কিন্তু এ সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে মানুষের দশটি প্রকার রয়েছে:
প্রথম প্রকার: ঐ সব মানুষ যারা মুসলিম, বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন, মুকীম, সামর্থ্যবান ও বাধামুক্ত।
এ প্রকার মানুষদের উপর রমযানের সাওম যথাসময়ে আদায় করা ওয়াজিব। কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার দলীলসমূহ এর উপর প্রমাণবহ।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«إِذَا رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ فَصُومُوا »
‘যখন তোমরা রমযানের চাঁদ দেখবে, তখন সিয়াম পালন করবে।’[1]
* আর পৃথিবীর সব মুসলিম রমযানের সিয়াম ফরয হওয়ার ব্যাপারে ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
কাফিরের ওপর সিয়াম ফরয নয় এবং কাফিরের সিয়াম বিশুদ্ধও হবে না। কারণ সে ইবাদত করার যোগ্য নয়। তাই যদি সে মাহে রমযানের মাঝখানে মুসলিম হয়, তাহলে বিগত দিনগুলোর সিয়াম কাযা করা তার উপর আবশ্যক নয়।
* কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِن يَنتَهُواْ يُغۡفَرۡ لَهُم مَّا قَدۡ سَلَفَ﴾ [الانفال: ٣٨]
‘যারা কুফরী করেছে তুমি তাদেরকে বল, যদি তারা বিরত হয় তাহলে অতীতে যা হয়েছে তাদেরকে তা ক্ষমা করা হবে।’ (সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৮)
তবে যদি কাফির রমযানের কোনো দিনের মধ্যভাগে মুসলিম হয়, তাহলে এই দিনের বাকী সময় সিয়াম পালন করা তার জন্য আবশ্যক। কারণ বিরত থাকার সময় পাওয়ার পর থেকে বিরত থাকার বিধান মানতে সে বাধ্য।
দ্বিতীয় প্রকার: নাবালেগ শিশু।
তার ওপর সিয়াম ফরয হবে না; যতক্ষণ না সে বালেগ হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثٍ: عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ، وَعَنِ الصَّغِيرِ حَتَّى يَكْبُرَ، وَعَنِ الْمَجْنُونِ حَتَّى يَعْقِلَ أَوْ يُفِيقَ
“তিন ব্যক্তির জন্য কলমের লিখন বন্ধ রাখা হয়েছে। (শর‘ঈ বিধানের বাধ্য-বাধকতার আওতামুক্ত রাখা হয়েছে) (১) ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগ্রত হবে, (২) নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হবে এবং (৩) পাগল যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরে আসবে।”[2]
কিন্তু সালাফে সালেহীনের অনুকরণ ও অনুসরণে অভিভাবগণ নিজ নিজ নাবালেগ সন্তানকে সিয়ামের চর্চা করাবে, যাতে বালেগ হওয়ার পর ইবাদত সহজ হয়।
কারণ, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাদের ছোট ছোট নাবালেগ সন্তানদের রোযা রাখাতেন এবং মসজিদে নিয়ে যেতেন এবং তাদের জন্য তুলা, পশম ইত্যাদির খেলনা বানিয়ে দিতেন। খাবার না পেয়ে কাঁদলে তারা ওই ছোট সন্তানদের খেলনা দিতেন, ওরা খেলনা পেয়ে খেলত এবং খাবারের কথা ভুলে যেত[3]।
আজকের দিনে অনেক অভিভাবককে এ বিষয়ে গাফেল ও উদাসীন দেখা যায়। তারা নাবালেগ শিশু-সন্তানদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন না। বরং আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতি অনুচিত মায়া দেখিয়ে সিয়াম পালনে নিষেধ করেন।
