ما يدخل في الإيمان باليوم الآخروما يكون في القبر
আখেরাতের প্রতি ঈমান আনয়নের মধ্যে যা রয়েছে: কবরে যা হবে:
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,
مِنَ الْإِيمَانِ بِالْيَوْمِ الْآخِرِ الْإِيمَانُ بِكُلِّ مَا أَخْبَرَ بِهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِمَّا يَكُونُ بَعْدَ الْمَوْتِ فَيُؤْمِنُونَ بِفِتْنَةِ الْقَبْرِ وَبِعَذَابِ الْقَبْرِ وَنَعِيمِهِ فَأَمَّا الْفِتْنَةُ فَإِنَّ النَّاسَ يُمْتَحَنُونَ فِي قُبُورِهِمْ فَيُقَالُ لِلرَّجُلِ: مَنْ رَبُّكَ؟ وَمَا دِينُكَ؟ وَمَنْ نَبِيُّكَ؟ فَيُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ فَيَقُولُ الْمُؤْمِنُ رَبِّيَ اللَّهُ وَالْإِسْلَامُ دِينِي وَمُحَمَّدٌ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِيِّي وَأَمَّا الْمُرْتَابُ فَيَقُولُ هَاهْ هَاهْ لَا أَدْرِي سَمِعْتُ النَّاسَ يَقُولُونَ شَيْئًا فَقُلْتُهُ فَيُضْرَبُ بِمِرْزَبَةٍ مِنْ حَدِيدٍ فَيَصِيحُ صَيْحَةً يَسْمَعُهَا كُلُّ شَيْءٍ إِلَّا الْإِنْسَانَ وَلَوْ سَمِعَهَا الْإِنْسَانُ لَصُعِقَ ثُمَّ بَعْدَ هَذِهِ الْفِتْنَةُ إِمَّا نَعِيمٌ وَإِمَّا عَذَابٌ
মৃত্যুর পর যা কিছু হবে বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন, তার সবগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাও আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়নের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা কবরের ফিতনা (পরীক্ষা), কবরের আযাব এবং কবরে মুমিনদেরকে যেই নেয়ামত প্রদান করা হবে, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।
সকল মানুষকেই কবরে পরীক্ষা করা হবে। মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার পর জিজ্ঞেস করা হবেঃ তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কী? তোমার নবী কে? আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآَخِرَةِ وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ﴾
ঈমানদারদেরকে আল্লাহ সঠিক কথার উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন দুনিয়ার জীবনে এবং আখেরাতে৷ আর যালেমদেরকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন৷ আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন। (সূরা ইবরাহীমঃ ২৭)
মুমিন ব্যক্তি তখন বলবেঃ আমার রব আল্লাহ, আমার দ্বীন ইসলাম এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার নবী। আর আখেরাতের বিষয়সমূহে সন্দেহ পোষণকারী বলবেঃ হায় আফসোস! হায় আফসোস! এ সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। তবে লোকেরা যা বলতো আমিও তাই বলেছি। অতঃপর লোহার ভারী একটি হাতুরি দিয়ে তাকে প্রহার করা হবে। এতে সে এমন উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করবে, যা মানুষ ও জিন ব্যতীত অন্যান্য সবসৃষ্টিই শুনতে পাবে। কোন মানুষ যদি তা শুনতো, তাহলে বেহুশ হয়ে পড়ে যেতো। কবরের এই ফিতনার পর রয়েছে নেয়ামত কিংবা আযাব।[1]
ব্যাখ্যাঃ আখেরাত দিবস বলতে কিয়ামতের দিনকে বুঝানো হয়েছে। আখেরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অন্যতম রূকন। মানুষের পরিশুদ্ধ বিবেক ও বোধশক্তি এবং সৃষ্টিগত স্বভাব এ কথাই প্রমাণ করে।