ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
রমযানের দায়িত্ব-কর্তব্য (ইবন রজব আল-হাম্বলী রহ. এর ‘লাতায়িফুল মা‘আরিফ’ অবলম্বনে) পরিচ্ছেদ: তারাবীহ ইসলামহাউজ.কম
তারাবীহ - ২

সাওম যে ব্যক্তিকে সমস্ত হারাম কাজ থেকে বিরত রেখেছে তার জন্য সাওম কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করবে এবং বলবে, হে আমার রব! আমি তাকে দিনের বেলায় প্রবৃত্তির কামনা থেকে বিরত রেখেছি, সুতরাং আমার শাফা‘আত গ্রহণ করুন। কিন্তু হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে যার সাওম নষ্ট হয়ে গেছে সাওম তার বিরুদ্ধে উল্টো অভিযোগ করবে এবং বলবে, হে আল্লাহ আমাকে যেভাবে ধ্বংস করেছে তুমিও তাকে সেভাবে ধ্বংস করুন।

কোন এক সৎপূর্বসূরী বলেছেন: কিয়ামতের দিন যখন মুমিনকে উপস্থিত করা হবে তখন আল্লাহ ফিরিশতাকে বলবেন, তার মাথার ঘ্রাণ দেখ। সে বলবে, তার মাথায় কুরআনের ঘ্রাণ পাচ্ছি। অতঃপর বলা হবে, তার ক্বলবের ঘ্রাণ দেখ। ফিরিশতা বলবে, তার ক্বলবে সিয়ামের ঘ্রাণ পাচ্ছি। আবার বলা হবে, তার পায়ের ঘ্রাণ নাও। সে বলবে, তার পায়ে রাত জেগে সালাতের ঘ্রাণ পাচ্ছি। তখন আল্লাহ বলবেন, সে (আমার বান্দা) নিজেকে হিফাযত করেছে, আল্লাহও তাকে হিফাযত করেছেন। এমনিভাবে কুরআন যাকে রাতে ঘুমানো থেকে বিরত রেখেছে কিয়ামতের দিনে তার জন্য শাফা‘আত করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করেছে এবং রাতের বেলায় সালাতে দাঁড়িয়ে কুরআন পড়েছে সে-ই যথার্থভাবে কুরআনের হক আদায় করেছে। ফলে কুরআন তার জন্য শাফা‘আত করবে। একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শুরাইহ আল-হাদরামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর আলোচনা হলো। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

« ذلك لَا يَتَوَسَّدُ الْقُرْآنَ».

“সে কুরআনকে বালিশ বানায় না (অর্থাৎ সে কুরআনের উপর ঘুমায় না যাতে তা বালিশের মতো হয়ে যায়, বরং সে কুরআন না পড়ে ঘুমায় না এবং যত্নের সঙ্গে রাত্রে কুরআন পড়ে থাকে)।”[1]

ইমাম আহমাদ বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণনা করেন,

«إِنَّ الْقُرْآنَ يَلْقَى صَاحِبَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حِينَ يَنْشَقُّ عَنْهُ قَبْرُهُ كَالرَّجُلِ الشَّاحِبِ. فَيَقُولُ لَهُ: هَلْ تَعْرِفُنِي؟ فَيَقُولُ: مَا أَعْرِفُكَ فَيَقُولُ: أَنَا صَاحِبُكَ الْقُرْآنُ الَّذِي أَظْمَأْتُكَ فِي الْهَوَاجِرِ وَأَسْهَرْتُ لَيْلَكَ، وَإِنَّ كُلَّ تَاجِرٍ مِنْ وَرَاءِ تِجَارَتِهِ، وَإِنَّكَ الْيَوْمَ مِنْ وَرَاءِ كُلِّ تِجَارَةٍ فَيُعْطَى الْمُلْكَ بِيَمِينِهِ، وَالْخُلْدَ بِشِمَالِهِ، وَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ تَاجُ الْوَقَارِ، وَيُكْسَى وَالِدَاهُ حُلَّتَيْنِ لَا يُقَوَّمُ لَهُمَا أَهْلُ الدُّنْيَا فَيَقُولَانِ: بِمَ كُسِينَا هَذَا؟ فَيُقَالُ: بِأَخْذِ وَلَدِكُمَا الْقُرْآنَ. ثُمَّ يُقَالُ لَهُ: اقْرَأْ وَاصْعَدْ فِي دَرَجِ الْجَنَّةِ وَغُرَفِهَا، فَهُوَ فِي صُعُودٍ مَا دَامَ يَقْرَأُ، هَذًّا كَانَ، أَوْ تَرْتِيلًا».