অথচ বাস্তবতা হলো, ইসলামের মৌলিক নিদর্শনাবলী ও তার মূল্যবান শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়াই সন্তানের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসার দাবী। সুতরাং যে অভিভাবক নাবালেগ শিশুসন্তানদের সিয়াম পালন থেকে নিষেধ করেন অথবা এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করেন, তিনি তাদের জন্য যালেম হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং নিজের উপরও। হ্যাঁ! যদি তারা সাওম পালন শুরু করে দেওয়ার পর তিনি দেখতে পান যে সিয়াম পালনে তাদের ক্ষতি হয়ে যাবে তখন তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করায় কোনো অসুবিধা নেই।
উল্লেখ্য, তিনটি বিষয়ের যে কোনো একটির মাধ্যমে পুরুষ সন্তানের বালেগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া প্রমাণিত হবে:
এক: স্বপ্নদোষ বা অন্য কোনোভাবে বীর্যপাত হওয়া।
* কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَإِذَا بَلَغَ ٱلۡأَطۡفَٰلُ مِنكُمُ ٱلۡحُلُمَ فَلۡيَسۡتَٔۡذِنُواْ كَمَا ٱسۡتَٔۡذَنَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡۚ﴾ [النور: ٥٩]
‘আর তোমাদের সন্তান-সন্ততি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তারাও যেন অনুমতি প্রার্থনা করে যেমনিভাবে তাদের অগ্রজরা অনুমতি প্রার্থনা করত।’ (সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫৯)
* অনুরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«غُسْلُ يَوْمِ الجُمُعَةِ وَاجِبٌ عَلَى كُلِّ مُحْتَلِمٍ»
‘প্রতিটি বালেগের জন্য জুম‘আর দিন গোসল করা ওয়াজিব।’[4]
দুই: নাভীর নিচের পশম গজানো। এ ব্যাপারে আতিয়া আল-কুরাযী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
عُرِضْنَا عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَوْمَ قُرَيْظَةَ، فَكَانَ مَنْ أَنْبَتَ قُتِلَ، وَمَنْ لَمْ يُنْبِتْ خَلَّى سَبِيلَهُ
‘যুদ্ধের দিন আমাদের বন্দি করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল। অতঃপর যাদের নাভীর নিচে পশম গজিয়েছিল, তাদের হত্যা করা হয়েছিল। যাদের পশম গজায়নি তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।’[5]
তিন: ১৫ বছর বয়সে উপনীত হওয়া।
* এ ব্যপারে আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,
«عُرِضْتُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ أُحُدٍ، وَأَنَا ابْنُ أَرْبَعَ عَشْرَةَ سَنَةً، فَلَمْ يُجِزْنِي »
‘‘আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উহুদ যুদ্ধের দিন যুদ্ধের জন্য পেশ করা হলো। আমার বয়স তখন ১৪ বছর ছিল। তিনি তখন আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন নি (আমি নাবালেগ বলে আমাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেন নি)’।’[6]
ইমাম বায়হাকী ও ইবনে হিব্বান সহীহ গ্রন্থে বিশুদ্ধ সনদে বর্ধিত আকারে বর্ণনা করেন: আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
«وَلَمْ يَرَنِي بَلَغْتُ ثُمَّ عُرِضتُ عَلَيْهِ يَوْمَ الْخَنْدَقِ وَأَنَا ابْنُ خَمْسَ عَشْرَةَ فَأَجَازَنِي»
‘তিনি মনে করেন নি যে আমি বালেগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি। অতঃপর খন্দকের যুদ্ধের সময় আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে যুদ্ধের জন্য পেশ করা হলো, তখন আমার বয়স ১৫ বছর। সে সময় তিনি আমাকে যু্দ্ধের অনুমতি দিলেন।’[7]
তাছাড়া বাইহাকী ও ইবন হিব্বান এর সহীহ গ্রন্থে সহীহ সনদে আরও এসেছে, «ورآني بلغتُ»“আর তিনি মনে করলেন যে, আমি বালেগ হয়েছি।”
قَالَ نَافِعٌ: فَقَدِمْتُ عَلَى عُمَرَ بْنِ عَبْدِ العَزِيزِ وَهُوَ خَلِيفَةٌ، فَحَدَّثْتُهُ هَذَا الحَدِيثَ فَقَالَ: «إِنَّ هَذَا لَحَدٌّ بَيْنَ الصَّغِيرِ وَالكَبِيرِ، وَكَتَبَ إِلَى عُمَّالِهِ أَنْ يَفْرِضُوا (يعني من العطاء) لِمَنْ بَلَغَ خَمْسَ عَشْرَةَ»
