ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শারহু মাসাইলিল জাহিলিয়্যাহ ৬৩-৬৭. নির্দোষ হক্বপন্থীদেরকে অপবাদ দেয়া শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
নির্দোষ হক্বপন্থীদেরকে অপবাদ দেয়া

পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা সৃষ্টি করছে মনে করে মন্দ গুণাবলীর মাধ্যমে হক্বপন্থীদেরকে অপবাদ দেয়া। যেমনভাবে আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। আর শাসকের দীন ও তার উপাস্যের অনুসারীদের অসম্মান করা এবং দীনের বিকৃতী সাধনের জন্য তাদেরকে অপবাদ দেয়া।

......................................

ব্যাখ্যা: (৬৩) জাহিলদের রীতি হলো শক্তিসম্পন্ন ও প্রতিশোধ গ্রহণকারীদের নিকট (হক্বপন্থীদের বিরূদ্ধে) অভিযোগ পেশ করেই ক্ষান্ত না হওয়া। বরং ঈমানদারদেরকে তারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বলে দোষারোপ করে। যেমন ফেরআউন সম্প্রদায় তাকে বলেছিল,

(أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ) [الأعراف: 127]

‘আপনি কি মূসা ও তার জাতিকে ছেড়ে দেবেন যাতে তারা যমীনে ফাসাদ করে এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যগুলোকে বর্জন করে?’(সূরা আরাফ ৭:১২৭-১২৮)।

(৬৪) জাহিলরা হক্বকে ফাসাদ (বিশৃঙ্খলা) মনে করতো অথচ ফাসাদের বিপরীত হচ্ছে হক্ব। আর হক্ব হলো ঈমান ও তাওহীদ যার মাধ্যমে মানুষ সংশোধন হতে পারে। পক্ষান্তরে কুফরী, অবাধ্যতা, ফাসেকী, যুলুম এবং সীমা লঙ্ঘনের মাধ্যমে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তাই মূসা ও তার সম্প্রদায় যে রীতির উপর ছিলেন তা ছিল হক্ব।

অপরদিকে ফেরআউন ও তার সম্প্রদায় যে রীতি অনুসরণ করতো তা ছিল ফাসাদ (বিশৃঙ্খলা)। তারা হক্বের বিরোধিতা করতো আর হক্বকে ফাসাদ মনে করতো। এটা কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের চিরাচরিত স্বভাব। আর নেকলোক ও প্রমাণসহ আল্লাহর দিকে আহবানকারীদেরকে জাহিলরা মন্দ নামে ডাকতো। আর আল্লাহর একত্ব ও ইবাদতের দিকে আহবানকারী তাওহীদপন্থী মুমিনদেরকে তারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বলে আখ্যা দিত। জাহিল লোকদের মাঝে মন্দ নামে ডাকার প্রবণতা কিয়ামত অবধি চালু থাকবে। কাফির, অত্যাচারী ও সীমালঙ্ঘনকারীরা নেকলোকদেরকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বলে অভিহিত করতেই থাকবে।

ফেরআউন ও তার সম্প্রদায়ের শাসনামলের প্রথম যুগ থেকে মন্দ নামে ডাকা বর্তমানেও চালু আছে। ঈমানদার ও হক্বপন্থীদেরকে মন্দ নামের উপাধী দেয়া হলে তা কখনোই তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। আর হক্বপন্থী ও দা‘ঈদেরকে অনেক মন্দ নামের উপাধী দেয়া হতো। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাকে খারাপ উপাধী দেয়া হয়েছিল এবং মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহবকে খারাপ উপাধী ‘খারেজী’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। তারা বলেছিল, তিনি মানুষের আক্বীদা পরিবর্তন করে তাদেরকে কাফির বানাতে চেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত জাহিলরা বলে শাইখদের কিতাবে তাদের সংশোধনীয় নীতির নামে অপবাদ, মিথ্যাচারীতা ও মন্দ বিষয় আছে। আর শাসকের দীনের অনুসারীদের মর্যাদাহানীর কারণে জাহিলরা হক্বপন্থীদের বিরুদ্ধে যে অপবাদ দিতো সে প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ) [الأعراف: 127]

আপনার উপাস্যগুলোকে বর্জন করে? (সূরা আরাফ ৭:১২৭-১২৮)। তিনি আরোও বলেন,

(إِنِّي أَخَافُ أَنْ يُبَدِّلَ دِينَكُمْ) [غافر: 26]

নিশ্চয় আমি আশঙ্কা করি সে তোমাদের দীন পাল্টে দেবে অথবা সে যমিনে বিপর্যয় ছড়িয়ে দেবে (সূরা মু‘মিন ৪০:২৬)।

