ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শারহুল আক্বীদা আত্-ত্বহাবীয়া ৯. সৃষ্টির কোনো কিছুই তার সদৃশ নয় (وَلَا يُشْبِهُهُ الْأَنَامَ) ইমাম ইবনে আবীল ইয আল-হানাফী (রহিমাহুল্লাহ)
সৃষ্টির কোনো কিছুই তার সদৃশ নয়।

 ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, (وَلَا يُشْبِهُهُ الْأَنَامَ) সৃষ্টির কোনো কিছুই তার সদৃশ নয়।

........................

ব্যাখ্যা: এখানে ঐসব মুশাবেবহা সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’ (সূরা শূরা: ১১)। উপরোক্ত কথার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সুউচ্চ সিফাতসমূহকে নাকচ করা উদ্দেশ্য নয়। যেমন ধারণা করে থাকে বিদ‘আতীরা।

ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ তার সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ফিকহুল আকবারে বলেন, لَا يُشْبِهُ شَيْئًا مِنْ خَلْقِهِ ولايشبهه شيئ من خلقه - তিনি সৃষ্টির কোনো কিছুর সাথেই সাদৃশ্য রাখেন না এবং সৃষ্টির কিছুই তার সাথে সাদৃশ্য রাখে না।

অতঃপর তিনি বলেন, তার সমস্ত গুণই সৃষ্টির গুণ থেকে ভিন্ন রকম। তার ইলম রয়েছে, কিন্তু তার ইলম আমাদের ইলমের মত নয়। তিনি ক্ষমতাবান, কিন্তু তার ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়। তিনি দেখেন, কিন্তু তার দেখা আমাদের দেখার মত নয়। ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।

ইমাম নু‘আইম ইবনে হাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে তার সৃষ্টির কোনো কিছুর সাথে তুলনা করবে সে কাফের হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সিফাত থেকে কোনো একটিকে অস্বীকার করবে, সে কাফেরে পরিণত হবে। আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের পবিত্র সত্তাকে যেসব গুণাবলীতে বিশেষিত করেছেন এবং তার সম্মানিত রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুর যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তাতে কোন সাদৃশ্য নেই।

ইসহাক বিন রাহওয়াই বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সিফাত বর্ণনা করতে গিয়ে তার সিফাতগুলোকে মাখলুখের সিফাতের সমতুল্য মনে করবে, সে মহান আল্লাহর সাথে কুফুরী করবে। তিনি আরো বলেন, জাহাম বিন সাফওয়ান ও তার অনুসারীদের আলামত হলো, তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকদের বিরুদ্ধে এ বলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকে যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা হলো সাদৃশ্যকারী। তাদের আরেকটি আলামত হলো, তারা আল্লাহর সমস্ত সিফাতকে অস্বীকার করে। সালাফদের অনেক ইমাম থেকেই জাহমীয়াদের সম্পর্কে অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে। তারা বলেছেন, জাহমীয়াদের আলামত হলো, তারা আহলে সুন্নাতের লোকদেরকে সাদৃশ্যকারী বলে থাকে। যারাই আল্লাহর নাম ও সিফাতসমূহ থেকে কোনো কিছু অস্বীকার করেছে, তারাই সিফাত সাব্যস্ত কারীদেরকে সাদৃশ্যকারী বলে থাকে।

এমনি যিন্দীক, বাতেনী এবং দার্শনিকদের যেসব লোক আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে এবং বলেছে আল্লাহ তা‘আলাকে عالم (জ্ঞানী) قادر (ক্ষমতাবান) ইত্যাদি নামে নামকরণ করা যাবে না, তাদের ধারণায় আল্লাহ তা‘আলাকে উপরোক্ত নামগুলোতে নামকরণকারীরা সাদৃশ্যকারী। তারা এ কথার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছে, সৃষ্টিকে যে নামে নামকরণ করা হয়, স্রষ্টার জন্য সে নাম সাব্যস্ত করা হলে ঐ যৌথ নামের যৌথ পরিমাণ অর্থ উভয়ের জন্য সমানভাবে সাব্যস্ত হওয়া আবশ্যক হয়।[1]