[2] সমস্ত আসমানী কিতাব এই কথাটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট করেই বলেছে। সমস্ত নবী-রাসূল ইহা বিশ্বাস করার প্রতি মানুষকে আহবান করেছেন। কিয়ামত দিবসকে আখেরাত দিবস বা শেষ দিবস হিসাবে নামকরণ করার কারণ এই যে, দুনিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই দিন আগমণ করবে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়নের তাৎপর্য সম্পর্কে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। তা এই যে, মৃত্যুর পর যা হবে বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন, তার সবগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকেই আখেরাতের প্রতি ঈমান বলা হয়। সুতরাং দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়নের মধ্যে শামিল। যেমন মুমূর্ষু ব্যক্তির অবস্থা, কবরে মৃত ব্যক্তির অবস্থা, কবর থেকে পুনরুত্থান এবং পুনরুত্থানের পর মানুষের অন্যান্য অবস্থা। অতঃপর শাইখুল ইসলাম আখেরাতের অনেক বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
আখেরাতের বিষয়গুলো হতে কবরে যা হবে সে সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম বলেনঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা কবরের ফিতনা, কবরের আযাব এবং কবরে মুমিনদেরকে যেই নেয়ামত প্রদান করা হবে, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। এখানে শাইখ মূলত দু’টি বিষয় উল্লেখ করেছেন।
প্রথম বিষয়ঃ কবরের ফিতনা। الفتنة শব্দের আভিধানিক অর্থ পরীক্ষা করা। এখানে ফিতনা দ্বারা কবরে নাকীর-মুনকার নামক দু’জন ফেরেশতার প্রশ্ন উদ্দেশ্য। তারা মৃত ব্যক্তিকে বসিয়ে প্রশ্ন করবেন। শাইখুল ইসলাম বলেন, فَأَمَّا الْفِتْنَةُ فَإِنَّ النَّاسَ يُمْتَحَنُونَ فِي قُبُورِهِم فيقال للرجل সকল মানুষকেই কবরে পরীক্ষা করা হবে। মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার পর জিজ্ঞাসা করা হবেঃ তোমার রব কে? মৃত ব্যক্তি পুরুষ হোক বা নারী হোক। অধিকাংশ সময় যেহেতু পুরুষের কথাই উল্লেখ করা হয়, তাই এখানেও পুরুষকে উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর শাইখ ঐসব প্রশ্ন উল্লেখ করেছেন, যা মৃত ব্যক্তির সামনে পেশ করা হবে। মুমিন ব্যক্তি প্রশ্নগুলোর কী উত্তর দিবে এবং কাফের বা মুনাফেক কী উত্তর দিবে এবং প্রশ্নের জবাবের পরে কাফের বা মুনাফেক যেই আযাবের সম্মুখীন হবে এবং মুমিন ব্যক্তি যেই নেয়ামতের মধ্যে থাকবে, শাইখ তাও উল্লেখ করেছেন।
নাকীর-মুনকার ফেরেশতাদ্বয় যেই প্রশ্ন করবেন, তার প্রতি ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। কেননা তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এত সংখ্যক হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, হাদীছগুলো একসাথে মিলালে মুতাওয়াতিরের সীমায় পৌঁছে যায়। কুরআনুল কারীম দ্বারা কবরে ফিতনা বা প্রশ্নের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তিকে পরীক্ষার বিষয়টি সুপ্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآَخِرَةِ وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ﴾
মুমিনদেরকে আল্লাহ দুনিয়ার জীবনে সঠিক কথার উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন এবং আখেরাতেও৷ আর যালেমদেরকে আল্লাহ ভুলিয়ে দিবেন৷ আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন। (সূরা ইবরাহীমঃ ২৭)
ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রঃ) উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বারা বিন আযিব হতে বর্ণিত হাদীছ বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ কবরের আযাবের ব্যাপারে উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়েছে। ইমাম মুসলিম একটু বাড়িয়ে বলেছেন যে,
يقال له من ربك فيقول ربي الله ونبيي محمد فذلك قوله: يثبت الله الذين آمنوا بالقول الثابت ‘‘মৃত ব্যক্তিকে কবরে বলা হবে, তোমার রব কে? মুমিন ব্যক্তি বলবে, আমার রব আল্লাহ এবং আমার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহর এই বাণীতে উক্ত কথার সত্যতা মিলে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآَخِرَةِ﴾
