وَالْفَرْدُ مَا قَيَّدْتَه بِثِقَةِ | أَوْ جَمْعٍ اوْ قَصْرٍ عَلَى رِوَايَةِ
“আর ‘ফার্দ’ যা তুমি সংরক্ষণ করেছ একজন সেকাহ থেকে, অথবা বৃহৎ জমাত থেকে অথবা এক সনদ থেকে”। অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের ত্রয়োবিংশ প্রকার ‘ফার্দ’।
فَردُ এর আভিধানিক অর্থ বেজোড়।
‘ফার্দ’ দু’প্রকার:
১. ফার্দে মুতলাক ও ২. ফার্দে নিসবি। প্রত্যেক প্রকারের সংজ্ঞা আলাদা। লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ শুধু ফার্দে নিসবি উল্লেখ করেছেন। আমরা সম্পূরক হিসেবে ফার্দে মুতলাক উল্লেখ করব।
২. ফার্দে নিসবি তিন প্রকার:
ক. একজন সেকাহ রাবি থেকে গ্রহণকৃত হাদিস ফার্দ, যদিও তার একাধিক গায়রে সেকাহ বা দুর্বল রাবি রয়েছে। অতএব সেকাহ রাবির বিবেচনায় ফার্দ, সাধারণ রাবির বিবেচনায় ফার্দ নয়। তাই এ প্রকারকে ফার্দে নিসবি বা অপেক্ষাকৃত ফার্দ বলা হয়, যেমন নিম্নে বর্ণিত হাদিস[1]:
قال الإمام مسلم –رحمه الله - وحَدَّثَنَا إسحاق بْنُ إِبْرَاهِيمَ، أَخْبَرَنَا أَبُو عَامِرٍ الْعَقَدِيُّ، حَدَّثَنَا فُلَيْحٌ، عَنْ ضَمْرَةَ بْنِ سَعِيدٍ، عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُتْبَةَ، عَنْ أَبِي وَاقِدٍ اللَّيْثِيِّ، قَالَ: " سَأَلَنِي عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ عَمَّا قَرَأَ بِهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي يَوْمِ الْعِيدِ، فَقُلْتُ: بِـ اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَق وَالْقُرْآنِ الْمَجِيدِ ".
এ হাদিসের সনদে সাহাবির স্তরে আছেন আবু ওয়াকেদ আল-লাইসি, তার থেকে উবাইদুল্লাহ ইব্ন আব্দুল্লাহ ইব্ন উতবাহ, তার থেকে দামরাহ ইব্ন সায়িদ; বলা হয়: দামরাহ ইব্ন সায়িদ ব্যতীত কোনো সেকাহ রাবি এ হাদিস উবাইদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেনি, তাই এ হাদিস ফার্দ, তবে নিসবি ও অপেক্ষাকৃত ফার্দ, কারণ তার থেকে বর্ণনাকারী একাধিক দুর্বল রাবি রয়েছে।
খ. নির্দিষ্ট দেশ বা নগর বা বংশ থেকে বর্ণিত হাদিস[2], যেমন:
قال الإمام أبوداود- رحمه الله- حَدَّثَنَا أَبُو الْوَلِيدِ الطَّيَالِسِيُّ، حَدَّثَنَا هَمَّامٌ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ أَبِي نَضْرَةَ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، قَالَ: " أُمِرْنَا أَنْ نَقْرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَمَا تَيَسَّرَ ".
ইমাম হাকেম রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “এ হাদিস أُمِرْنَا শব্দ যোগে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু বসরার রাবিগণ বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসের সনদে সাহাবির স্তরে আছেন: আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু (মৃ৬৩হি.), তিনি মাদানি; তার থেকে বর্ণনাকারী আবু নাদরাহ (মৃ১০৮হি.), তিনি বসরি; তার থেকে বর্ণনাকারী কাতাদাহ (মৃ১১৭হি.), তিনি বসরি; তার থেকে বর্ণনাকারী হাম্মাম ইব্নু ইয়াহইয়া (মৃ১৬৪হি.), তিনি বসরি; তার থেকে বর্ণনাকারী আবুল ওয়ালিদ আত-তায়ালিসি (মৃ২২৭হি.), তিনি বসরি। অর্থাৎ এ হাদিসের সনদের প্রত্যেক রাবি ইমাম আবু দাউদ পর্যন্ত বসরার বাসিন্দা, একমাত্র সাহাবি ব্যতীত। বসরার সকল রাবি এ হাদিস أُمِرْنَا শব্দসহ বর্ণনা করেছেন। তাই এ হাদিস বসরিদের ফার্দ।
গ. কোনো শায়খ থেকে একজন রাবির একা কোনো হাদিস বর্ণনা করা, সে ব্যতীত ঐ শায়খ থেকে কেউ তা বর্ণনা করেনি, যদিও অন্যান্য শায়খ থেকে তার একাধিক সনদ রয়েছে। শায়খের একজন ছাত্র থেকে হাদিসটি প্রাপ্ত হিসেবে ফার্দ, কারণ তার অন্য কোনো ছাত্র তার থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেনি, তবে নিসবি কারণ অন্যান্য শায়খদের থেকে তাদের ছাত্রগণ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, যাদের বিবেচনায় নিলে হাদিস আযিয বা মাশহূর হতে পারে, যেমন:
قال الإمام أبوداود –رحمه الله- حَدَّثَنَا حَامِدُ بْنُ يَحْيَى، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، حَدَّثَنَا وَائِلُ بْنُ دَاوُدَ، عَنْ ابْنِهِ بَكْرِ بْنِ وَائِلٍ، عَنْ الزَّهْرِيِّ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ: أَنّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ " أَوْلَمَ عَلَى صَفِيَّةَ بِسَوِيقٍ وَتَمْرٍ ".