“কিয়ামতের দিন কুরআন ওয়ালা যখন সে কবর থেকে উত্থিত হবে তখন কুরআন তার সাথে ফ্যাকাশে রঙ্গ অবস্থায় মিলিত হয়ে বলবে, তুমি কি আমাকে চেন? সে বলবে, আমি তো আপনাকে চিনি না। তখন কুরআন বলবে, আমি তোমার সাথী কুরআন যে তোমাকে দিনের বেলায় (দ্বিপ্রহরে) তৃষ্ণার্ত রেখেছে এবং রাতের বেলায় জাগিয়ে রেখেছে। আজ প্রত্যেক ব্যক্তি তার পশ্চাতে পাঠানো ফলাফল পাবে। আজ তোমার ব্যবসার ফলাফল গ্রহণ করো। তখন তার ডানে রাজত্ব ও বামে জান্নাতুল খুলদ দেওয়া হবে। তার মাথায় সম্মানের মুকুট পরিয়ে দেওয়া হবে এবং তার পিতামাতাকে দু’টি চাদর পরিধান করানো হবে যার মূল্য দুনিয়াবাসীরা দিতে পারবে না। তারা বলবেন, আমাদেরকে কিসের বিনিময়ে এ চাদর পরিধান করা হলো? তাদেরকে বলা হবে, আপনাদের সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য। অতঃপর তাকে (কুরআনধারী) বলা হবে, তুমি কুরআন পড়তে থাকো আর জান্নাতের এক একটি স্তর ও রুমে উঠতে থাকো। সে যতক্ষণ কুরআন পড়তে থাকবে ততক্ষন উপরে উঠতে থাকবে, চাই সে দ্রুত তিলাওয়াত করুক বা তারতীলের সাথে ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করুক।”[2]

...

ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কুরআনের ধারক-বাহককে যেন রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তাকে বিশেষভাবে চেনা যায়, দিনে মানুষ যখন কর্মব্যস্ত থাকে তখন তাকে বিশেষভাবে চেনা যায়, মানুষ যখন বিভিন্ন কথাবার্তায় মগ্ন থাকে তখন তাকে চুপ থাকার কারণে চেনা যায়, মানুষ যখন খুশিতে মত্ত থাকে তখন তাকে চিন্তিত হওয়ার মাধ্যমে চেনা যায়।

উহাইব রহ. বলেন, এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি কেন ঘুমান না? সে বলল, কুরআনের বিস্ময় আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

একলোক তার বন্ধুর সাথে দুমাস একত্রে থাকল; কিন্তু তাকে কখনও ঘুমাতে দেখেনি। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাকে কখনও ঘুমাতে দেখি না কেন? তিনি বললেন, কুরআনের বিস্ময় আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কুরআনে এক বিস্ময় থেকে বের হলেই আরেক বিস্ময়ে পড়ে যাই (ফলে আর ঘুমাতে পারি না)।