‘‘মুমিনদেরকে আল্লাহ সঠিক কথার উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন দুনিয়ার জীবনে এবং আখেরাতে৷ সঠিক কথা বলতে এখানে তাওহীদের ঐ কালেমা উদ্দেশ্য, যা দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে মুমিনের অন্তরে দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছে। দুনিয়াতে মুমিনদেরকে তাওহীদের বাক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখার অর্থ হলো, সত্যের পথে যত কষ্ট ও নির্যাতন আসুক, তা সহ্য করে তারা উহাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। আর আখেরাতে উহার উপর প্রতিষ্ঠিত রাখার অর্থ হলো নাকীর-মুনকার নামক ফেরেশতাদ্বয়ের প্রশ্নের জবাব দেয়ার তাওফীক দান করা।
শাইখুল ইসলাম বলেনঃ وَأَمَّا الْمُرْتَابُ فَيَقُولُ هَاهْ هَاهْ আখেরাতের বিষয়সমূহে সন্দেহ পোষণকারীকে প্রশ্ন করা হলে সে বলেঃ হায় আফসোস! হায় আফসোস! هاه هاه এটি দ্বিধা-দ্বন্ধ, ব্যথা, বেদনা ও কষ্টের আওয়াজ। মুনাফেক বা সন্দেহ পোষণকারী আরো বলবেঃ এ সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। তবে লোকেরা যা বলতো আমিও তাই বলেছি। কেননা সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তাতে বিশ্বাস করেনি। কাজেই তাঁর পক্ষে সঠিক জবাব দেয়া অসম্ভব হবে। যদিও সে হয়ে থাকে দুনিয়াতে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং সুস্পষ্টভাষী। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ ‘‘আর যালেমদেরকে আল্লাহ তাআলা ভুলিয়ে দিবেন’’।
فَيُضْرَبُ بِمِرْزَبَةٍ مِنْ حَدِيدٍ অতঃপর লোহার ভারী একটি হাতুড়ি দিয়ে তাকে প্রহার করা হবেঃ লোহার বড় হাতুড়িকে مرزبة মারযাবা বলা হয়। এই হাতুরি দিয়ে তাকে প্রহার করা হবে। আঘাতের কারণে সে এমন উঁচু আওয়াজে চিৎকার করতে থাকবে, যার আওয়াজ মানুষ ও জিন ব্যতীত অন্যান্য সব সৃষ্টিই শুনতে পাবে। মানুষ সেই চিৎকার শুনলে কী অসুবিধা হতো অর্থাৎ মানুষকে সেই আওয়াজ না শুনানোর মধ্যে কী হিকমত রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ মানুষ যদি তা শুনতে পেত, তাহলে বেহুশ হয়ে পড়ে যেতো। অর্থাৎ মরে যেতো অথবা অজ্ঞান হয়ে যেতো। তাই আল্লাহ তাআলার হিকমতের দাবী এই যে, কবরে মৃত ব্যক্তির যা হবে, জীবিতরা তা অনুভব করবেনা। কেননা আল্লাহ তাআলা কবরের আযাবকে গাইবের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। তিনি যদি তা প্রকাশ করতেন, তাহলে যেই উদ্দেশ্যে তা গোপন রাখা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য ও হিকমত ঠিক থাকতোনা। সেটি হচ্ছে গায়েবের প্রতি ঈমান।[3]
দ্বিতীয় বিষয়ঃ কবরে মৃত ব্যক্তির আরো যা হবে, শাইখুল ইসলাম তার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেনঃ অতঃপর কবরের ফিতনা (প্রশ্নোত্তর পর্ব) শেষ হবার পর থেকে মহাপ্রলয় সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কবরবাসী কবরে শান্তি পেতে থাকবে অথবা শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। শাইখুল ইসলাম এই উক্তির মাধ্যমে কবরের আযাব ও নেয়ামত সাব্যস্ত করেছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাজহাব হচ্ছে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তি তার কবরে নেয়ামতের মধ্যে ডুবে থাকবে অথবা শাস্তিতে নিপতিত হবে। আর এটি হবে রূহ এবং দেহ উভয়ের জন্যই। যেমন এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মুতাওয়াতির হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং কবরের আযাব ও নেয়ামতের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ফরয। এর ধরণ এবং বৈশিষ্ট সম্পর্কে কথা বলা যাবেনা। মানুষের বোধশক্তি তা উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। কেননা উহা আখেরাতের বিষয়গুলোর অন্তর্ভূক্ত। আখেরাতের বিষয়গুলো আল্লাহ ছাড়া এবং তিনি যাদেরকে উহা থেকে যা কিছু জানিয়েছেন তারা ব্যতীত অন্য কেউ জানেনা। আল্লাহ তাআলা রাসূলদেরকে কবরের আযাবের কিছু কিছু আযাব শুনিয়েছেন।[4]