‘নাফে‘ (রহ.) বলেন, তারপর আমি উমর ইবনে আব্দুল আযীয (খলীফাতুল মুসলিমীন)-এর কাছে গমন করে এ হাদীসটি বর্ণনা করলে তিনি বললেন, “এটিই হলো ছোট ও বড়র মধ্যে সীমারেখা।” তারপর তিনি কর্মচারীদের উদ্দেশে লিখলেন, “যারাই ১৫ বছর বয়সে উপনীত হবে তাদের জন্যই রাজকোষ থেকে ভাতা নির্ধারণ করা হবে।’[8]
* আর মেয়েরা বালেগা (প্রাপ্ত বয়স্কা) হবে পুরুষদের বালেগ হওয়ার মতই তবে তাদের উপরোক্ত তিনটির সাথে চতুর্থ একটি আলমতও রয়েছে। আর সে চতুর্থটি হলো: হায়েয বা ঋতুবতী হওয়া।
সুতরাং যখন মেয়েদের হায়েয হয়, তখন তার ওপর শরীয়তের যাবতীয় নির্দেশ পালন করা আবশ্যক। যদিও বয়স ১০ বছর না হয়।
আর যদি কেউ রমযান মাসে দিনের বেলায় বালেগ-বালেগা হয়, তাহলে যদি সে দিন সাওম পালনরত অবস্থায় বালেগ-বালেগা হয় তাহলে সে তার সাওম পূর্ণ করবে। আর যদি সে দিন সাওম ভঙ্গকারী হিসেবে থাকে তবে দিনের বাকি সময় পানাহার থেকে বিরত থাকবে; কারণ সিয়াম পালন যাদের ওপর ওয়াজিব এক্ষনে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে তাকে এ দিনের সাওম কাযা করতে হবে না; কারণ সাওমের জন্য পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার সময় (সুবহে সাদিকের সময়) যাদের উপর পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হয় সে তখন তাদের অন্তর্ভু্ক্ত ছিল না।
তৃতীয় প্রকার: পাগল তথা সুস্থজ্ঞানশূন্য ব্যক্তি
সুতরাং পাগল, অচেতন ও মাতালের ওপর সিয়াম ফরয নয়। যেমন পূর্বোক্ত হাদীস থেকে জানা গেল: রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثٍ: عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ، وَعَنِ الصَّغِيرِ حَتَّى يَكْبُرَ، وَعَنِ الْمَجْنُونِ حَتَّى يَعْقِلَ أَوْ يُفِيقَ
‘তিন ব্যক্তির জন্য কলমের লিখন বন্ধ রাখা হয়েছে। (শর‘ঈ বিধানের বাধ্য-বাধকতার আওতামুক্ত রাখা হয়েছে) (১) ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগ্রত হবে, (২) নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হবে এবং (৩) পাগল যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরে আসবে।’[9]
পাগল যদি সিয়াম পালন করে তাহলে তা সহীহ হবে না। কারণ পাগলের কাছে এমন বিবেক নেই যা দ্বারা সে ইবাদত বুঝবে ও তার নিয়ত বুঝবে। আর নিয়ত ছাড়া ইবাদত বিশুদ্ধ হয় না। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى»
‘সকল আমল বা কাজে ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক মানুষের জন্য তা-ই রয়েছে যা সে নিয়ত করল।’[10]
যদি কখনও পাগলামী করে আবার কখনো সুস্থ হয়, তাহলে পাগলামী অবস্থা বাদে সুস্থ অবস্থায় সিয়াম পালন করা আবশ্যক। যদি দিনের মধ্য ভাগে পাগল হয়ে যায়, তাহলে তার সিয়াম বাতিল হবে না। যেমনিভাবে কেউ অসুস্থ বা অন্য কোনো কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো তার সিয়াম ভঙ্গ বা বতিল হয় না। কারণ সে সিয়ামের নিয়ত করেছে সুস্থ ও জ্ঞান থাকা অবস্থায়। বাতিল বলার সপক্ষে কোনো দলীল নেই; বিশেষ করে যখন এটা জানা যাবে যে, তার পাগলামী সুনির্দিষ্ট কিছু সময় সংঘটিত হয়ে থাকে। সুতরাং তার সিয়াম বাতিল হবে না।
তাই যেদিন পাগলামী করেছে ওই দিনের সিয়াম কাযা করাও আবশ্যক নয়।