আর চরমপন্থী জাহমীয়ারা আল্লাহর নামগুলো কেবল রূপকার্থেই সাব্যস্ত করে থাকে। তাদের ধারণা হলো, যারা বলবে, আল্লাহ তা‘আলা প্রকৃতপক্ষেই জ্ঞানবান এবং প্রকৃতপক্ষেই ক্ষমতাবান, তারাও সাদৃশ্যকারী। এমনি যারা আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করতে গিয়ে বলেছে, তার কোন ইলম নেই, ক্ষমতা নেই, কথা নেই, ভালোবাসা নেই এবং ইচ্ছা নেই, তারা আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সাব্যস্ত কারীদেরকে মুশাবেবহা (সাদৃশ্যকারী) এবং দেহবাদী বলেছে। এ জন্যই আপনি দেখবেন, আল্লাহ তা‘আলার সিফাতে অবিশ্বাসী জাহমীয়া, মুতাযেলা, রাফেযী এবং তাদের অনুরূপ অন্যান্য বাতিল ফির্কার লোকেরা তাদের কিতাবসমূহে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদেরকে সাদৃশ্যকারী ও দেহবাদী নামে নামকরণ করে পরিপূর্ণ করেছে। তারা তাদের কিতাবসমূহে বলে থাকে, দেহবাদীদের এমন একটি দল রয়েছে, যাদেরকে মালেকীয়া বলা হয়। তারা মালেক বিন আনাস নামের একজন লোকের দিকে নিজেদেরকে সম্বোধিত করে থাকে। তাদের আরেকটি দল রয়েছে, যাদেরকে শাফেঈয়া বলা হয়। তারা নিজেদেরকে মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ- শাফেঈর দিকে সম্বোধিত করে থাকে!! এমনকি তাদের মধ্য থেকে যারা কুরআনের ব্যাখ্যা করেছে, যেমন মুতাযেলী ইমাম কাযী আব্দুল জববার, জারুল্লাহ জামাখশারী এবং অন্যরা আল্লাহর সিফাত সাব্যস্তকারী ও কিয়ামতের দিন মুমিনদের জন্য আল্লাহর সাক্ষাৎ সাব্যস্তকারীদেরকে সাদৃশ্যকারী নামে নামকরণ করেছে। পরবর্তীকালের অধিকাংশ বিদ‘আতী ফির্কার লোকেরাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের জন্য এ নামটি ব্যবহার করেছে।

তবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের প্রসিদ্ধ আলেমদের থেকে বর্ণিত আছে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার সদৃশ নাকোচ করেন; কিন্তু এ নাকোচ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সিফাতসমূহ নাকচ করা তাদের উদ্দেশ্য নয় এবং যারা আল্লাহ তা‘আলার জন্য সিফাত সাব্যস্ত করে, তাদের প্রত্যেককেই তারা সাদৃশ্যকারী বলে বিশেষিত করে না। বরং তাদের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলা নাম, সিফাত এবং ক্রিয়া-কর্মের ক্ষেত্রে তিনি কোনো সৃষ্টির সদৃশ নন।

যেমন ইতিপূর্বে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর উক্তি অতিক্রান্ত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলার ইলম রয়েছে, কিন্তু তার ইলম আমাদের ইলমের মত নয়, তিনি ক্ষমতাবান, কিন্তু তার ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মত নয়, তিনি দেখেন, কিন্তু তার দেখা আমাদের দেখার মত নয়। এটিই আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’ (সূরা শূরা: ১১) -এর অর্থ। এখানে আল্লাহর সদৃশ নফী করার সাথে সাথে তার সুউচ্চ সিফাতগুলোও সাব্যস্ত করা হয়েছে।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ সামনে অচিরেই আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সাব্যস্ত করার সময় এ ব্যাপারে আলোচনা করবেন। সেখানে তিনি সতর্ক করেছেন যে, আল্লাহর সদৃশ নাকচ করলেই তার সিফাত নাকচ করা আবশ্যক হয় না।

আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে মূল কথা হলো আল্লাহর ইলম বা অন্যান্য সিফাতের মধ্যে ঐ রকম قياس تمثيلচলবে না, যেমন কিয়াস করে থাকেন ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি বিদগণ। অর্থাৎ তারা যেমন কোনো জিনিসের মূল এবং শাখার মধ্যে অভিন্ন কারণ থাকার কারণে উভয়ের উপর একই হুকুম প্রয়োগ করেন, ঠিক তেমনি আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে মাখলুকের সিফাতের উপর কিয়াস বা অনুমান করা যাবে না এবং এ কথা বলা যাবে না যে, আল্লাহর ইলম রয়েছে এবং আল্লাহর কতিপয় সৃষ্টিরও ইলম রয়েছে। সুতরাং উভয়ের ইলম একই সমান হয়।[2]

এমনি আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে এমন قياس شمولي বা এমন আম বা যৌথ অর্থবোধক জিনিসের উপরও কিয়াস করা চলবে না, যার অধিনস্ত একক জিনিসগুলো পরস্পর সমান স্বভাব-প্রকৃতির অধিকারী।[3]

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে মানুষের উপর কিয়াস করে এ কথা বলা যাবে না যে, মানুষ বলতে যেমন বনী আদমের প্রত্যেক ব্যক্তিকেই বুঝায় এবং তাদের প্রত্যেকেই যেহেতু একই প্রকৃতি, স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, তাই আল্লাহ তা‘আলাও তাদের যে কোনো একজনের মত অভিন্ন স্বভাব-প্রকৃতি সম্পন্ন। তাই যদি বলা হয় আল্লাহর হাত আছে এবং তিনি আরশের উপর সমুন্নত, তার মানে হলো অন্যান্য জিনিসের মত তার জিসিম বা দেহ-কাঠামো-কায়া আছে। আর প্রত্যেক দেহ বা কাঠামোরই মূল বস্তু ও তার আনুসাঙ্গিক বিষয় ও অবস্থা রয়েছে। সুতরাং আল্লাহরও মূল সত্তা এবং বিভিন্ন অবস্থা রয়েছে। তাই দার্শনিক ও যুক্তিবিদরা তাদের কল্পনা অনুসারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে সাধারণ সৃষ্টিসমূহের আওতায় এনে একটি সৃষ্টির মতই কল্পনা করেছে।

এভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে অন্যের সাথে তুলনা করা যাবে না। সে সঙ্গে তাকে এবং অন্যান্য বস্তুকে এএ যৌথ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না, যার প্রত্যেকটি বিষয় পরস্পর সমান। এ জন্যই দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রবিদদের অনেক দল আল্লাহর সিফাতসমূহের ক্ষেত্রে এ কিয়াসগুলোর আশ্রয় নেয়ার কারণে সুদৃঢ় ঈমানের স্তরে পৌঁছতে পারেনি। বরং তাদের যুক্তিগুলো পরস্পর সাংঘর্ষিক। পরিশেষে তারা হয়রানী ও এলোমেলো অবস্থায় আটকা পড়েছে। বিশেষ করে যখন তারা দেখেছে যে, তাদের যুক্তিগুলো সম্পূর্ণ ভুল অথবা তাদের এবং প্রতিপক্ষের দলীলগুলো পরস্পর সমান শক্তিশালী।

কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে প্রয়োজনবোধে قياس الأولى তথা সর্বোত্তম কিয়াস ব্যবহার করা বৈধ রয়েছে। কিয়াসে তামছীলে হোক কিংবা কিয়াসে শুমুলী হোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلِلَّهِ الْمَثَلُ الْأَعْلَىٰ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তিনি পরাক্রমশালী-প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আন নাহাল: ৬০)