মুতাযেলা সম্প্রদায়ের লোকেরা কবরের আযাবকে অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে তাদের দলীল হচ্ছে তারা কবরের আযাব শুনেনা এবং মৃত ব্যক্তি কবরে শাস্তি ভোগ করছে এবং তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, -এটি তারা দেখেনা।[5]
তাদের এই দলীলের জবাব হলো, আমরা যদি কোন জিনিষ খুঁজে না পাই এবং না দেখি, তার অর্থ এই নয় যে, ঐ জিনিষটি আসলেই নাই অথবা কোন ঘটনা যদি আমরা ঘটতে না দেখি, তাহলে এমন কিছু বুঝার সুযোগ নেই যে, ঐ ঘটনা আসলেই সংঘটিত হয়নি।
এমন অনেক জিনিষ আছে, যা আমরা দেখিনা, অথচ উহা বিদ্যমান রয়েছে।[6] কবরের আযাব অথবা নেয়ামত ঐ বিষয়াবলীরই অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলা আখেরাত এবং উহার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে গায়েব তথা অদৃশ্যের বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করেছেন এবং এই পৃথিবীর মানুষের বোধশক্তির আয়ত্তের বাইরে রেখেছেন। যাতে গায়েবের প্রতি বিশ্বাসী মুমিনগণ অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়।[7] সর্বোপরি আখেরাতের বিষয়গুলোকে দুনিয়ার বিষয়াদির উপর কিয়াস করা যাবেনা।
কবরের আযাব দুই প্রকার। (১) চিরস্থায়ী আযাব। চিরস্থায়ী আযাব হবে কাফেরের। যেমন ফেরাউন সম্প্রদায় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সূরা গাফেরের ৪৬ নং আয়াতে বলেনঃ
﴿النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ﴾
‘‘দোযখের আগুনের সামনে তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় পেশ করা হয়৷ কিয়ামত সংঘটিত হলে নিদের্শ দেয়া হবে, ফেরাউনের অনুসারীদেরকে কঠিন আযাবে নিক্ষেপ করো’’৷ (২) এমন আযাব, যা নির্দিষ্ট একটি মেয়াদ পর্যন্ত চলতে থাকবে। অতঃপর উহা স্থগিত রাখা হবে। আর এটি হবে কতিপয় গুনাহগার মুমিনের আযাব। তাদেরকে অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হবে। অতঃপর তার আযাব কমানো হবে। জীবিত কোন ব্যক্তির দুআ, অথবা সাদকা কিংবা ক্ষমা প্রার্থনার কারণে তার আযাব একেবারেই বন্ধ হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
বারা বিন আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সাথে জনৈক আনসারী সাহাবীর জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য বের হলাম। তখনও কবরের খনন কাজ শেষ হয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিবলামুখী হয়ে বসে পড়লেন। আমরাও তাঁর চারপাশে বসে গেলাম। তাঁর হাতে ছিল একটি কাঠি। তা দিয়ে তিনি মাটিতে খুঁচাতে ছিলেন এবং একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর একবার যমীনের দিকে মাথা অবনত করছিলেন। তিনবার তিনি দৃষ্টি উঁচু করলেন এবং নীচু করলেন। অতঃপর বললেনঃ ‘‘তোমরা আল্লাহর কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাও’’। কথাটি তিনি দু’বার অথবা তিনবার বললেন। অতঃপর তিনি এই দু’আ করলেনঃ
أَللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوْذُبِكَ مِنْ عَذاَبِ الْقَبْرِ
‘‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাই।’’