আহমাদ ইবন আবিল-হাওয়ারী রহ. বলেন, আমি যখন কুরআন পড়ি তখন এক আয়াত এক আয়াত করে এতে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করি। তখন আমার জ্ঞান হয়রান হয়ে যায়। আমি কুরআনের হাফিযদের ব্যাপারে আশ্চর্য হয়ে যাই কিভাবে তাদের ঘুম আসে বা তারা কিভাবে দুনিয়ার কাজ-কর্মে ব্যস্ত হয়ে যায় অথচ তারা কুরআন তিলাওয়াত করে? তারা যদি কুরআন অনুধাবন করত, কুরআনের হক যথাযথ বুঝত, এর স্বাদ পেত এবং এর দ্বারা মুনাজাত করত তাহলে আল্লাহ তাদেরকে (কুরআন বুঝার) যে নি‘আমত দিয়েছেন সে আনন্দে ঘুম চলে যেত।

অন্যদিকে যার কাছে কুরআন আছে; কিন্তু সে কুরআন ছেড়ে রাতের বেলায় শুধু ঘুমিয়েছে এবং দিনের বেলায় কুরআন অনুযায়ী আমল করে নি, কিয়ামতের দিন কুরআন তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে এবং সে তার নষ্টকৃত অধিকার চাইবে।

ইমাম আহমাদ রহ. সামুরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখলেন,

«فَإِذَا رَجُلٌ مُسْتَلْقٍ عَلَى قَفَاهُ، وَرَجُلٌ قَائِمٌ بِيَدِهِ فِهْرٌ، أَوْ صَخْرَةٌ، فَيَشْدَخُ بِهَا رَأْسَهُ، فَيَتَدَهْدَى الْحَجَرُ، فَإِذَا ذَهَبَ لِيَأْخُذَهُ عَادَ رَأْسُهُ كَمَا كَانَ، فَيَصْنَعُ مِثْلَ ذَلِكَ، فَقُلْتُ: مَا هَذَا؟.... ، فَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الْقُرْآنَ، فَنَامَ عَنْهُ بِاللَّيْلِ، وَلَمْ يَعْمَلْ بِمَا فِيهِ بِالنَّهَارِ، فَهُوَ يُفْعَلُ بِهِ مَا رَأَيْتَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ».

“একলোক চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আর আরেক লোক হাতুড়ি বা পাথর দ্বারা তার মাথায় সজোরে আঘাত করছে, এতে পাথর তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। এভাবে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হলে আবার তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আনা হয়। এভাবে আবার আগের মতোই করা হয়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, এ ব্যক্তিকে আল্লাহ কুরআন দান করেছিলেন, কিন্তু সে কুরআন না পড়ে রাতে ঘুমিয়ে থাকত আর দিনের বেলায় সে অনুযায়ী আমল করত না। আপনি তাকে যেভাবে দেখেছেন সেভাবে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে শাস্তি দেওয়া হবে”।[3]

আমর ইবন শু‘আইব তার পিতা থেকে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«يُمَثَّلُ الْقُرْآنُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلًا، فَيُؤْتَى بِالرَّجُلِ قَدْ حَمَلَهُ فَخَالَفَ أَمْرَهُ، فَيَتَمَثَّلُ خَصْمًا لَهُ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ حَمَّلْتَهُ إِيَّايَ فَشَرُّ حَامِلٍ تَعَدَّى حُدُودِي، وَضَيَّعَ فَرَائِضِي، وَرَكِبَ مَعْصِيَتِي، وَتَرَكَ طَاعَتِي، فَمَا يَزَالُ يَقْذِفُ عَلَيْهِ بِالْحُجَجِ حَتَّى يُقَالَ: فَشَأْنُكَ بِهِ فَيَأْخُذُ بِيَدِهِ، فَمَا يُرْسِلُهُ حَتَّى يَكُبَّهُ عَلَى مَنْخِرِهِ فِي النَّارِ، وَيُؤْتَى بِرَجُلٍ صَالِحٍ قَدْ كَانَ حَمَلَهُ، وَحَفِظَ أَمْرَهُ، فَيَتَمَثَّلُ خَصْمًا لَهُ دُونَهُ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ حَمَّلْتَهُ إِيَّايَ فَخَيْرُ حَامِلٍ، حَفِظَ حُدُودِي، وَعَمِلَ بِفَرَائِضِي، وَاجْتَنَبَ مَعْصِيَتِي، وَاتَّبَعَ طَاعَتِي، فَمَا يَزَالُ يَقْذِفُ لَهُ بِالْحُجَجِ حَتَّى يُقَالَ: شَأْنُكَ بِهِ، فَيَأْخُذُ بِيَدِهِ فَمَا يُرْسِلُهُ حَتَّى يُلْبِسَهُ حُلَّةَ الْإِسْتَبْرَقِ، وَيَعْقِدَ عَلَيْهِ تَاجَ الْمُلْكِ، وَيَسْقِيَهُ كَأْسَ الْخَمْر».

