ইচ্ছাকৃতভাবে ছালাত তরককারী অথবা ছালাতের ফরযিয়াতকে অস্বীকারকারী ব্যক্তি কাফির ও জাহান্নামী। ঐ ব্যক্তি ইসলাম হ’তে বহিষ্কৃত। কিন্তু যে ব্যক্তি ঈমান রাখে, অথচ অলসতা ও ব্যস্ততার অজুহাতে ছালাত তরক করে কিংবা উদাসীনভাবে ছালাত আদায় করে ও তার প্রকৃত হেফাযত করে না, সে ব্যক্তি সম্পর্কে শরী‘আতের বিধান সমূহ নিম্নরূপ :
(ক) আল্লাহ বলেন, فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّيْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلاَتِهِمْ سَاهُوْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ يُرَآءُوْنَ... ‘অতঃপর দুর্ভোগ ঐ সব মুছল্লীর জন্য’ ‘যারা তাদের ছালাত থেকে উদাসীন’। ‘যারা তা লোকদেরকে দেখায়’... (মা‘ঊন ১০৭/৪-৬)।
(খ) অলস ও লোক দেখানো মুছল্লীদের আল্লাহ মুনাফিক ও প্রতারক বলেছেন। যেমন তিনি বলেন,
إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ يُخَادِعُوْنَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوْا إِلَى الصَّلاَةِ قَامُوْا كُسَالَى يُرَآءُوْنَ النَّاسَ وَلاَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ إِلاَّ قَلِيلاً 142
‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা প্রতারণা করে আল্লাহর সাথে। অথচ তিনি তাদেরকেই ধোঁকায় নিক্ষেপ করেন। তারা যখন ছালাতে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায় লোক দেখানোর জন্য। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)। অন্যত্র আল্লাহ তাদের ‘ফাসেক্ব’ (পাপাচারী) বলেছেন এবং বলেছেন যে, ‘তিনি তাদের ছালাত ও অর্থ ব্যয় কিছুই কবুল করবেন না’ (তওবা ৯/৫৩-৫৪)।
(গ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,... ‘যে ব্যক্তি ছালাতের হেফাযত করল না ...সে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন ক্বারূণ, ফেরাঊন, হামান ও উবাই বিন খালাফের সঙ্গে থাকবে’।[24]
ছালাতের হেফাযত করা অর্থ রুকূ-সিজদা ইত্যাদি ফরয ও সুন্নাত সমূহ সঠিকভাবে ও গভীর মনোযোগ সহকারে আদায় করা। [25] উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১ হিঃ) বলেন, (১) যে ব্যক্তি অর্থ-সম্পদের মোহে ছালাত হ’তে দূরে থাকে, তার হাশর হবে মূসা (আঃ)-এর চাচাত ভাই বখীল ধনকুবের ক্বারূণ-এর সাথে। (২) রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক ব্যস্ততার অজুহাতে যে ব্যক্তি ছালাত হ’তে গাফেল থাকে, তার হাশর হবে মিসরের অত্যাচারী শাসক ফেরাঊনের সাথে। (৩) মন্ত্রীত্ব বা চাকুরীগত কারণে যে ব্যক্তি ছালাত হ’তে গাফেল থাকে, তার হাশর হবে ফেরাঊনের প্রধানমন্ত্রী হামান-এর সাথে। (৪) ব্যবসায়িক ব্যস্ততার অজুহাতে যে ব্যক্তি গাফেল থাকে, তার হাশর হবে মক্কার কাফের ব্যবসায়ী নেতা উবাই বিন খালাফের সাথে।[26] বলা বাহুল্য ক্বিয়ামতের দিন কাফের নেতাদের সাথে হাশর হওয়ার অর্থই হ’ল জাহান্নামবাসী হওয়া। যদিও সে দুনিয়াতে একজন মুছল্লী ছিল। অতএব শুধু ছালাত তরক করা নয় বরং ছালাতের হেফাযত বা রুকূ-সিজদা সঠিকভাবে আদায় না হ’লেও জাহান্নামী হ’তে হবে। (আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। আমীন!)।
(ঘ) ছালাত তরক করাকে হাদীছে ‘কুফরী’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[27] ছাহাবায়ে কেরামও একে ‘কুফরী’ হিসাবে গণ্য করতেন।[28] তারা নিঃসন্দেহে জাহান্নামী। তবে এই ব্যক্তিগণ যদি খালেছ অন্তরে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী হয় এবং ইসলামের হালাল-হারাম ও ফরয-ওয়াজিব সমূহের অস্বীকারকারী না হয় এবং শিরক না করে, তাহ’লে তারা ‘কালেমায়ে শাহাদাত’কে অস্বীকারকারী কাফিরগণের ন্যায় ইসলাম থেকে খারিজ নয় বা চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। কেননা এই প্রকারের মুসলমানেরা কর্মগতভাবে কাফির হ’লেও বিশ্বাসগতভাবে কাফির নয়। বরং খালেছ অন্তরে পাঠ করা কালেমার বরকতে এবং কবীরা গোনাহগারদের জন্য শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শাফা‘আতের ফলে শেষ পর্যায়ে এক সময় তারা জান্নাতে ফিরে আসবে।[29] তবে তারা সেখানে ‘জাহান্নামী’ (اَلْجَهَنَّمِيُّوْنَ) বলেই অভিহিত হবে। [30] যেটা হবে বড়ই লজ্জাকর বিষয়।