(৬৫) জাহিল ও তাদের অনুসারীদের রীতি হলো মুমিন এবং যারা আল্লাহর দিকে দলীল-প্রমাণসহ এবং সঠিক পন্থায় মানুষকে আহবান করে, তাদের বিরুদ্ধে শাসকদেরকে এভাবে উদ্বুদ্ধ করা যে, শাসকশ্রেণী, তাদের দীন ও রাজনীতির বিরুদ্ধে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। অথচ মুমিন ও দাঈগণ তাদেরকে এমন বিষয়ে সদুপদেশ দেন ও সঠিক পথপ্রদর্শন করেন, যাতে তাদের ও রাজত্বের কল্যাণ রয়েছে। যেমনভাবে আল্লাহ তা‘আলা ফেরআউনের কাহিনীতে বর্ণনা করেছেন। আর তারা ফেরআউন সম্পর্কে কুৎসা রটনা করতো না।

ফেরআউনের সংশোধন, তার রাজত্বের সংস্কার এবং প্রজাদের সংশোধনের জন্য মূসা আলাইহিস সালাম শরীকহীন একক আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিলে প্রজা সাধারণ ফেরআউনকে বলে: অচিরেই মূসা আলাইহিস সালাম ও তার দলবল আপনার বিরুদ্ধে জনসম্মুখে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। ফলে জনসাধারণের উপর আপনার কর্তৃত্বব ও প্রভুত্ব থাকবে না। তারা আপনার ইবাদত করা হতে আল্লাহর ইবাদতের দিকে জনগণকে ধাবিত করছে। এসব কথার মাধ্যমে ফেরআউন প্ররোচিত হয়। কেননা, ফেরআউনের ধারণা যদি মূসা আলাইহিস সালাম ও তার দলবলকে ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে তারা জনগণকে তার প্রভুত্বে স্বীকৃতি দেয়া ও ইবাদত করা থেকে ফিরিয়ে রাখবে। একারণে জনসাধারণকে সে বলেছিল,

(أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى) [النازعات: 24]

‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব’ (সূরা নাযি‘আত ৭৯:২৪)। অন্য আয়াতে আছে,

(مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي) [القصص: 38]

আমি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না (সূরা ক্বছাছ ২৮:৩৮)।

তাই রসূলগণের দাওয়াতকে বিশৃঙ্খলা বলে ও কুফরীকে সঠিক মনে করে জাহিলরা অপব্যাখ্যা করতো। এটিই মূলতঃ বাস্তব বিষয়াদীর পরিবর্তন এবং শাসক ও প্রজার প্রতারিত হওয়ার অন্তর্ভুক্ত বিষয়। বর্তমানে অধিকাংশ শ্রেণীই এ নিকৃষ্ট শয়তানী কর্মে তৎপর, যারা মানুষকে হাবিয়া নামক জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর তারা সৎলোকদের বিরোধিতা করছে, বাস্তবতাকে মিথ্যায় পরিণত করছে এবং ক্ষমতার মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে। এরাই হলো নিকৃষ্ট ব্যক্তিবর্গ যারা দায়িত্বশীলদের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং সদুপদেশ গ্রহণে বাঁধা দেয়।

হে আল্লাহ! তুমি মুসলিমদের শাসক ও তাদের দায়িত্বশীলদের সংশোধন করো। আর তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করো।

(৬৬) শাসকের উপাস্যের মর্যাদাহানীর কারণে জাহিল কর্তৃক হক্বপন্থীদেরকে পরিত্যাগ করার বিষয়টি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি সে বিষয় যা ফেরআউন সম্প্রদায়ের ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আয়াতে উল্লেখ করেছেন। যেমন ফেরআউনের সম্প্রদায় বলেছিল, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ) [الأعراف : 127]

‘আপনি কি মূসা ও তার জাতিকে ছেড়ে দেবেন যাতে তারা যমীনে ফাসাদ করে এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যগুলোকে বর্জন করে?’ (সূরা আরাফ ৭: ১২৭)।

অর্থাৎ জনগণের সামনে আপনার প্রভুত্ব ও আপনার জন্য তাদের ইবাদত সাব্যস্ত হবে। তারা বলতো, পৃথিবীতে আপনার মর্যাদা ও মহানত্ব আছে। যদি আপনি তাদেরকে ছেড়ে দেন তাহলে তারা মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করবে। ফলে তারা আপনার মর্যাদাহানী করে জনগণের সম্মুখে আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করবে। তাই আপনার প্রভাব ও ক্ষমতা বহাল থাকার কারণে আপনি তাদের বিরূদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্যোগ নিন। এটাই ফেরআউনের জন্য প্রতারণা ও তার ধ্বংসের কারণ।