এ হাদিসের সনদে দেখছি: সাহাবির স্তরে আনাস ইব্ন মালিক, তার থেকে যুহরি, তার থেকে বকর ইব্ন ওয়ায়েল, তার থেকে পিতা ওয়ায়েল ইব্ন দাউদ, তার থেকে সুফিয়ান, তার থেকে হামেদ ইব্ন ইয়াহইয়া, তার থেকে ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ্[3]।
ইব্ন তাহের বলেন: এ হাদিস বকর থেকে একমাত্র ওয়ায়েল বর্ণনা করেছেন, তার থেকে শুধু সুফিয়ান। ছেলে বকর থেকে একমাত্র পিতা ওয়ায়েল বর্ণনা করেছেন, তাই এ হাদিস ফার্দে নিসবির তৃতীয় নাম্বার। এ প্রকার আবার গরিবও।
সাহাবিদের যুগে ফার্দের সংখ্যা বেশী, অনুরূপ তাবে‘ঈদের যুগেও বেশী, তবে সাহাবিদের অপেক্ষা কম। কারণ তাদের সংখ্যা অধিক, তারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিলেন। অনুরূপ তাদের অনুসারীদের যুগেও ফার্দের সংখ্যা অনেক, কিন্তু তাবে‘ঈদের তুলনায় অনেক কম। এ থেকে প্রমাণিত হয় ফার্দ দুর্বল হাদিসের একপ্রকার।
লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ ফার্দের ভাগ করে বুঝিয়েছেন যে, ফার্দ কখনো অপেক্ষাকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়, কখনো ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ১. সাহাবি, তাবে‘ঈ বা তাদের অনুসারীদের স্তরে ফার্দ; ২. নির্দিষ্ট দেশ, শহর বা বংশের বিবেচনায় ফার্দ; ৩. শায়খ ও ছাত্রের বিবেচনায় ফার্দ। ৪. সেকাহ ও দুর্বল রাবির বিবেচনায় ফার্দ।
প্রথম প্রকার মুতলাক বা সাধারণ ফার্দ, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রকার নিসবি বা অপেক্ষাকৃত ফার্দ। প্রথম প্রকার ফার্দ সাধারণত দুর্বল হয়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকার ফার্দ সহির নিকটবর্তী। কারণ দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকার হাদিস তাদের বিবেচনায় ফার্দ, কিন্তু অন্যদের বিবেচনায় আযিয ও মাশহূর হতে পারে, তাই সহির নিকটবর্তী।
১. ফার্দে মুতলাক:
ফার্দে মুতলাক বা সাধারণ ফার্দ: সনদের মূল তথা সাহাবির স্তরে যদি একজন রাবি থাকে তাহলে ফার্দে মুতলাক, আর সাহাবির স্তরে ফার্দ হবে যদি এক বা একাধিক সাহাবি থেকে একজন তাবে‘ঈ বর্ণনা করেন। সাহাবির সংখ্যা অধিক হলেও ফার্দ, কারণ তাবে‘ঈ একজন। তাবে‘ঈ সন্দেহের স্থান, সাহাবি সন্দেহের স্থান নয়, তাই তার স্তরে ফার্দ সন্দিহান। এ ফার্দ কখনো দূর হবে না, পরবর্তী রাবি পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে ফার্দে মুতলাক। ফার্দের এ প্রকারও গরিব।
একজন সাহাবি থেকে একাধিক তাবে‘ঈ রাবি হলে ফার্দে নিসবি, একাধিক তাবে‘ঈ থেকে একজন রাবি হলে ফার্দে নিসবিই থাকবে। অর্থাৎ একজন সাহাবি থেকে একাধিক তাবে‘ঈ রাবি হলে ফার্দে নিসবি, তথা সাহাবির বিবেচনায় ফার্দ, আবার একাধিক তাবে‘ঈ থেকে যদি তৃতীয় স্তরে একজন রাবি হয় তবুও ফার্দ। এ প্রকার ফার্দের ওজুদ সম্পর্কে জানা নেই, কারণ তাবে‘ঈর যুগে কোনো হাদিস প্রসিদ্ধি লাভ করে পরবর্তী যুগে ফার্দ হওয়া অসম্ভব না হলেও ওজুদ নেই। তাবে‘ঈর স্তরে একজন হলে ফার্দে মুতলাক, সাহাবির স্তরে একজন হলে ফার্দে নিসবি। সাহাবি ও তাবে‘ঈ উভয় স্তরে ফার্দ হলে ফার্দে মুতলাক। এটাই পরিভাষা, অন্যথায় সাহাবি একজন হলে ফার্দ মুতলাক হত, কিন্তু সাহাবির ফার্দ যেহেতু দোষণীয় নয়, তাই উসুলে হাদিসের পরিভাষায় ফার্দ বলা হয় না। কারণ, ফার্দ একপ্রকার দুর্বল হাদিস, সাহাবি একজন হলে হাদিস দুর্বল হয় না, অপেক্ষাকৃত ফার্দ বলা হয়।
