(ক) ফরয ব্যতীত সকল ছালাতই নফল বা অতিরিক্ত। তবে যেসব নফল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিয়মিত পড়তেন বা পড়তে তাকীদ করতেন, সেগুলিকে ফিক্বহী পরিভাষায় ‘সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ’ বা ‘সুন্নাতে রাতেবাহ’ বলা হয়। যেমন ফরয ছালাত সমূহের আগে-পিছের সুন্নাত সমূহ। এই সুন্নাতগুলি কবাযা হ’লে তা আদায় করতে হয়। যেমন যোহরের প্রথম দু’রাক‘আত বা চার রাক‘আত সুন্নাত ক্বাযা হ’লে তা যোহর ছালাত আদায়ের পরে পড়তে হয় এবং ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত ক্বাযা হ’লে তা ফজরের ছালাতের পরেই পড়তে হয়। [221] এজন্য তাকে বেলা ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়না।
২য় প্রকার সুন্নাত হ’ল ‘গায়ের মুওয়াক্কাদাহ’, যা আদায় করা সুন্নাত এবং যা করলে নেকী আছে, কিন্তু তাকীদ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘দুই আযানের মধ্যে’ অর্থাৎ আযান ও এক্বামতের মাঝে ছালাত রয়েছে (২ বার)। তৃতীয়বারে বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে’।[222] যেমন আছরের পূর্বে দুই বা চার রাক‘আত সুন্নাত, মাগরিব ও এশার পূর্বে দু’রাক‘আত সুন্নাত।[223] তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাগরিবের ব্যাপারে বিশেষভাবে বলেন, ‘তোমরা মাগরিবের ছালাতের পূর্বে দু’রাক‘আত পড় (২ বার)। তৃতীয়বারে বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে’। [224]
এর দ্বারা নফল ছালাতের নেকী যেমন পাওয়া যায়, তেমনি মুছল্লী বৃদ্ধি পায়। যাতে জামা‘আতের নেকী বেশী হয়। [225]
(খ) ফরয ও সুন্নাতের জন্য স্থান পরিবর্তন ও কিছুক্ষণ দেরী করে উভয় ছালাতের মাঝে পাথর্ক্য করা উচিৎ।[226]
(গ) সুন্নাত বা নফল ছালাত সমূহ মসজিদের চেয়ে বাড়ীতে পড়া উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, বাড়ীতে নফল ছালাত অধিক উত্তম আমার এই মসজিদে ছালাত আদায়ের চাইতে; ফরয ছালাত ব্যতীত’।[227] অন্য হাদীছে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের বাড়ীতে কিছু ছালাত (অর্থাৎ সুন্নাত-নফল) আদায় কর এবং ওটাকে কবরে পরিণত করো না’।[228]
ইমাম নববী বলেন, বাড়ীতে নফল ছালাত আদায়ে উৎসাহ দানের উদ্দেশ্য এটা হ’তে পারে যে, সেটা গোপনে হয় এবং ‘রিয়া’ মুক্ত হয়, বাড়ীতে বরকত হয়, আল্লাহর রহমত এবং ফেরেশতা মন্ডলী নাযিল হয় ও শয়তান পালিয়ে যায়।[229]
(ঘ) সাধারণ নফল ছালাতের জন্য কোন রাক‘আত নির্দিষ্ট নেই; যত খুশী পড়া যায়।[230] তবে রাতের বিশেষ নফল অর্থাৎ তারাবীহ বা তাহাজ্জুদের ছালাত আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ১১ রাক‘আতের ঊর্ধ্বে পড়েননি।[231]
(ঙ) একই নফল ছালাত কিছু অংশ দাঁড়িয়ে ও কিছু অংশ বসে পড়া যায়।[232]
(চ) ফজরের সুন্নাত পড়ার পরে ডান কাতে স্বল্পক্ষণ শুতে হয়।[233]
সুন্নাত ও নফলের ফযীলত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
مَنْ صَلَّى فِىْ يَوْمٍ وَ لَيْلَةٍ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً بُنِيَ لَهُ بَيْتٌ فِى الْجَنَّةِ، أَرْبَعًا قَبْلَ الظُّهْرِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَهَا وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْمَغْرِبِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْعِشَاءِ وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ صَلاَةِ الْفَجْرِ، رواهُ الترمذىُّ ومسلمٌ عن أم حبيبةَ (رض)-
(১) ‘যে ব্যক্তি দিবারাত্রিতে ১২ রাক‘আত ছালাত আদায় করে, তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করা হবে। যোহরের পূর্বে চার, পরে দুই, মাগরিবের পরে দুই, এশার পরে দুই ও ফজরের পূর্বে দুই’।[234] ইবনে ওমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে যোহরের পূর্বে দু‘রাক‘আত সহ সর্বমোট দশ রাক‘আতের নিয়মিত আমলের কথা এসেছে।[235]
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
... فَإِنِ انْتَقَصَ مِنْ فَرِيْضَتِهِ شَيْءٌ قَالَ الرَّبُّ عَزَّ وَجَلَّ انْظُرُوْا هَلْ لِعَبْدِي مِنْ تَطَوُّعٍ فَيُكَمَّلَ بِهَا مَا انْتَقَصَ مِنَ الْفَرِيضَةِ ثُمَّ يَكُوْنُ سَائِرُ عَمَلِهِ عَلَى ذَلِكَ-
