ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
কবরের শাস্তি ও শান্তি সম্পর্কে কতিপয় মাসআলা বারযাখী জীবন কবরবাসীদের অবস্থার কিছু বিবরণ ইসলামহাউজ.কম
কবরবাসীদের অবস্থার কিছু বিবরণ

ইমাম বুখারী তার জামে সহীহ’তে কিতাবুত তা‘বীরে নকল করেছেন, সামুরা ইবন জুন্দুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে অধিকাংশ সময় যা বলতেন তা হলো, তোমাদের কেউ কি কোনো স্বপ্ন দেখেছ? অতঃপর তা বর্ণনা করে শুনাতেন। একদা ভোরে তিনি আমাদেরকে বললেন: গত রাত্রে দু’জন আগন্তুক আমার নিকট এসে আমাকে উপরে নিয়ে গেল (অর্থাৎ ঘুমের মধ্যে তাঁর নিকট দু’জন ফিরিশতা তাঁকে জাগালেন আর এটি এক প্রকার অহী, কেননা নবীদের স্বপ্ন হচ্ছে অহী যা সবারই জানা) অতঃপর সে দর্শনে যা দেখেছেন তা উল্লেখ করলেন।[1] আমাদের এ বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত কিছু অংশ এখন উল্লেখ করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় লোকদের কবরে শাস্তি থেকে যা দেখেছেন এর মধ্যে তাঁর কথা এই,

কাঁত হয়ে শায়িত এক ব্যক্তির নিকট আমি আসলাম, অন্য একজন লোক তার পার্শ্বে পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হঠাৎ দাড়ানো ব্যক্তি পাথর নিয়ে তার মাথার দিকে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে এবং পাথরটি বহু দূরে গিয়ে পড়ছে, আবার সেটি নিয়ে আসতে আসতে তার মাথা ভালো হয়ে যাচ্ছে। ফিরে এসে প্রথম বারের ন্যায় মারতে থাকে। পুরো হাদীসে এ ব্যক্তির অবস্থার বর্ণনা এসেছে যে, সে কুরআন পড়তো, অতঃপর তা প্রত্যাখ্যান করতো এবং ফরজ সালাত না পড়ে শুয়ে যেত।

এ প্রকার পাপ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَوَيۡلٞ لِّلۡمُصَلِّينَ ٤ ٱلَّذِينَ هُمۡ عَن صَلَاتِهِمۡ سَاهُونَ ٥﴾ [الماعون: ٤، ٥]

“ধ্বংস ঐসব মুসল্লির জন্য, যারা তাদের সালাতের ব্যাপারে উদাসীন।” [সূরা আল-মা‘উন, আয়াত: ৪-৫]

হাফেয ইবন কাসীর রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, (সা’হূন) হয় প্রথম ওয়াক্ত থেকে উদাসীন। তাই সে সর্বদা বা অধিকাংশ সময় শেষ ওয়াক্তে আদায় করতো অথবা সালাতের রোকন ও শর্তাবলী মেনে আদায় করে নি অথবা একাগ্রতাসহ এর অর্থ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা থেকে উদাসীন। সুতরাং এ শব্দটি উল্লিখিত ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; কিন্তু যদি কেউ এ আয়াতের গুণে গুণান্বিত হয় তবে সে তার প্রাপ্য পাবে, আবার যদি কেউ পুরো গুণে গুণান্বিত হয় সেও এর প্রাপ্য পাবে এবং তার মধ্যে নিফাকে আমলি পাওয়া যাবে।[2]

স্বপ্নের হাদীস যা সামুরা ইবন জুন্দুব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অতঃপর রক্তের ন্যায় লালচে একটি নদীর পাড়ে বসে দেখলাম একটি লোক তাতে সাঁতরাচ্ছে; অপর একজন লোক নদীর তীরে পাথর জমা করে পাশে রাখছে, যখনই সাঁতারু ব্যক্তি সাঁতরাতে সাঁতরাতে তার নিকট এসে মুখ হা করছে তখনই সে তার মুখে একটি পাথর ছুড়ে মারছে। অতঃপর সে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে, আবার ফিরে এসে হা করলে তার মুখে পাথর ছুড়ে মারছে। এভাবেই তার শাস্তি চলছে। পুরো হাদীসে এসেছে যে, রক্তের নদীতে সাঁতরানো ব্যক্তি একজন সূদখোর।

ইবন হুবাইরা রহ. বলেন, সূদখোরকে রক্তের নদীতে সাঁতার কাটিয়ে এবং পাথর খাওয়ানোর মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে। কেননা সূদের আসল স্বর্ণের উপর, আর স্বর্ণ হচ্ছে লাল। সুতরাং তাকে ফিরিশতাদের পাথর খাওয়ানো সেই দিকেই ইঙ্গিত করে যে, তার কোনো কিছুতে পেট ভরে নি। এমনিভাবে সূদ, কেননা সূদখোর মনে করে তার ধন সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে অথচ আল্লাহ তার পেছন থেকে তা কমিয়ে দিচ্ছেন।[3]

আর যদি সূদখোরের এ শাস্তি বারযাখে হয়, তবে সে কবর থেকে পূনরুত্থিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকবে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ ٱلرِّبَوٰاْ لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ ٱلَّذِي يَتَخَبَّطُهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ مِنَ ٱلۡمَسِّۚ﴾ [البقرة: ٢٧٥]

