মক্কা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্রতম ভূমি, তাতে রয়েছে আল্লাহর সম্মানিত ঘর ‘বাইতুল্লাহ’, আর তা আমাদের পিতা ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালামের দো‘আয় এক নিরাপদ ক্যাম্পাস বলে স্বীকৃত[1], আর তা এমন এক ভূখণ্ড, যাতে রক্তপাত করা যায় না[2]। তাঁর দো‘আ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানুষের জন্য তা এক নিরন্তর গন্তব্য হয়ে গেল এবং তার মেয়াদ কাল কিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হবে; আর তা ‘দাজ্জাল’-এর জন্য এক নিষিদ্ধ নগর এবং তার হামলা থেকে তা থাকবে সুরক্ষিত।[3]
আর তার মাটি কেন্দ্রিক কোনো দলীল-প্রমাণ বর্ণিত হয়নি এবং বর্ণিত হয়নি তার নির্দিষ্ট কোনো পবিত্রতার কথা, অথবা নির্দিষ্ট করা হয়নি সে মাটির বিশেষ ফযীলতের কথা, অনুরূপ একই কথা তার পাথর ও পাহাড়গুলোর ব্যাপারে।
বরং তার সম্মানের দিক থেকে এর গাছ, শিকার ও কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসের ব্যাপারে একাধিক হাদীস বর্ণিত আছে।
কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইযখির ব্যতীত তার গাছ কর্তন করাকে নিষেধ করেছেন; আরও নিষেধ করেছেন তার শিকারকে উত্যক্ত করা থেকে এবং তার পথে পড়ে থাকা বস্তু কুড়িয়ে নেওয়াকেও নিষেধ করেছেন, তবে সে ব্যক্তির জন্য উঠিয়ে নেওয়াটা বৈধ হবে, যে তা ঘোষণা বা প্রচার করবে।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন বলেছেন:
«إِنَّ هَذَا الْبَلَدَ حَرَّمَهُ اللَّهُ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ، فَهُوَ حَرَامٌ بِحُرْمَةِ اللَّهِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَإِنَّهُ لَمْ يَحِلَّ الْقِتَالُ فِيهِ لِأَحَدٍ قَبْلِي، وَلَمْ يَحِلَّ لِي إِلا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ، فَهُوَ حَرَامٌ بِحُرْمَةِ اللَّهِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لا يُعْضَدُ شَوْكُهُ، وَلا يُنْفَرُ صَيْدُهُ، وَلا يَلْتَقِطُ لُقَطَتَهُ إِلا مَنْ عَرَّفَهَا، وَلا يُخْتَلَى خَلاهُ، فَقَالَ الْعَبَّاسُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِلا الإِذْخِرَ، فَإِنَّهُ لَقَيْنِهِمْ وَلِبُيُوتِهِمْ ؟ قَالَ : إِلا الإِذْخِرَ».
