ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
রাহে বেলায়াত দ্বিতীয় অধ্যায় - বেলায়াতের পথে যিকরের সাথে ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
চ. আত্মশুদ্ধিমূলক মানসিক ও দৈহিক কর্ম - (১০) নফল সিয়াম ও নফল দান

আমরা দেখেছি যে, সকল ইবাদতই মূলত যিকর। আল্লাহর পথে আগ্রসর হওয়ার জন্য ফরয ইবাদত পালনের পরে বেশি বেশি নফল ইবাদত মুমিনের পাথেয়। বিশেষত নফল সিয়াম, নফল দান, নফল ইলম অর্জন ইত্যাদি ইবাদত বেশি বেশি পালনের চেষ্টা করতে হবে। নফল সিয়াম বা সিয়াম মুমিনের জীবনে অন্যতম ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ নফল সিয়াম পালনের বিষয়ে খুবই গুরুত্ব আরোপ করতেন। তাঁরা নিয়মিত ও অনিয়মিত নফল সিয়াম পালন করতেন। প্রতি দুইদিন পর একদিন, বা একদিন পর একদিন, বা প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার, প্রতি আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ, প্রতি মাসের প্রথমে ও শেষে নিয়মিত নফল সিয়াম পালনের বিশেষ উৎসাহ প্রদান করেছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। এছাড়া সুযোগমতো যত বেশি সম্ভব অনিয়মিত নফল সিয়াম পালন করতেন তিনি।

নফল দান, সাদকা, সাহায্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। প্রত্যেক মুমিনের নিয়মিত ও অনিয়মিত দানের অভ্যাস রাখা প্রয়োজন। মানুষের অভাব চিরন্তন। মনের অভাব থেকে কেউই মুক্ত নয়। মুমিন সর্বদা চেষ্টা করবেন অতি প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা মেটানোর পর প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে নিয়মিত কিছু নির্ধারিত এতিম, বিধবা, অসহায় বা অভাবী মানুষকে সাহায্য করার। এছাড়া সর্বদা সাধ্যমতো দান করার চেষ্টা করতে হবে। দানের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও সাওয়াব বিষয়ে হাদীস আলোচনা করার জন্য পৃথক বই প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনার অধিপতি ছিলেন। আল্লাহর নির্ধারিত বিধান অনুসারে তিনি যুদ্ধলব্ধ গনীমত থেকে এক পঞ্চমাংশ পেতেন। পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা অভাবী মানুষদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্ধ্যার আগেই তাঁর সব সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যেত। মাসের পর মাস তাঁর স্ত্রীগণের ঘরে রান্না করার মতো কিছুই থাকত না। শুধুমাত্র ২/১ টি শুকনো খেজুর ও পানি খেয়েই তাঁদের মাসের পর মাস চলে যেত। এ সকল ঘটনা বিস্তারিত বলতে গেলে বিশাল আকারের বই লিখতে হবে।

সাহাবায়ে কেরাম সর্বদা এ ধরনের ব্যয়ের জন্য আগ্রহী ছিলেন। তাঁদের জীবনে এ ধরনের অগণিত ঘটনা রয়েছে, যা আলোচনা করলে আমাদের পার্থিব সম্পদ ও বিলাসিতার লোভ কিছুটা কমতে পারে। এই পুস্তকের ক্ষুদ্র পরিসরে শুধু দু’টি ঘটনা উল্লেখ করছি। উমার (রাঃ) জাবির (রাঃ)-এর হাতে একটি দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) দেখতে পান। তিনি জিজ্ঞাসা করেন: দিরহাম দিয়ে কী করবে? জাবির বলেন: আমার পরিবারের সদস্যগণ খুবই শখ করেছে মাংস খাওয়ার, তাই তাদের জন্য কিছু মাংস ক্রয় করব। উমার অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বারবার বলতে থাকেন - ‘শখ করেছে?’ জাবির বলেন: আমি মনে মনে কামনা করছিলাম, আমার হাতের দিরহামটি যদি হারিয়ে যেত এবং উমার তা না দেখতেন ! উমার (রাঃ) বলেনঃ

