প্রত্যেক দাঈকে চারটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়, তা নিম্নরূপ:
১। দা‘ওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়: এ পর্যায়ে দাঈ আল্লাহর দিকে মানুষকে দা‘ওয়াত দেয়। তারা নিজের জীবন, ধন-সম্পদ, সময়, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, পরিবার-পরিজন, দেশ সব কিছুকে দা‘ওয়াতী কাজে উৎসর্গ করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
(وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا) .. [العنكبوت: 69]
‘আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব’ (সূরা আল-আনকাবূত: ৬৯)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(لَكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَأُولَئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (88) أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (89)) ... [التوبة: 88 - 89]
‘কিন্তু রাসূল ও তার সাথে মুমিনরা তাদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ করে, আর সে সব লোকদের জন্যই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ এবং তারাই সফলকাম। (৮৮) আল্লাহ তাদের জন্য তৈরি করেছেন জান্নাতসমূহ যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নহরসমূহ, তাতে তারা চিরদিন থাকবে, এটিই মহা সফলতা’(সূরা আত-তাওবা:৮৮-৮৯)।
২। প্রশিক্ষণ পর্যায়: এ পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলা দাঈকে পরীক্ষা করেন, যাতে তার কল্যাণ হবে, তা তাকে শিক্ষা দেন যাতে তিনি তার ধৈর্যও সত্যবাদিতা যাচাই করতে পারেন এবং তার নিকট কঠিন পরিস্থিতি বরণ, সৃষ্টির প্রতি দয়া এবং হক্বের (আল্লাহর) উপর পূর্ণ আত্মসমপর্ণের প্রস্ত্ততি তৈরী হয়। সেজন্য, ভাল-মন্দ, সচ্ছলতা, অভাব-অনটন, নিরাপত্তা এবং ভয় ইত্যাদি দিয়েতাকে পরীক্ষা করা হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ (2) وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ (3)) .. [العنكبوت: 2 - 3]
‘মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? (২) আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যে, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী’(সূরা আল-আনকাবূত: ২-৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ (35)) [الأنبياء:35]
‘আর ভাল ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে’ (সূরা আল-আম্বিয়া: ৩৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ (155) الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (156) أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ (157)) [البقرة: 155 - 157]
‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। (১৫৫) যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে, বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। (১৫৬)তাদের উপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৫৫-১৫৭)।
৩। সাহায্য প্রাপ্তির পর্যায়ঃ
দাঈ যখন পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করে এবং কঠিন পরিস্থিতি, কম সাহায্যকারী ও বেশি সম্পদ পেয়েও দা‘ওয়াতী কাজ করে যায়, তখনই আল্লাহ তাকে শক্তি দেন এবং সাহায্য করেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বিপদাপদ দূর করেন এবং শত্রুকে পরাস্ত করে তাকে রক্ষা করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِلَّا تَنْصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ (40)) [التوبة: 40].
‘যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন, যখন কাফেররা তাকে বের করে দিল, তিনি ছিলেন দু’জনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিলেন, তিনি তার সঙ্গীকে বললেন, তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার উপর তাঁর পক্ষ হতে প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাকে এমন এক সৈন্য বাহিনী দ্বারা সাহায্য করলেন, যাদেরকে তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের বাণী অতি নীচু করে দিলেন। আর আল্লাহর বাণীই সুউচ্চ। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান’ (সূরা আত-তাওবা: ৪০)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(حَتَّى إِذَا اسْتَيْأَسَ الرُّسُلُ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ قَدْ كُذِبُوا جَاءَهُمْ نَصْرُنَا فَنُجِّيَ مَنْ نَشَاءُ وَلَا يُرَدُّ بَأْسُنَا عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِينَ (110)) [يوسف: 110].
‘অবশেষে যখন রাসূলগণ (কওমের ঈমান থেকে) নিরাশ হয়ে গেলেন এবং তারা মনে করলেন, তাদের সাথে মিথ্যা বলা হয়েছে, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য আসল, অতঃপর আমি যাকে ইচ্ছা নাজাত দেই, আর অপরাধী কওম থেকে আমার আযাব কখনও ফেরানো হয় না’(সূরা ইউসূফ: ১১০)।
৪। কর্তৃত্ব, রাজত্ব ও সম্মান প্রাপ্তির পর্যায়: দাঈ যখন দা‘ওয়াত দিবে, আল্লাহর ইবাদত করবে, আল্লাহর জন্যই সবকিছুকে বরণ করে নিবে, এবং আল্লাহর কালিমা সুউচ্চকরণে নিজের সবকিছু ব্যয় করবে, তখন আল্লাহ তাকে যমীনে কর্তৃত্ব দান করবেন, দুনিয়ায় সম্মানিত করবেন এবং পরকালে জান্নাতে প্রবিষ্ট করাবেন। উল্লেখ্য যে, এ পর্যায়টি সংঘটিত হয়ে থাকে হয় নবী-রাসূল কর্তৃক, না হয় নবী-রাসূলের উত্তরাধিকারী কর্তৃক।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (40) الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْاعَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ) [الحج: 40 - 41]
‘আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। (৪০)তারা এমন, যাদেরকে আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে তারা ছালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ হতে নিষেধ করবে; আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহরই অধিকারে’(সূরা আল-হজ্জ:৪০-৪১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ) [النور: 55]
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে যমীনের প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতি শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা আমারই ইবাদত করবে, আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপর যারা কুফরী করবে, তারাই ফাসিক’ (সূরা আন-নূর: ৫৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ) [التوبة: 100]
‘আর মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যে যারা অগ্রগামী ও প্রথম এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। তারা সেখানে স্থায়ী থাকবে। এটাই মহাসাফল্য’ (সূরা আত-তাওবা: ১০০)।