(ঙ) বিভিন্ন হাদীছের আলোকে আহলেসুন্নাত বিদ্বানগণের মধ্যে ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ), ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ) এবং প্রাথমিক ও পরবর্তী যুগের প্রায় সকল বিদ্বান এই মর্মে একমত হয়েছেন যে, ঐ ব্যক্তি ‘ফাসিক্ব্’ এবং তাকে তওবা করতে হবে। যদি সে তওবা করে ছালাত আদায় শুরু না করে, তবে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০হিঃ) বলেন, তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং ছালাত আদায় না করা পর্যন্ত জেলখানায় আবদ্ধ রাখতে হবে। [31] ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) বলেন, ঐ ব্যক্তিকে ছালাতের জন্য ডাকার পরেও যদি সে ইনকার করে ও বলে যে ‘আমি ছালাত আদায় করব না’ এবং এইভাবে ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়, তখন তাকে কতল করা ওয়াজিব।[32] অবশ্য এরূপ শাস্তিদানের দায়িত্ব হ’ল ইসলামী সরকারের। ঐ ব্যক্তির জানাযা মসজিদের ইমাম বা বড় কোন বুযর্গ আলেম দিয়ে পড়ানো যাবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গণীমতের মালের (আনুমানিক দুই দিরহাম মূল্যের) তুচ্ছ বস্ত্তর খেয়ানতকারী এবং আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়েননি বরং অন্যকে পড়তে বলেছেন। [33] এক্ষণে আল্লাহ্কৃত ফরয ছালাতের সঙ্গে খেয়ানতকারী ব্যক্তির সাথে মুমিন সমাজের আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ, তা সহজেই অনুমেয়।
[25] . মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাছাবীহ (দিল্লী: তাবি) ২/১১৮ পৃঃ।
[26] . ইবনুল ক্বাইয়িম, ‘আছ-ছালাত ওয়া হুক্মু তারিকিহা’ (বৈরূত : দার ইবনু হযম, ১ম সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬), পৃঃ ৬৩; সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো : ১৪১২/১৯৯২), ১/৭২।
[27] . মুসলিম, মিশকাত হা/৫৬৯; তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫৭৪, ৫৮০; মির‘আত ২/২৭৪, ২৭৯।
[28] . তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৭৯; মির‘আত ২/২৮৩।
[29] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, বুখারী, মিশকাত হা/৫৫৭৩-৭৪; তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫৫৯৮-৫৬০০ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮, ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ-৪।
[30] . বুখারী, মিশকাত হা/৫৫৮৫, অধ্যায়-২৮, অনুচ্ছেদ-৪।
[31] . ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৭৩ পৃঃ ; শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো: ১৩৯৮/১৯৭৮), ২/১৩ পৃঃ।
[32] . নায়লুল আওত্বার ২/১৫; মিরক্বাত ২/১১৩-১৪ পৃঃ।
[33] . নায়ল ৫/৪৭-৪৮, ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ‘মুত্যুদন্ডে নিহত ব্যক্তির জানাযা’ অনুচ্ছেদ; এতদ্ব্যতীত আহমাদ, আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪০১১; যা-দুল মা‘আদ ৩/৯৮ পৃঃ; আলবানী, তালখীছু আহকামিল জানায়েয পৃঃ ৪৪; মুসলিম হা/২২৬২ (৯৭৮) ‘জানায়েয’ অধ্যায়-১১, অনুচ্ছেদ-৩৭; বুলূগুল মারাম হা/৫৪২।