“এ নগরীকে আল্লাহ তা‘আলা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে সম্মানিত করেছেন; কাজেই তা আল্লাহ প্রদত্ত সম্মানের দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানিত থাকবে। আর আমার আগে এখানে যুদ্ধ করা কারও জন্য হালাল ছিল না, আর আমার জন্যও তা দিনের মাত্র কিছু সময়ের জন্য হালাল করা হয়েছিল। অতএব, আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সম্মানের দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত তা সম্মানিত থাকবে। এখানকার কাঁটাযুক্ত গাছও কর্তন করা যাবে না, শিকারকে উত্যক্ত করা যাবে না এবং তার পথে পড়ে থাকা বস্তু কেউ উঠাবে না, তবে সে ব্যক্তি উঠাতে পারবে, যে তা ঘোষণা বা প্রচার করবে; এখানকার ঘাস কাটা যাবে না।’ তখন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! ইযখির ব্যতীত। কেননা তা কর্মকারের ও ঘরের কাজে লাগে।’ তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘ইযখির ব্যতীত।”[4]
আর যে ব্যক্তি এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসের বক্তব্যগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, সে দেখতে পাবে যে, তার গাছ-গাছালির মধ্যে জনগণ কর্তৃক চাওয়া ও পাওয়ার মত কেনো বরকত আছে বলে কোনো দূরতম বা নিকটতম ইঙ্গিত বা নির্দেশনা নেই; সুতরাং কিভাবে এর গাছপালা কর্তন করা হবে যা শরী‘আতের বক্তব্যের পরিপন্থী? আর কিভাবে বৈধ হবে তা নিয়ে ‘হারাম’-এর বাইরে গিয়ে জনগণ কর্তৃক তার দ্বারা শরীরে মাসেহ করা এবং বরকত হাসিলের চেষ্টা করা? আর তার গাছপালার ব্যাপারে যে কথা, ঠিক একই কথা তার মাটি ও পাথরের ব্যাপারে।
আর এ অবস্থা যদি হয় তার মাটি, গাছপালা ও পাথরের ব্যাপারে, তাহলে আরও ভালোভাবেই একই বিধান প্রযোজ্য হবে তার পণ্যদ্রব্য ও তার বাইরের দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যদ্রব্যের ব্যাপারে। কারণ, কোনো কোনো হাজী সাহেব হজ থেকে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট ফিরে আসার সময় তাদের জন্য হাদিয়া (উপহার) নিয়ে আসেন, যেমন- তাসবীহ ও অনুরূপ কিছু; আর এসব হাদিয়া মক্কা থেকে হওয়ার কারণে সেগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করে থাকেন।
সম্মানিত শাইখ মুহাম্মাদ আল-‘উসাইমীন রহ. কে এ প্রশ্নটি করা হয়:
‘মক্কা’ অথবা ‘কা‘বা’-এর পাথর অথবা নিদর্শনসমূহের দ্বারা বরকত অর্জনের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে কি?
জবাব হিসেবে তিনি বলেন, (মক্কার গাছে বা পাথরে এমন কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই যে, মানুষ তার গাছপালা ও পাথর দ্বারা বরকত হাসিল করতে পারে; বরং মক্কার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার কাঁটাযুক্ত গাছ কর্তন করা যাবে না এবং তার ঘাস ও তৃণলতা কাটা যাবে না; কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা নিষেধ করেছেন; তবে ‘ইযখির’ নামক ঘাসের বিষয়টি ব্যতিক্রম। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রেখেছেন। কেননা তা ঘরবাড়ি ও কর্মকারের কাজের জন্য প্রয়োজন হয়, আর অনুরূপভাবে ‘লাহাদ’ জাতীয় কবরের জন্যও তা প্রয়োজন হয়। কেননা তার দ্বারা ইটের ফাটল বা ফাঁকসমূহ বন্ধ করা হয়। আর এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি যে, ‘হারাম শরীফ’ অথবা ‘মক্কা’ এর পাথরের মধ্যে এমন কিছু নেই, যার দ্বারা বরকত হাসিল করা যায়- স্পর্শ করার দ্বারা হউক, অথবা নিজ দেশে নিয়ে আসার মাধ্যমে হউক, অথবা এ জাতীয় যে কোনোভাবেই হউক)।[5]
>[2] দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৫৪। আর সামান্য পরেই হাদীসের বক্তব্য আসছে, যাতে থাকবে সেখানে মারামারি ও হত্যা-সন্ত্রাস নিষিদ্ধের কথা।
[3] দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৮২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৪৩; মুসনাদ ইমাম আহমাদ, হাদীস নং ১২৯৮৬।
[4] হাদীসটি ‘মারফু’ সনদে আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৭৩৭; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৩৫৩। হাদীসের শব্দগুলো তাদের উভয়ের। আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ২০১৮; নাসাঈ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৮৭৪।
[5] দেখুন: শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-‘উসাইমীন, ‘দলীল আল-আখতায়ে আল্লাতি ইয়াকা‘উ ফীহা আল-হাজ ওয়াল মু‘তামের’: (পৃ. ৪৪)।