“যারা সূদ খায় তারা কিয়ামতে সেই ব্যক্তির ন্যায় দণ্ডায়মান হবে, যাকে শয়তান আছর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৭৫]

অর্থাৎ তারা তাদের কবর থেকে এভাবে উঠে দাঁড়াবে যেভাবে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি এবং শয়তানের আছর লাগা ব্যক্তি দাঁড়ায়। তা বলার কারণ হলো, সে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় দাঁড়াবে।

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, “সূদখোর ব্যক্তিকে পাগলপ্রায় গলাটিপা অবস্থায় তোলা হবে।”[4] কেউ কেউ বলেছেন, তাদেরকে এমন অবস্থায় উঠানো হবে যে, তাদের পেটগুলো গর্ভবতীর পেটের ন্যায় উঠানো থাকবে। যখন সে দাঁড়াবে তখনই পড়ে যাবে, মানুষ তাদের উপর দিয়ে হেটে যাবে। এটি শুধুমাত্র তাদের জন্য নিদর্শনস্বরূপ করা হয়েছে যেন এ নিদর্শনের মাধ্যমে কিয়ামতে তাদেরকে চেনা যায়। তারপর হবে তাদের শাস্তি।[5] কবরে সাজাপ্রাপ্ত লোকদের গুণাগুণের ব্যাপারে স্বপ্নের হাদীসে আরো যা এসেছে তা হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “অতঃপর আমরা চুলার ন্যায় একটি জিনিসের নিকট গেলাম, অন্য বর্ণনায় রয়েছে: যার উপরিভাগ চিকন এবং নিম্ন ভাগ প্রশস্ত, নিচে অগ্নি দাউদাউ করে জ্বলছে। তিনি বলেন, হঠাৎ এর মধ্যে কথোপকথনের আওয়াজ শুনে উকি দিলে সেখানে উলঙ্গ কিছু নর-নারী দেখতে পেলাম, তাদের নিচ থেকে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ আসলে তারা আর্তনাদ করছে। অর্থাৎ যন্ত্রনায় উচ্চস্বরে চিৎকার করছে। পুরো হাদীসে তাদের বর্ণনা এভাবে এসেছে যে, তারা হচ্ছে ব্যভিচারী নর-নারী।

হাফেয ইবন হাজার রহ. বলেন, তারা অপমানিত হওয়ার হকদার হিসেবে তাদের উলঙ্গ হওয়াটাই বাঞ্চনীয়। কেননা তাদের উচিৎ ছিলো নির্জনে পর্দা করা, কাজেই ছেড়া কাপড়ের দ্বারা তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আর তাদের নিচ থেকে ‘আযাব আসার হিকমত হলো তাদের নিম্নাংশ দ্বারাই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।[6]

প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর এ মহা অপরাধ, এর কারণসমূহ এবং যেসকল জিনিস এতে পতিত হওয়ায় সহযোগিতা করে যেমন: হারাম নির্জনতা এবং ফিতনার কারণগুলো অবলম্বন করা তথা বেপর্দা ও নারীর লোভনীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রকাশ করা, এমনিভাবে হারাম জিনিসের দিকে তাকানো, সেই সাথে যেসকল গান-বাজনা ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে ইত্যাদি কারণ ও পদ্ধতিগুলো থেকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করা ওয়াজিব।

কবরের সাজাপ্রাপ্ত আরো যাদেরকে তিনি দেখেছেন, তারা হলো এমন কতক লোক, যারা হারাম গীবত করে বেড়াতো। ইমাম আহমদ এবং আবূ দাঊদ কর্তৃক বর্ণিত হাদীস দ্বারা তা স্পষ্ট। আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন আমাকে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়া হয় তখন শিশার নোখ বিশিষ্ট কতক লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম কালে দেখলাম তাদের নোখ দ্বারা তাদের মুখমণ্ডল ও বুকে দংশন করছে।[7] আমি জিবরীল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কারা? তিনি বললেন, তারা ঐসকল লোক যারা মানুষের মাংস খেয়ে বেড়াতো (গীবত করতো) এবং তাদের মান সম্মান নষ্ট করতো।

পূর্বের আলোচনা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, যে সমস্ত অপরাধের দরুন কিছু লোকের শাস্তি হতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখেছেন, এখনো যারা এ ধরনের অপরাধে লিপ্ত হবে তাদের ওপরও একই শাস্তির ভয় রয়েছে। কাজেই তা থেকে সতর্ক থাকা একান্ত অবশ্যক। এখানে আরো কিছু নমুনা রয়েছে যা বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্ত, আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টি জীবের জন্য কবরবাসীদের ‘আযাব সম্পর্কে যা প্রকাশিত করেছেন তার কয়েকটি মাত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতা এবং সকল মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দকে তাঁর ক্ষমা ও রহমতের অন্তর্ভুক্ত করেন।

>
[1] সহীহ বুখারী, ফজরের সালাতের পর স্বপ্নের ব্যাখ্যা অধ্যায়, হাদীস নং ৭০৪৭।

[2] তাফসীর ইবন কাসীর ৪/৫৫৮।

[3] ফতহুল বারী ১২/৪৪৫।

[4] ইবন কাসীর ১/৩২৬।

[5] তাফসীর কুরতুবী ৩/৩৫৪।

[6] ফতহুল বারী ১২/৪৪৩।

[7] মুসনাদ ৩/২২৪ ও আবু দাউদ হাদীস নং ৪৮৭৯