জানা আবশ্যক যে, সৃষ্টির মধ্যে পূর্ণতার যেসব বিশেষণের মধ্যে কোনো দিক বিবেচনাতেই ত্রুটি নেই, অবিনশ্বর স্রষ্টা সেসব বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত হওয়ার আরো বেশী হকদার। আর ত্রুটি-বিচ্যুতিহীন পূর্ণতার প্রত্যেক বিশেষণের যে অংশ প্রতিপালিত ও পরিচালিত সৃষ্টির জন্য সাব্যস্ত, সৃষ্টি কেবল তা তার স্রষ্টা, প্রভু ও পরিচালকের নিকট থেকেই লাভ করেছে। সুতরাং সৃষ্টির চেয়ে স্রষ্টাই তা দ্বারা বিশেষিত হওয়ার আরো বেশী হকদার। আর যে দোষ-ত্রুটি এ পূর্ণতাকে ত্রুটিযুক্ত করে দেয়, তাকে যখন কোনো সৃষ্টি থেকে নাকচ করা আবশ্যক হয়, তখন মহান স্রষ্টা থেকে নাকচ করা আরো উত্তমভাবেই আবশ্যক হবে। তবে এর জন্য একাধিক শর্ত রয়েছে।

প্রথম শর্ত হলো কুরআন-সুন্নাহর দলীল দ্বারা সেগুলো আল্লাহর জন্য মৌলিকভাবে সাব্যস্ত হতে হবে এবং দ্বিতীয় শর্ত হলো সেগুলো সার্বিক দিক থেকেই পরিপূর্ণ হতে হবে। অর্থাৎ এমন হবে না যে, একদিক থেকে উহা পূর্ণতার পরিচয় বহন করলেও অন্যদিক বিবেচনায় উহা অপূর্ণতার পরিচায়ক। কেননা কোনো কোনো বিষয় মাখলুকের জন্য একদিক বিবেচনায় পূর্ণ হয়, কিন্তু অন্যান্য দিক মূল্যায়নে পূর্ণ হয় না। এমন পূর্ণতার বিশেষণ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা বৈধ নয়।

উদাহরণ স্বরূপ পানাহার গ্রহণ করা ও সন্তান জন্ম দান করার ব্যাপারটি পেশ করা যেতে পারে। যে মাখলুক পানাহার করতে পারে সে ঐ মাখলুক হতে অধিক পরিপূর্ণ, যে স্বাস্থ্যগত ত্রুটি বা অন্য কোনো সমস্যার কারণে খাবার গ্রহণ করে তা হজম করতে পারে না। এমনি যে নারী-পুরুষ সন্তান জন্ম দিতে পারে, সে ঐ নারী-পুরুষ থেকে অধিক পরিপূর্ণ, যারা সন্তান জন্ম দানের ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং মাখলুকের জন্য এগুলো পূর্ণতার বিশেষণ হলেও যেহেতু এগুলোর প্রতি তার প্রয়োজন রয়েছে, তাই এগুলো সার্বিক দিক থেকে পূর্ণতার গুণাবলী নয়। তাই এগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তা থেকে পবিত্র করেছেন।

অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, যারা আল্লাহর সিফাত অস্বীকারে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত তারা এ আয়াতে কারীমা, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার নাম ও সিফাতকে অস্বীকারের পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে থাকে। তারা বলে, ওয়াজিবুল উজুদের সিফাত এ রকম নয়, এরূপ নয়।[4]

অতঃপর তারা বলে থাকে, দর্শনের মূলকথা হলো যথাসাধ্য আল্লাহর স্বভাবে বিশেষিত হওয়া। এটি অর্জন করাকেই তারা তাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হিসাবে নির্ধারণ করেছে এবং এটিকেই তারা কামেল মানুষ হওয়ার সর্বোচ্চ মানদন্ড বানিয়ে নিয়েছে। কতিপয় সুফী এ কথায় দার্শনিকদের সাথে একমত পোষণ করে এবং তারা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করে থাকে যে তিনি বলেছেন,

«تَخَلَّقُوا بِأَخْلَاقِ اللَّهِ»

