুরআন থেকে:

الإله

উপাস্য

الأكرم

অনেক সম্মানিত

الأعلى

অনেক উপরে

الأحد

একক

الله

আল্লাহ

البارئ

সঠিকভাবে সৃষ্টিকারী

الباطن

সর্বনিকটে অপ্রকাশিত

الظاهر

সবার উপরে প্রকাশিত

الآخر

সর্বশেষ

الأول

অনাদি

الحافظ

রক্ষাকারী

 

الجبار

দুর্নিবার

التواب

তাওবা কবুলকারী

البصير

সর্ববিষয় দর্শনকারী

البر

পরম উপকারী অনুগ্রহশীল

المبين

সুস্পষ্ট

 

الحق

পরম সত্য

الحفي

পুরোপরি অবহিত

الحفيظ

সংরক্ষণকারী

الحسيب

হিসাব গ্রহণকারী

القيوم

সবকিছুর ধারক ও সংরক্ষণকারী

الحي

চিরঞ্জীব

الحميد

الحليم

অত্যন্ত ধৈর্যলীল

الحكيم

الرحمن

পরম দয়ালু

الرءوف

পরম স্নেহশীল

الخلاق

সর্বস্রষ্টা

الخالق

সৃষ্টিকর্তা

الخبير

সকল ব্যাপারে অবহিত

السميع

সর্বশ্রোতা

 

السلام

শান্তি দানকারী

الرقيب

তত্বাধায়ক

الرزاق

রিযকদাতা

الرحيم

অতিশয় মেহেরবান

العالم

জ্ঞানী

 

الصمد

সর্ববিষয়ে পূর্ণতাপ্রাপ্ত

الشهيد

সর্বজ্ঞ সাক্ষী

الشكور

গুণগ্রাহী

الشاكر

যথার্থ পুরস্কারদাতা

الغفار

পরম ক্ষমাশীল

 

العلي

উচ্চ মর্যাদাশীল

العليم

সর্বজ্ঞ

 

العظيم

সর্বোচ্চ- মর্যাদাশীল

العزيز

মহাপরাক্রমশালী

القاهر

পরাক্রমশালী

القادر

মহা ক্ষমতাবান

الفتاح

বিজয় দানকারী

الغني

অমুখাপেক্ষী

الغفور

পরম ক্ষমাশীল

القهار

কঠোর

 

القوى

পরম শক্তির অধিকারী

القريب

অতি নিকবর্তী

القدير

প্রবল ক্ষমতাধর

القدوس

মহাপবিত্র

المتعالي

সৃষ্টির গুনাবলীর উর্দ্ধে

 

المؤمن

নিরাপত্তা ও ঈমান দানকারী

اللطيف

সুক্ষ্মদর্শী কৌশলী

الكريم

সুমহান দাতা

الكبير

সবচেয়ে বড়

المحي

জীবন দানকারী

المجيد

মর্যাদার অধিকার

المجيب

জবাব দানকারী

المتين

সুদৃঢ়

المتكبر

শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী

المليك

মালিক

 

الملك

সর্বকর্তৃত্বময়

المقيت

জীবনোপকরণ দানকারী

المقتدر

নিরঙ্কশ সিদ্বান্তের অধিকারী

المصور

আকৃতি দানকারী

الوارث

উত্তরাধিকারী

الواحد

এক ও অদ্বিতীয়

النصير

সাহায্যকারী

المهيمن

রক্ষণাবেক্ষণকারী

المولى

মহাপ্রভূ

الوهاب

মহাদাতা

 

الولي

অবিভাবক

الوكيل

কর্ম সম্পাদনকারী

الودود

সদয়

الواسع

পরিব্যাপ্ত

 

 

 

 

العفو

পরম উদার


দ্বিতীয়ত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ থেকে:

الرفيق

দয়াবান

الرب

প্রভূ

الحيي

চিরঞ্জীব

الحكم

মহাবিচারক

الجواد

মহাদাতা

الجميل

সুন্দর

الباسط

প্রশস্তকারী

সংকীর্ণকারী

الطيب

উত্তম পবিত্র

الشافي

আরোগ্যদানকারী

السيد

সর্দার

السبوح

পবিত্র-মহান

الوتر

বেজোড় একক

المنان

দানশীল

المعطي

মহাদাতা

المحسن

অনুগ্রহকারী

 

المؤخر

অবকাশ দানকারী

المقدم

অগ্রসরকারী


এ নামগুলো যথার্থভাবে ঘেঁটে নির্বাচন করেছি। কুরআনে কারীম থেকে ৮১টি আর সুন্নাতে রাসূল থেকে বাকী ১৮টি গ্রহণ করেছি। যদিও আমি ‘আল-হাফীয়্য’ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত। কারণ এ নামটি এককভাবে আসেনি, বরং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম থেকে শর্তযুক্ত ভাবে এসেছে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহ সম্পর্কে বলেছেন,

﴿إِنَّهُۥ كَانَ بِي حَفِيّٗا ٤٧ ﴾ [مريم: ٤٧]

“নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি খুবই অনুগ্রহশীল”। [সূরা মারইয়াম: ৪৭] অনুরূপভাবে ‘আল-মুহসিন’ নামটিও। কারণ তাবারানীতে বর্ণিত এ নামটির বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে আমি অবগত হতে পারি নি। তবে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ এটিকে আল্লাহর নাম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া আল্লাহর নামসমূহের কিছু রয়েছে অন্য শব্দের সাথে সন্ধন্ধযুক্ত হয়ে। যেমন, ‘মালিকাল মুলকি’ ‘যিল-জালালি ওয়াল ইকরামি’।

[1] বর্ণনায় আহমদ (১/৩৯১, ৪৫২); ইবনে হিববান হাদীস নং (২৩৭২); হাকেম (১/৫০৯), আলবানী এটিকে ‘ আল আহাদীসুস্সাহীহা’- তে উল্লেখ করেছেন।

[2] নামগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর অর্থ এ নামগুলোর শব্দমালা মুখস্ত করা, তার অর্থ বোঝা এবং তার দাবি অনুযায়ী আমল করা (লেখক)

[3] - বর্ণনায় বুখারী, তাওহদী অধ্যায়, অনুচ্ছেদ : নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার একটি কম একশটি নাম রয়েছে, হাদীস নং (৭৩৯২); মুসলিম, যিকির অধ্যায়, অনুচ্ছেদ : আল্লাহর নাম এবং যে তা গুণবে তার মর্যাদা, (২৬৭৭)।

[4] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৮৩

[5] - ইবনে হাজার আল আসকালানী, ফাতহুল বারী, খন্ড১১, পৃ. ২১৫