আর যদি পাগল রমযান মাসে দিনের বেলায় সুস্থ হয়, তাহলে সেদিনের বাকি অংশ তার জন্য সিয়াম পালন আবশ্যক; কারণ সে তখন যাদের উপর সিয়াম পালন করা ফরয তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে তার ওপর এ সাওমটি কাযা করা আবশ্যক নয়। যেমনটি শিশু বালেগ হলে এবং কাফের মুসলিম হলে কাযা আবশ্যক হয় না।
চতুর্থ প্রকার: স্মৃতি হারানো ও ভালো-মন্দের তারতম্য বোধশূন্য বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি।
এ ধরণের ব্যক্তিদের ওপর সিয়াম পালন কিংবা মিসকীন খাওয়ানো কোনোটাই আবশ্যক নয়। কারণ ভালো-মন্দ নির্ণয় করার জ্ঞান না থাকার কারণে তিনি শরয়ী মুকাল্লাফ (বাধ্য-বাধকতা) অবস্থায় থাকেন না। এ ধরনের লোককে ভালো-মন্দ পার্থক্য করতে পারে না এমন শিশু হিসেবে গণ্য করা হবে।
যদি তাঁর কখনো পার্থক্য করার জ্ঞান থাকে আবার কখনো পার্থক্য করার জ্ঞান থাকে না এমন অবস্থা হয়, তাহলে পার্থক্য করার জ্ঞান থাকা অবস্থায় সাওম ফরয হবে। জ্ঞানশূন্য অবস্থায় ফরয হবে না। আর সালাত সিয়ামের মতোই। জ্ঞানহীন অবস্থায় সালাত পড়া আবশ্যক নয়, জ্ঞান থাকা অবস্থায় সালাত পড়া অবশ্যক।
পঞ্চম প্রকার: সাওম পালনে এমন ধারাবাহিক অক্ষম ব্যক্তি যার অক্ষমতা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই:
যেমন অতিশয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি বা এমন রোগী যার রোগ আরোগ্য হওয়া আশা করা যায় না। এর উদাহরণ হচ্ছে, ক্যানসার বা অনুরূপ রোগ। অতএব এমন ব্যক্তির জন্য সিয়াম পালন ফরয নয়। কারণ সে এতে অক্ষম।
* আর আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ ﴾ [التغابن: ١٦]
‘যতটুকু পার তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো।’ (সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৬)
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন:
﴿ لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ ﴾ [البقرة: ٢٨٦]
‘আল্লাহ সাধ্যের বাইরে কাউকে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।’ (সূরা আল-বাকারাহ্, আয়াত: ২৮৬)
তবে ওই অক্ষম ব্যক্তির জন্য প্রতি সাওমের বদলে রোজ একজন মিসকীনকে খাওয়ানো আবশ্যক। কারণ আল্লাহ তা‘আলা সাওম ফরয হবার প্রাথমিক সময়ে খাবার খাওয়ানোকে সাওম পালনের সমান বলে গণ্য করেছিলেন, যখন এতদোভয়ের যে কোনো একটি করার অনুমতি ছিল। সুতরাং সাওম পালনে অক্ষম ব্যক্তির জন্য প্রত্যেক সাওমের বদল হিসেবে খাবার খাওয়ানো সুনির্ধারিত হয়ে গেল; কারণ খাবার খাওয়ানো সাওম পালনের বিকল্প।
আর খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে দু’টির যে কোনোটি গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে,
প্রত্যেক মিসকীনকে আলাদাভাবে খাদ্য ভাগ করে দেয়া যায়। প্রত্যেকের জন্য এক মুদ্দ উন্নত গম, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সা‘ এর চারভাগের একভাগ। আর এক মুদ্দ এর পরিমান হচ্ছে, “আধা কিলো ও ১০ গ্রাম” ভারী ভালো গম।
আবার খাবারের আয়োজন চূড়ান্ত করে সব মিসকীনকে দাওয়াত দিয়ে নির্ধারিত দিনের হিসেব অনুযায়ী খাওয়ানো যেতে পারে।
ইমাম বুখারী বলেন:
وَأَمَّا الشَّيْخُ الْكَبِيرُ إِذَا لَمْ يُطِقْ الصِّيَامَ فَقَدْ أَطْعَمَ أَنَسٌ بَعْدَ مَا كَبِرَ عَامًا أَوْ عَامَيْنِ كُلَّ يَوْمٍ مِسْكِينًا خُبْزًا وَلَحْمًا وَأَفْطَرَ
‘বয়স্ক বৃদ্ধ লোক যখন সিয়াম পালনে অক্ষম হবেন, তখন তিনি আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর পদাংক অনুসরণ করবেন। আনাস বয়স্ক হবার পর এক বছর কিংবা দু’বছর প্রত্যেক দিন একজন মিসকীনকে রুটি ও মাংস খাওয়াতেন এবং সাওম ভাঙ্গতেন।[11]’