হায় সুবহানাল্লাহ! জাহিলরা আকাশ ও পৃথিবীর প্রভু মহান আল্লাহর মর্যাদাহানী করছে, অথচ তারা নিজেদেরকে দোষী মনে করছে না। বরং মূসা আলাইহিস সালাম ও তার জাতি ফেরআউন ও তার সম্প্রদায়কে সদুপদেশ দিলে তারাই তাদেরকেই দোষারোপ করে। অথচ মূসা আলাইহিস সালাম ও তার দলবল তাদেরকে কল্যাণ ও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন।

শাসক ফেরআউনের ক্ষমতা কি বহাল ছিল, সে কি সংশোধন হয়েছিল?! নিকৃষ্ট শ্রেণীর দায়িত্বশীলরা সর্বদা এরকমই করে থাকে। এ জন্য কল্যাণকামী নেক ব্যক্তিবর্গদের গ্রহণ করা ও নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল, ধ্বংসের নীতিনির্ধারক এবং ভ্রান্ত চিন্তাশীলদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া শাসকদের উপর আবশ্যক। তারা কেবল হাবিয়া নামক জাহান্নামের দিকেই তাদেরকে পথ দেখায়। যেমনভাবে ফেরআউনের দায়িত্বশীলদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। তারা ফেরআউনকে ধ্বংস ও বিনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আর ফেরআউন ও তার হক্ব গ্রহণের মাঝে তারা অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল।

অন্যদিকে দীন পরিবর্তনের আশঙ্কায় জাহিলরা হক্বপন্থীদেরকে পরিত্যাগ করতো। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ফেরআউন সম্পর্কে বলেন,

(إِنِّي أَخَافُ أَنْ يُبَدِّلَ دِينَكُمْ أَوْ أَنْ يُظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ) [غافر: 26]

নিশ্চয় আমি আশঙ্কা করি সে তোমাদের দীন পাল্টে দেবে অথবা সে যমিনে বিপর্যয় ছড়িয়ে দেবে (সূরা মূ‘মিন ৪০:২৬)।

শাসকের দীনের মর্যাদাহানীর কারণেও তারা হক্বপন্থীদেরকে পরিত্যাগ করতো। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ) [الأعراف: 127]

আপনাকে ও আপনার উপাস্যগুলোকে বর্জন করে?’ (সূরা আরাফ ৭: ১২৭)।

মূসা আলাইহিস সালাম ও তার দাওয়াতের ব্যাপারে এ দু‘টি সমস্যা ফেরআউনের মাঝে বিদ্যমান ছিল। ফেরআউন মূসা আলাইহিস সালাম এর দাওয়াত কবুল করা হতে জনগণকে সতর্ক করে এবং সে প্রজাদের উপদেশের জন্য বিক্ষোভ সমাবেশ করে। দীন ও দুনিয়ার (صلاح) ছালাহ তথা শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য জনগণকে সে উপদেশ দেয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(أَوْ أَنْ يُظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ) [غافر: 26]

সে যমিনে বিপর্যয় ছড়িয়ে দেবে (সূরা মূ‘মিন ৪০:২৬)। যেমন ফেরআউনের অনুসারীরা বলেছিল,

(أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ) [الأعراف: 127] ،

‘আপনি কি মূসা ও তার জাতিকে ছেড়ে দেবেন যাতে তারা যমীনে ফাসাদ করে (সূরা আরাফ ৭:১২৭)।

(৬৭) সৎলোকদেরকে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বলে অভিহিত করতো। ফাসাদ সৃষ্টি করাই জাহিলদের নিকট তাওহীদ এবং এক আল্লাহর ইবাদত হিসাবে স্বীকৃত। আর এখানে (صلاح) ছালাহ তথা সংশোধন বলতে শিরককে বুঝানো হয়েছে। কেননা, যখন ফাসাদ সৃষ্টি হতো, তখন জাহিলরা হক্বকে বাতিল এবং বাতিলকে হক্ব মনে করতো। কে দীনকে পরিবর্তন করে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করেছিল? জবাব হলো ফেরআউনই কুফরী ও শিরকের মাধ্যমে তাওহীদের দীনকে পরিবর্তন করেছিল।

পক্ষান্তরে মূসা আলাইহিস সালাম এমন সঠিক দীনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতেন, যে দীনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা জিন ও মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তা মানুষের জন্য শৃঙ্খলাপূর্ণ। কেননা, শরীকহীন এক আল্লাহর ইবাদত ছাড়া পৃথিবীতে শৃঙ্খলা বজায় থাকবে না। এটাই পৃথিবীবাসীর জন্য শৃঙ্খলার মাধ্যম। অপরদিকে, শিরক, কুফরী এবং পাপাচারীতার মাধ্যমে পৃথিবীতে অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।