‘‘তোমরা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও’’।[5]

তাদের কথা পরস্পর সাংঘর্ষিক। কারণ তারা আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত সিফাতই অস্বীকার করেছে। আল্লাহর জন্য কোনো সিফাতই তারা সাব্যস্ত করে না। তারা শুধু আল্লাহ তা‘আলার সিফাতবিহীন সাধারণ সত্তা সাব্যস্ত করে। এখন তাদের কাছে প্রশ্ন হলো, তোমরা যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার কোনো সিফাতই বাকি রাখোনি, তাহলে বান্দা তার রবের কোন্ স্বভাবকে নিজের চরিত্র হিসাবে গ্রহণ করবে?!

আসল কথা হলো, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির কোনো কিছুর সাথেই সাদৃশ্য রাখেন না এবং কোনো সৃষ্টিই তার সাথে সাদৃশ্য রাখে না। খ্রিস্টানরা, সর্বেশ্বরবাদীরা এতে বিরোধিতা করে থাকে। তাদের উপর আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক! তিনি সৃষ্টির কারো সাথে সাদৃশ্য না রাখার দাবি হলো, সৃষ্টির কেউই তার সাথে সাদৃশ্য রাখেনা।

তাই শাইখ এ কথা বলাকেই যথেষ্ট মনে করেছেন যে, وَلَا يُشْبِهُهُ الْأَنَامَ ‘‘সৃষ্টির কোনো কিছুই তার সাদৃশ্য রাখে না’’। এখানে الأنام অর্থ হলো মানুষ। কেউ কেউ বলেছেন, এখানে الأنام বলতে প্রত্যেক প্রাণী উদ্দেশ্য। আবার কেউ কেউ বলেছেন, জিন ও মানুষ উদ্দেশ্য। তবে আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

وَالْأَرْضَ وَضَعَهَا لِلْأَنَامِ

‘‘পৃথিবীকে তিনি সমস্ত সৃষ্টির জন্য বানিয়েছেন’’ (সূরা আর রহমান:১০) অন্যান্য অর্থের তুলনায় প্রথম অর্থকেই সুস্পষ্টভাবে সমর্থন করে। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।

[1]. তাদের কথা সম্পূর্ণ বাতিল। কারণ একাধিক বস্তুকে এক নামে নামকরণ করা হলে একই নামধারণকারী প্রত্যেকটি বস্তুর প্রকৃত অবস্থা, গুণাগুণ ও স্বভাব একই রকম হওয়ার ধারণা শুধু মস্তিস্কের ভিতরেই জাগতে পারে। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমরা এ কিতাবের বিভিন্ন স্থানে সাব্যস্ত করেছি যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব যেমন সৃষ্টির অস্তিত্বের মত নয়, তেমনি তার নাম ও গুণাবলীও সৃষ্টির নাম এবং গুণাবলীর অনুরূপ নয়।