... ‘ক্বিয়ামতের দিন (মীযানের পাল্লায়) ফরয ইবাদতের কমতি হ’লে প্রতিপালক আল্লাহ বলবেন, দেখ আমার বান্দার কোন নফল ইবাদত আছে কি-না। তখন নফল দিয়ে তার ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর তার অন্যান্য সকল আমল সম্পর্কেও অনুরূপ করা হবে’ (যেমন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদিতে)। [236]
তিনি বলেন, তোমরা অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রির ন্যায় ঘনঘোর ফিৎনা সমূহে পতিত হবার আগেই নেক আমল সমূহের প্রতি দ্রুত ধাবিত হও। যখন লোকেরা মুমিন অবস্থায় সকালে উঠবে ও কাফের অবস্থায় সন্ধ্যা করবে এবং মুমিন অবস্থায় সন্ধ্যা করবে ও কাফির অবস্থায় সকালে উঠবে। সে দুনিয়াবী স্বার্থের বিনিময়ে তার দ্বীনকে বিক্রি করবে’। [237] অর্থাৎ চারিদিকে অন্যায় ছেয়ে যাবে। সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর হবে। নেক কাজের পথও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন আজকাল শিরক ও বিদ‘আতযুক্ত আমলকে নেক আমল বলা হচ্ছে। পক্ষান্তরে ছহীহ সুন্নাহভিত্তিক আমলকে বাতিল বলা হচ্ছে।
(৩) খাদেম রবী‘আহ বিন কা‘ব একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দাবী করেন যে, আমি আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি বেশী বেশী সিজদার মাধ্যমে আমাকে সাহায্য কর’। অনুরূপ একটি প্রশ্নে আরেক খাদেম ছাওবানকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তুমি অধিকহারে সিজদা কর। কেননা আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রতিটি সিজদার মাধ্যমে আল্লাহ তোমার সম্মানের স্তর একটি করে বৃদ্ধি করবেন ও তোমার থেকে একটি করে গোনাহ দূর করে দিবেন। [238]
[222] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৬২ ‘আযানের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৫।
[223] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১১৭১-৭২; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুসলিম, মিশকাত হা/১১৬৫, ১১৭৯-৮০; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৬২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪২-৪৩।
[224] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৬৫ ‘সুন্নাত সমূহ ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০।
[225] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১০৬৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘জামা‘আত ও উহার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-২৩।
[226] . আবুদাঊদ হা/১০০৬, ‘ফরয ছালাতের স্থানে নফল আদায়কারী মুছল্লী সম্পর্কে’ অনুচ্ছেদ-১৯৫।
[227] . আবুদাঊদ হা/১০৪৪; মিশকাত হা/১৩০০ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-৩৭।
[228] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭১৪, ১২৯৫, অনুচ্ছেদ-৭ ও ১৭; আবুদাঊদ হা/১০৪৩।
[229] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৩৬ পৃঃ।
[230] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৩৭ পৃঃ; ইরওয়া হা/৪৫৭, ২/২০৯ পৃঃ; আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইরওয়া হা/৪৬৯-৭০।
[231] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ইরওয়া ২/১৯১ পৃঃ।
[232] . মুসলিম, সুনান, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৩৭ পৃঃ।
[233] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১১৮৮, ১২০৬ ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১; মির‘আত ৪/১৬৮, ১৯১ পৃঃ।
[234] . তিরমিযী, মুসলিম, মিশকাত হা/১১৫৯ ‘সুন্নাত সমূহ ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০।
[235] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৬০; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৪০-৪১ পৃঃ।
[236] . আবুদাঊদ হা/৮৬৪-৬৬; তিরমিযী, নাসাঈ, আহমাদ, মিশকাত হা/১৩৩০, ‘ছালাতুত তাসবীহ’ অনুচ্ছেদ-৪০।
[237] . মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩৮৩ ‘ফিৎনা সমূহ’ অধ্যায়-২৭, পরিচ্ছেদ-১।
[238] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮৯৬-৯৭, ‘সিজদার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-১৪।