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বৃদ্ধ পুরুষ, বৃদ্ধা নারীর ব্যাপারে বলেছেন, তারা যদি সাওম পালনে অক্ষম হন, তাহলে প্রতি সাওমের স্থলে একজন মিসকীনকে খাওয়াবে।’[12]
আমার ভাইয়েরা! শরীয়ত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হিকমত ও রহমতস্বরূপ। আল্লাহ এর দ্বারা বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। কারণ এ শরীয়তের মূল ভিত্তিই হচ্ছে সহজতা ও প্রজ্ঞা এবং সুচারুরূপ ও প্রজ্ঞার উপর। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক ব্যক্তির অবস্থানুযায়ী সিয়াম ফরয করেছেন, যাতে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কার্য আঞ্জাম দিতে পারে এবং এর দ্বারা তার অন্তরে লাভ করে প্রশান্তি এবং মনে আসে তৃপ্তি। যাতে প্রত্যেকেই রব হিসেবে আল্লাহ, দীন হিসেবে ইসলাম ও নবী হিসেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সন্তুষ্ট হতে পারে।
সুতরাং হে মুমিনগণ, আপনারা আল্লাহর প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করুন, এ মূল্যবান দীনের ওপর আর আপনাদের হেদায়েতের মাধ্যমে যে অফুরন্ত নেয়ামত আপনাদের দিয়েছেন তার ওপর। কারণ পৃথিবীতে বহু মানুষ পথভ্রষ্ট ও পথহারা হয়ে গেছে। আর আল্লাহর নিকট আপনারা প্রার্থনা করুন যাতে তিনি আপনাদেরকে আমৃত্যু দীনের ওপর অটল ও অবিচল রাখেন।
হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে প্রার্থনা করছি; কারণ আপনিই আল্লাহ, আপনি ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই, আপনি একক অদ্বিতীয়, অমুখাপেক্ষী, যার কোনো সন্তান নেই, যিনি কারও সন্তান নন এবং কেউ তাঁর সমকক্ষ নন, হে মহিমান্বিত, সম্মানিত ও অনুগ্রহপ্রদর্শনকারী, হে আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা! হে চিরঞ্জীব, হে অবিনশ্বর! আমরা আপনার কাছে চাই যেন আপনি আমাদেরকে সেটার তাওফীক দিন যা আপনি আপনি পছন্দ করে এবং যাতে আপনি সন্তুষ্ট এবং আমাদের অন্তর্ভুক্ত করুন তাদের মধ্যে যারা আপনাকে রব হিসেবে, ইসলামকে দীন ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন। আপনার কাছে আরও প্রার্থনা করি, আপনি আমাদের আমৃত্যু এর ওপর স্থির ও অবিচল রাখুন। আর আপনি আমাদের জীবনের সমুদয় পাপরাশি ক্ষমা করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য করুণা বর্ষণ করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দাতা।আর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার, সাহাবীগণ ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব অনুসারীর ওপর।
[2] মুসনাদে আহমাদ ৬/১০০, ১০৪; আবূ দাউদ: ৪৩৯৮; নাসাঈ: ৬/১৫৬ নং ৩৪৩২; মুস্তাদরাকে হাকেম ২/৫৯।
[3] দেখুন, বুখারী: ১৯৬০; মুসলিম: ১১৩৬। হাদীসটি আশুরার সাওমের সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও ফরয সাওমের সাথে তা আরও বেশি যুক্তিযুক্ত। কারণ, তখন আশুরার সাওম ফরয ছিল, পরে সেটা সুন্নাত করে দিয়ে রমযানের সাওম ফরয করা হয়েছে। [সম্পাদক]
[4] বুখারী: ৮৭৯; মুসালিম: ৮৪৬।
[5] আহমদ: ৪/৩৪১, ৫/৩৭২; নাসাঈ: ৬/১৫৫, নং ৮৫৬৭।
[6] ইবন মাজাহ: ২৫৪৩।
[7] বাইহাকী: ৩/৮৩, ৬/-৫৫, ৮/২৬৪, ৯/২১,২২। ইবনে হিব্বান: ৪৭২৮।
[8] বুখারী: ২৬৬৪ ও ৪০৯৭।
[9] আবূ দাউদ: ৪৩৯৯; নাসাঈ: ৩৪৩২।
[10] বুখারী: ৬৬৮৯; মুসলিম: ১৯০৭।
[11] বুখারী (ব্যাখাগ্রন্থ ফাতহুল বারীসহ) : ৮/১৭৯
[12] বুখারী: ৪৫০৫।