“কিয়ামতের দিন কুরআনকে মানুষের আকৃতিতে ব্যক্তির সামনে উপস্থিত করা হবে। অতঃপর ঐ ব্যক্তির সামনে উপস্থিত করা হবে যে কুরআন শিক্ষা করে কুরআনের বিপরীত আমল করেছে। তখন তার প্রতিপক্ষ হয়ে কুরআন আল্লাহর কাছে বলবে, হে আমার রব! আপনি আমাকে অমুকের দ্বারা বহন করিয়েছেন; কিন্তু সে অত্যন্ত খারাপ বহনকারী ছিল। সে আমার সীমালঙ্ঘন করেছে, আমার ফরযসমূহ নষ্ট করেছে, আমার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছে, আমার আনুগত্য বাদ দিয়েছে। এভাবে সে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ দিতেই থাকবে। এমনকি তাকে (কুরআনকে) বলা হবে, তাহলে উক্ত কুরআন ধারণকারীর ফয়সালা তোমাকেই দিলাম। তখন কুরআন তার হাত ধরে টেনে নিয়ে নাকেসা খত দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। অন্যদিকে কুরআন ধারণকারী সৎ ব্যক্তির কাছে কুরআনকে উপস্থিত করা হবে যে কুরআনের আদেশ মান্য করেছে। তখন কুরআন তার পক্ষে সাক্ষী হয়ে বলবে, হে আমার রব! আপনি আমাকে এ ব্যক্তির মাধ্যমে ধারণ করিয়েছেন, সে উত্তম ধারণকারী ছিল। সে আমার সীমারেখা সংরক্ষণ করেছে, আমার ফরয অনুযায়ী আমল করেছে, আমার অবাধ্যতা থেকে বিরত থেকেছে, আমার অনুসরণ করেছে, এভাবে তার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে থাকবে, এমনকি তাকে (কুরআনকে) বলা হবে, তার সমস্ত ব্যাপার তোমার ওপর ন্যস্ত। তখন সে উক্ত কুরআন ধারণকারীর হাত ধরবে, তাকে জান্নাতের রেশমী কাপড় পরিধান করাবে, তার মাথায় রাজ-মুকুট পরিধান করাবে এবং তাকে মদের কাপ থেকে শরাব পান করাবে।”[4]

>
[1] সুনান নাসাঈ, হাদীস নং ১৭৮৩। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহুল ইসনাদ বলেছেন।

[2] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২২৯৫০। শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটির সনদকে মুতাবা‘আত ও শাওয়াহেদের ভিত্তিকে হাসান বলেছেন।

[3] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২০১৬৫, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে শাইখাইনের শর্তানুযায়ী সহীহ বলেছেন।

[4] মুসান্নাফ ইবন আবু শাইবা, হাদীস নং ৩০০৪৪; আল-মাতালিবুল ‘আলিয়্যাহ বিযাওয়ায়িদিল মাসানিদিস সামানিয়্যাহ, ইবন হাজার আসকালালী, ১৪/৩৮২, হাদীস নং ৩৪৯১, ইবন হাজার রহ. হাদীসের সনদটিকে হাসান বলেছেন।