أكُلَّ ما اشْتهيتُمْ اشْتَريتُمْ! ما يُريدُ أحدُكمْ أنْ يَطْوِيَ بَطنَهُ لابْنِ عمَّهِ وجارِهِ ؟ أين تَذهبُ عنكُمْ هذه الآيةُ - أذْهَبْتُمْ طَيِّباتِكُمْ في حَيَاتِكُمُ الدُّنْيَا واسْتَمْتَعْتُمْ بِهَا


“তোমাদের যা শখ হবে তাই কিনবে? তোমাদের মধ্যে কেউ কি চায় না যে, তার ভাইয়ের জন্য ও প্রতিবেশীর জন্য একটু ক্ষুধার্ত থাকবে (নিজে ক্ষুধার্ত থেকে সেই অর্থ তার ভাইকে প্রদান করবে)? আল্লাহ বলেছেনঃ যেদিন কাফিরদেরকে জাহান্নামের কাছে উপস্থিত করা হবে, সেদিন বলা হবেঃ তোমরা তোমাদের সুখ ও মজাদার সব কিছু তো পার্থিব জীবনেই ভোগ করে শেষ করে ফেলেছ, সুতরাং আজ তোমাদরেকে অপমানকর আযাবের শাস্তি প্রদান করা হবে।”[1] তোমরা কি কুরআনের এই বাণী ভুলে গেলে?[2]


অন্য এক ঘটনায় আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, একদিন তিনি খাবারের মাজলিসে বসে খাচ্ছিলেন, এমতাবস্থায় তাঁর পিতা উমার (রাঃ) তার ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি সরে গিয়ে তাঁর জন্য মাজলিসের সামনে স্থান করে দেন। উমার (রাঃ) বসে বিসমিল্লাহ বলে এক লোকমা গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় লোকমা মুখে দেওয়ার পরে তিনি বলেন, আমি খাদ্যের মধ্যে চর্বির গন্ধ পাচ্ছি, যা মাংসের চর্বি বলে মনে হচ্ছে না। তখন আব্দুল্লাহ বলেন, আমি বাজারে গিয়েছিলাম মোটাতাজা ছাগলের মাংস কেনার আশায়। কিন্তু বাজারে গিয়ে

দেখলাম তার মূল্য বেশি। এজন্য এক দিরহাম দিয়ে রোগাপটকা বকরির মাংস কিনলাম এবং এক দিরহাম দিয়ে ঘি কিনে এর সাথে মিশালাম, যেন ছেলেমেয়েরা ভালোভাবে মাংসটুকু চেটেপুটে খেতে পারে। তখন উমার (রাঃ) বলেনঃ

ما اجتمعا عند رسول الله صلّى الله عليه وسلم قط إلا أكل أحدهما وتصدق بالاخر


“যখনই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে দুটি দিরহাম জমা হতো, তখনই তিনি তার একটি দিরহাম দিয়ে খাদ্য ক্রয় করতেন এবং অন্যটি তিনি দান করতেন।” এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, “হে আমীরুল মুমিনীন, আপনি খানা গ্রহণ করুন। ভবিষ্যতে কখনোই আমি এর ব্যতিক্রম করব না। যদি কখনো আমি দু’টি দিরহামের মালিক হয় তাহলে ঠিক রাসূলুল্লাহ (সা.) যেভাবে ব্যয় করেছেন (একটি সংসারের জন্য ও অপরটি সমাজের জন্য) সেভাবেই আমি ব্যয় করব।”[3]

এ ছিল সুন্নাতে রাসূল ও সুন্নাতে সাহাবা। আর কোথায় আমরা !

[1] সূরা আহকাফঃ ২০।

[2] ইমাম মালিক, আল-মুয়াত্তা (কাইরো, দারু এহইয়ায়িত তুরাসিল আরাবী, ১৯৫১) ২/৯৩৬, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৪৯৪।

[3] ইবনু মাজাহ, সুনান ২/১১১৫, কিতাবুল আত’ইমাহ, নং ৩৩৬১।