ফার্দে মুতলাক দু’প্রকার:
ক. সাহাবি, তাবে‘ঈ ও তাদের পরবর্তী এক বা একাধিক রাবির ক্রমান্বয়ে একলা বর্ণিত হাদিস ফার্দ, যেমন নিয়তের হাদিস[4]:
قال الإمام البخاري – رحمه الله- حَدَّثَنَا الْحُمَيْدِيُّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ الزُّبَيْرِ، قَالَ: حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، قَالَ: حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ الْأَنْصَارِيُّ، قَالَ: أَخْبَرَنِي مُحَمَّدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ التَّيْمِيُّ، أَنَّهُ سَمِعَ عَلْقَمَةَ بْنَ وَقَّاصٍ اللَّيْثِيَّ، يَقُولُ: سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَلَى الْمِنْبَرِ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: " إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ ".
এ হাদিসে সাহাবির স্তরে ওমর ইব্নুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তিনি ব্যতীত কোনো সাহাবি এ হাদিস বর্ণনা করেনি; তার ছাত্র আলকামা ইব্নু ওয়াক্কাস আল-লাইসি, তিনি ব্যতীত ওমর ইব্নুল খাত্তাব থেকে কেউ এ হাদিস বর্ণনা করেনি; তার ছাত্র মুহাম্মদ ইব্নু ইবরাহিম আত-তাইমি, তিনি ব্যতীত আলকামা থেকে কেউ এ হাদিস বর্ণনা করেনি; তার ছাত্র ইয়াহইয়া ইব্নু সায়িদ আল-আনসারি, তিনি ব্যতীত মুহাম্মদ থেকে কেউ এ হাদিস বর্ণনা করেনি। ইয়াহইয়ার ছাত্র অনেক, তার পর থেকে হাদিস প্রসিদ্ধি লাভ করে।
এ হাদিস ফার্দে মুতলাক এবং গরিব, কারণ সাহাবি ও তাবে‘ঈর স্তরে একজন রাবি। এ হাদিস ফার্দে নিসবির প্রথম প্রকার, কারণ একজন সেকাহ রাবি বর্ণনা করেছে, দুর্বল কোনো রাবি বর্ণনা করুক বা না-করুক। এ হাদিস ফার্দে নিসবির তৃতীয় প্রকার, অর্থাৎ ওমর ইব্নুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইয়াহইয়া পর্যন্ত ফার্দ, তাই সনদের প্রথমাংশের বিবেচনায় ফার্দ, সাধারণত এ প্রকারকে গরিব বলা হয়, যদিও শেষাংশের বিবেচনায় মাশহূর।
খ. কোনো গ্রাম, বংশ বা নগরবাসীর বর্ণিত হাদিস ফার্দে মুতলাকের দ্বিতীয় প্রকার। কোনো সম্প্রদায় যদি একটি হাদিস বর্ণনা করে, অপর কোনো গ্রাম, নগর বা দেশবাসীর নিকট সে হাদিস না-থাকে তাহলে মুতলাক। সনদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল রাবি এক জায়গার তাই ফার্দে মুতলাক বলা হয়, এ প্রকার আবার ফার্দে নিসবির দ্বিতীয় প্রকারও বটে।জ্ঞাতব্য: ফার্দের কতক প্রকার কতক প্রকারে অনুপ্রবেশ করে, যেমন ফার্দে নিসবির দ্বিতীয় প্রকার ও ফার্দে মুতলাকের দ্বিতীয় প্রকারের সংজ্ঞা ও উদাহরণ এক। আবার ফার্দে নিসবির দ্বিতীয় প্রকার ও ফার্দে মুতলাকের প্রথম প্রকার এক, যদি হাদিসটি সেকাহ রাবি ব্যতীত দ্বিতীয় কেউ বর্ণনা না করে। ফার্দে মুতলাকের প্রথম প্রকার ও ফার্দে নিসবির তৃতীয় প্রকারকে গরিব বলা হয়। ভালো করে স্মরণ রাখুন।
[2] আবু দাউদ: (৮১৮)
[3] আবু দাউদ: (৩৭৪৪)
[4] বুখারি: (১), মুসলিম: (১৯১০)