[2]. ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি অনুসারে কোনো জিনিসকে তার মূলের সাথে একই হুকুমের মধ্যে শামিল করে দেয়াকে কিয়াসে তামছীলি বলা হয়। অর্থাৎ যখন কোনো জিনিসের জন্য নির্দিষ্ট কোনো হুকুম সাব্যস্ত হয় এবং তার অনুরূপ অন্যান্য জিনিসের মধ্যে একই কারণ বিদ্যমান থাকে সেক্ষেত্রে তার জন্য একই হুকুম সাব্যস্ত করাকে কিয়াসে তামছীলি বলা হয়। লোকেরা আলেমদেরকে যখন জিজ্ঞেস করলো, আমরা বিমানের মধ্যে কিভাবে ছলাত পড়বো? জবাবে আলেমগণ বলেছেন, নৌকায় ভ্রমণকালে যেভাবে নামায পড়া হয়, বিমানেও ঠিক সেভাবেই ছলাত পড়া হবে। সুতরাং বিমানকে নৌকার উপর কিয়াস করা হবে। এমনি চাউলকে গমের উপর কিয়াস করে তা লেন-দেন করার সময় কম-বেশী করাতে সুদের হুকুম লাগানো। কেননা চাউল ও গম উভয় খাদ্যদ্রব্য এবং দানা জাতিয়। সুতরাং চাউল এবং গমের হুকুম একই। আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে এ জাতিয় কিয়াস নিষিদ্ধ। তবে আলেমগণ আল্লাহ তা‘আলার জন্য কেবল সর্বোত্তম কিয়াস ও দৃষ্টান্ত জায়েয বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلِلَّهِ الْمَثَلُ الْأَعْلَىٰ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ‘‘আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত, তিনি পরাক্রমশালী-প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা নাহাল: ৬০) এর অর্থ হলো প্রত্যেক পূর্ণতার সিফাত থেকে আল্লাহ তা‘আলার জন্য কেবল সর্বোচ্চ ও সর্বোৎকৃষ্ট পরিমাণ সাব্যস্ত। যেমন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে শ্রবণ, দৃষ্টি, জ্ঞান, ক্ষমতা, জীবন, প্রজ্ঞা ইত্যাদি সিফাত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলারও এসব সিফাত রয়েছে। তবে আল্লাহ তাআলার জন্য এসব থেকে সর্বোচ্চ ও সর্বোৎকৃষ্ট পরিমাণই সাব্যস্ত হবে। কেননা সৃষ্টির মধ্যে পূর্ণতার যেই বিশেষণ রয়েছে, তা স্রষ্টা থেকেই এসেছে। অপর পক্ষে সৃষ্টি অপূর্ণতার যেই বিশেষণে বিশেষিত হওয়া থেকে নিজেকে পবিত্র করে, স্রষ্টা সেই বিশেষণ থেকে পবিত্র হওয়ার আরো বেশী হকদার। তাই আমরা কখনো কখনো বোধশক্তির দলীল দ্বারা শর্তসাপেক্ষে আল্লাহ তাআলার সিফাতের জন্য সর্বোত্তম কিয়াস ব্যবহার করি।

প্রথম শর্ত হলো কুরআন-সুন্নাহর দলীল দ্বারা সেগুলো আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত হতে হবে এবং

দ্বিতীয় শর্ত হলো সেগুলো সার্বিক দিক থেকেই পরিপূর্ণ হতে হবে।

উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি যে, উলু বা উপরে সমুন্নত হওয়া ও জ্ঞানবান হওয়া সৃষ্টির পূর্ণতার অন্যতম বিশেষণ। মাখলুক এ জাতীয় বিশেষণে বিশেষিত হলে কোনোভাবেই দূষিত হয় না। সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে সাব্যস্ত পূর্ণতার যেই বিশেষণের মধ্যে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই, স্রষ্টার জন্য উহা আরো উত্তমভাবেই সাব্যস্ত করা হবে। আলেমগণ সিফাতের আলোচনায় প্রায়ই এ ধরণের কথা বলে থাকেন। তবে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে বিরাট পার্থক্য থাকার কারণে উভয়ের মাঝে ফিকাহ শাস্ত্রীয় কিংবা যুক্তিবাদী কিয়াস চলবে না। কারণ আমরা কখনো ওয়াজিবকে জায়েযের উপর কিয়াস করি না কিংবা জায়েযকে ওয়াজিবের উপর কিয়াস করি না। সুতরাং সিফাতের ক্ষেত্রে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এ ধরণের কিয়াস থেকে আরো বেশী দূরে থাকা আবশ্যক। কেউ যদি আপনাকে বলে, আল্লাহর অস্তিত্ব রয়েছে এবং সৃষ্টিরও অস্তিত্ব রয়েছে। সুতরাং সে যদি সৃষ্টির অস্তিত্বের উপর আল্লাহর অস্তিত্বকে কিয়াস করে বলে আল্লাহর অস্তিত্ব সৃষ্টির অস্তিত্বের মতই। তার জবাবে আমরা বলবো যে, এ কিয়াস বাতিল। কেননা স্রষ্টা নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল এবং তার অস্তিত্ব অত্যাবশ্যকীয় ও সৃষ্টির অস্তিত্ব সম্ভাব্য। সে সঙ্গে স্রষ্টা কোনো সময় অস্তিত্বহীন ছিলেন না, কখনো তার অস্তিত্ব শেষও হবে না। ঐদিকে সৃষ্টি এক সময় ছিল না। পরে অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং তার অস্তিত্ব চিরস্থায়ী নয়। সুতরাং স্রষ্টার সত্তা, বিশেষণ ও তার ক্রিয়া-কর্মের সাথে মাখলুকের সত্তা, সিফাত ও ক্রিয়া-কর্মের কোনো তুলনাই চলে না।

