তুমি কুরআনের দ্বারা উপকৃত হতে হলে কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণের সময় মনোনিবেশ করো, নিবিষ্টচিত্তে শ্রবণ করো এবং যিনি কুরআনে তোমাকে সম্বোধন করে তোমার সাথে কথা বলছেন সে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিতি অনুভব করো। কেননা কুরআন তোমার জন্য রাসূলের জবানে আল্লাহর সম্বোধন ও বার্তা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكۡرَىٰ لِمَن كَانَ لَهُۥ قَلۡبٌ أَوۡ أَلۡقَى ٱلسَّمۡعَ وَهُوَ شَهِيدٞ٣٧﴾ [ق: ٣٧]
“নিশ্চয় এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার রয়েছে অন্তর অথবা যে নিবিষ্টচিত্তে শ্রবণ করে।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] কুরআনের পূর্ণ প্রভাব (উপকার বা উপদেশ) লাভ করা যেহেতু প্রভাবকারী, প্রভাব বিস্তারের স্থান, প্রভাব লাভের শর্ত ও উপকার লাভ থেকে বাধামুক্ত হওয়ার ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু উপরোক্ত আয়াতে সংক্ষিপ্তসারে কিন্তু পূর্ণাঙ্গরূপে এসব কিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكۡرَىٰ﴾ [ق: ٣٧]
“নিশ্চয় এতে (কুরআনে) উপদেশ রয়েছে তার জন্য।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত অংশে কুরআনের প্রভাবের কথা বলা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বাণী,
﴿لِمَن كَانَ لَهُۥ قَلۡبٌ﴾ [ق: ٣٧]
“যার রয়েছে অন্তর।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] এটি প্রভাব (উপকার) গ্রহণের স্থান। এখানে ক্বলব দ্বারা জীবন্ত অন্তরকে বুঝানো হয়েছে, যে অন্তর আল্লাহকে চেনে ও জানে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿إِنۡ هُوَ إِلَّا ذِكۡرٞ وَقُرۡءَانٞ مُّبِينٞ ٦٩ لِّيُنذِرَ مَن كَانَ حَيّٗا٧٠﴾ [يس: ٦٩، ٧٠]
“এ তো কেবল এক উপদেশ ও স্পষ্ট কুরআন মাত্র। যাতে তা সতর্ক করতে পারে ঐ ব্যক্তিকে যে জীবিত।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৬৯-৭০] অর্থাৎ যার অন্তর জীবিত।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿أَوۡ أَلۡقَى ٱلسَّمۡعَ ٣٧﴾ [ق: ٣٧]
“অথবা যে নিবিষ্টচিত্তে শ্রবণ করে।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] অর্থাৎ সে শ্রবণে মনোনিবেশ করে এবং যা কিছু বলা হয় তা কান লাগিয়ে শোনে। কথা দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়ার এটি অন্যতম শর্ত।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿وَهُوَ شَهِيدٞ٣٧﴾ [ق: ٣٧]
“সে অন্তরসহ উপস্থিত।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] অর্থাৎ তার অন্তর সেখানে উপস্থিত, সে মনের দিকে অনুপস্থিত নয়।
ইবন কুতাইবা রহ. বলেছেন, “আল্লাহর কিতাব নিবিষ্টচিত্তে ও বুঝে-শুনে শ্রবণ করো, গাফিল ও অন্যমনস্ক হয়ে নয়। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কেউ গাফিল ও অমনোযোগী হয়ে তিলাওয়াত করলে তা কুরআনের উপকার অর্জনে বাধাদানকারী হয়ে যায়। কুরআনে তাকে যা বলা হয়েছে তা না বুঝে, এতে চিন্তা-গবেষণা না করে ভুলোমন ও অমনোযোগী হয়ে পড়লে কুরআন উপদেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকবে।
অতএব, প্রভাববিস্তারকারী (কুরআন) যখন প্রভাববিস্তারের স্থান (অর্থাৎ জীবন্ত অন্তর), প্রভাব বিস্তারের শর্ত (অর্থাৎ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ), প্রভাববিস্তারে বাধামুক্ত (তথা অন্তরকে কুরআনের সম্বোধন অনুধাবনে ব্যস্ত রাখা ও অন্য কাজ থেকে বিরত থাকা) সবকিছু একত্রে অর্জিত হলে কুরআনের প্রভাব তথা উপকার ও উপদেশ অর্জিত হবে।
এ সূরাতে ঈমানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলনীতি সন্নিবেশিত হয়েছে যা ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট এবং অন্য কিছু থেকে তাকে অমুখাপেক্ষী করে। কেননা এতে সৃষ্টির শুরু, পুনরুত্থান, তাওহীদ, নবুওয়াত, ফিরিশতাদের প্রতি ঈমান, মানুষকে সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগ্যবান দুদলে বিভক্ত করা এবং এ দু’দলের বিবরণ আলোচনা করা হয়েছে।
এতে দু’টি কিয়ামত তথা কিয়ামতে সুগরা (ছোট কিয়ামত তথা মৃত্যু) ও কিয়ামতে কুবরা (বড় কিয়ামত বা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান) এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
দুটি আলাম (জগতের) তথা বড় জগত বা আখিরাত ও ছোট জগত বা দুনিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মানব সৃষ্টি, তাদের মৃত্যু, পুনরুত্থান, মৃত্যুর সময় তাদের অবস্থা, হাশরের দিনের অবস্থা, সবকিছু সবদিক থেকে আল্লাহর বেষ্টনীতে; এমনকি তাদের অন্তরের ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) পর্যন্ত তাঁর জ্ঞাত থাকা, মানুষের ওপর রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করা, তারা যা কিছু বলে সব কিছুই সংরক্ষণ করে রাখা; আর কিয়ামতের দিন তিনি তাকে যথাযথ পুরস্কার প্রদান, সেদিন সে উপস্থিত হবে, তার সাথে থাকবে একজন চালক, যিনি তাকে আল্লাহর দিকে চালিয়ে নিয়ে যাবেন, আরও থাকবে একজন সাক্ষী, যিনি তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবেন। যখন তার চালক তাকে উপস্থিত করবে তখন সে বলবে,
﴿هَٰذَا مَا لَدَيَّ عَتِيدٌ٢٣﴾ [ق: ٢٣]
“এই তো আমার কাছে (আমল নামা) প্রস্তুত।” [সূরা কাফ, আয়াত: ২৩] অর্থাৎ এ আমলনামা প্রস্তুত করতে আমি আদিষ্ট ছিলাম, আজ আমি তা প্রস্তুত করেছি। আমলনামা উপস্থিত করলে তাকে বলা হবে,
﴿أَلۡقِيَا فِي جَهَنَّمَ كُلَّ كَفَّارٍ عَنِيدٖ٢٤﴾ [ق: ٢٤]
“তোমরা জাহান্নামে নিক্ষেপ করো প্রত্যেক উদ্ধত কাফিরকে।” [সূরা কাফ, আয়াত: ২৪] যেভাবে অপরাধীকে বাদশার সামনে উপস্থিত করে বলা হয়, অমুককে আমি তার কৃতকর্মসহ উপস্থিত করেছি, তখন বাদশা বলেন, তাকে জেলখানায় নিয়ে যাও এবং তার অপরাধ অনুযায়ী তাকে শাস্তি দাও।