[3]. যুক্তিবিদরা বিভিন্ন জিনিসের প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে এ প্রকার কিয়াস ব্যবহার করে থাকে। তারা বলে থাকে, জিনিসটি যেহেতু এ রকম, ও রকম, তাই ফলাফল দাঁড়ায় এরূপ...। এভাবে তারা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সাদৃশ্যপূর্ণ প্রত্যেক জিনিসের একটির উপর অন্যটির হুকুম লাগিয়ে থাকে। তাদের কিতাবে রয়েছে, العالم متغير وكل متغير حادث فالعالم حادث পৃথিবীর সবকিছুই পরিবর্তনশীল, প্রত্যেক পরিবর্তনশীল বস্তুই সৃষ্টি, সুতরাং পৃথিবীও সৃষ্টিজগতের অন্তর্ভুক্ত। কিয়াসে শুমুলীর উদাহরণ হিসাবে তারা আরো বলে থাকে যে, زيد مثل علي ‘‘যায়েদ আলীর মতই’’। কেননা যায়েদ মানুষ, আলীও মানুষ। প্রত্যেক মানুষই যেহেতু حيوان ناطق অর্থাৎ বাকশক্তি সম্পন্ন প্রাণী, তাই زيد حيوان ناطق ‘‘অর্থাৎ যায়েদ বাকশক্তি সম্পন্ন একটি প্রাণী। যায়েদ কথা বলে, মানুষও কথা বলে। সুতরাং যায়েদ একজন মানুষ....।

আসলে এভাবে যুক্তি পেশ করে ফলাফল বের করা সময়ের অপচয় এবং সহজ বিষয়কে আরো জটিল করা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ আমরা সৃষ্টিগত স্বভাব, বোধশক্তি ও বাস্তবতার আলোকেই প্রমাণ করতে পারি যে, সৃষ্টিজগতের সবকিছুই প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা সদাসর্বদাই নতুন নতুন বস্তু সৃষ্টি হতে দেখছি, ধ্বংসও হতে দেখছি। আর নাবী-রসূলদের মাধ্যমে আগত আসমানী কিতাব ও শরীয়তের দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে আল্লাহ তাআলা ছাড়া সবকিছুই সৃষ্টি এবং তিনি ছাড়া সবকিছুই ধ্বংসশীল।

আর বনী আদমের বাকশক্তি আছে বলেই যুক্তি ভূমিকা পেশ করে তাদের কাউকে অন্যান্য জীব-জন্তু থেকে আলাদা করে মানুষ বানানোর প্রয়োজন নেই। কারণ বাকশক্তি ছাড়াও মানুষের অন্যান্য এমন স্বভাব-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট আমাদের কাছে সুস্পষ্ট, যা তাকে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে আলাদা করে দেয়। (আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)

[4]. ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে যে, তারা আল্লাহর সিফাত বর্ণনা করতে গিয়ে বলে থাকে, তার দেহ নেই, আকৃতি নেই, ছায়া নেই, তিনি ভিতরে নন, বাইরেও নন.....ইত্যাদি।

[5]. ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, এটি একটি সনদবিহীন হাদীছ। দেখুন: ইমাম আলবানীর তাহকীক ও তাখরীজসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, হাদীছ নং- ৫১।