তারপর তিনি বললেনঃ মুমিন বান্দার নিকট যখন দুনিয়ার শেষ দিন এবং আখেরাতের প্রথম দিন উপস্থিত হয় তখন আকাশ থেকে উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট একদল ফেরেশতা উপস্থিত হন। তাদের সাথে থাকে জান্নাতের পোষাক এবং জান্নাতের সুঘ্রাণ। মুমিন ব্যক্তির চোখের দৃষ্টি যতদূর যায় তারা ততদূর পর্যন্ত সারি বেঁধে বসে থাকেন। এমন সময় মালাকুল মাউত উপস্থিত হন এবং তার মাথার পাশে বসে বলতে থাকেনঃ হে পবিত্র আত্মা! তুমি আপন প্রভুর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে বের হয়ে আস। একথা শুনার পর মুমিন ব্যক্তির রূহ্ অতি সহজেই বের হয়ে আসে। যেমনভাবে কলসীর মুখ দিয়ে পানি বের হয়ে থাকে। রূহ বের হওয়ার সাথে সাথে ফেরেশতাগণ তাঁকে জান্নাতী পোষাক পরিয়ে দেন এবং জান্নাতী সুঘ্রাণে তাকে সুরভিত করেন। তার দেহ থেকে এমন সুঘ্রাণ বের হতে থাকে যার চেয়ে উত্তম সুঘ্রাণ আর হতে পারেনা। তাকে নিয়ে ফেরেশতাগণ আকাশের দিকে উঠে যান। যেখান দিয়েই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই খানের ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করেনঃ এটা কার পবিত্র আত্মা? উত্তরে অতি উত্তম নাম উচ্চারণ করে বলা হয় অমুকের পুত্র অমুকের। আকাশে পৌঁছে গিয়ে দরজা খুলতে বলা হলে তা খুলে দেয়া হয়। তাঁর সাথে প্রথম আকাশের ফেরেশতাগণ দ্বিতীয় আকাশ পর্যন্ত গমণ করেন। এভাবেই এক এক করে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যান। তখন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমার বান্দার নামটি ইল্লিয়ীনের তালিকায় লিপিবদ্ধ করে দাও। অতঃপর তাকে নিয়ে যমিনে ফিরে যাও। কেননা আমি তাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি, মাটির মধ্যেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং সেখান থেকেই তাকে পুনরায় জীবিত করব।
তখন কবরে তার আত্মা ফেরত দেয়া হয়। ওখানে দু’জন ফেরেশতা আগমণ করেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ তোমার প্রতিপালক কে? তিনি উত্তরে বলেনঃ আমার প্রতিপালক হচ্ছেন আল্লাহ। আবার জিজ্ঞেস করেনঃ দুনিয়াতে তোমার দ্বীন কি ছিল? তিনি উত্তর দেনঃ আমার দ্বীন ছিল ইসলাম। পুনরায় তাকে প্রশ্ন করেনঃ তোমাদের কাছে যে লোকটিকে পাঠানো হয়েছিল তিনি কে? জবাবে তিনি বলেনঃ তিনি হলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখন আকাশ থেকে মহান আল্লাহ ঘোষণা করতে থাকেনঃ আমার বান্দা সত্য বলেছে। তাঁর জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে জান্নাতের পোষাক পরিয়ে দাও। আর তাঁর জন্য জান্নাতের একটি দরজা খুলে দাও, যেন সে জান্নাতের বাতাস ও সুঘ্রাণ পেতে পারে। তার কবরটি দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করে দেয়া হয়। একজন সুন্দর আকৃতি ও উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট লোক উত্তম পোষাক পরিহিত অবস্থায় এবং সুঘ্রাণে সুরভিত অবস্থায় তার কাছে আগমণ করেন এবং বলেনঃ তুমি খুশী হয়ে যাও। তোমার সাথে যে ওয়াদা করা হয়েছিল তা আজ পূর্ণ করা হবে। মুমিন ব্যক্তি লোকটিকে জিজ্ঞেস করেনঃ আপনি কে? তিনি বলেন, আমি তোমার সৎ আমল। তখন মু’মিন ব্যক্তি বলেনঃ হে আল্লাহ! আপনি এখনই কিয়ামত সংঘটিত করুন। আমি আমার পরিবারের সাথে মিলিত হবো। তখন তাকে বলা হয় তুমি এখানে আরামে ও স্বাচ্ছন্দে বসবাস করতে থাক। তোমার কোন চিন্তা ও ভয় নেই।
অপর পক্ষে কাফের ব্যক্তির যখন দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণের সময় হয় তখন কালো বর্ণের একদল ফেরেশতা এসে উপস্থিত হন। তাদের সাথে থাকে দুর্গন্ধযুক্ত কাপড়। চোখের দৃষ্টি যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত সারি বেঁধে তারা বসে থাকেন। তারপর মৃত্যুর ফেরেশতা এসে তাকে বলেনঃ ওহে অপবিত্র আত্মা! বেরিয়ে আয় আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির দিকে। কাফের বা পাপীর আত্মা তখন দেহের মাঝে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফেরেশতা তাকে এমনভাবে টেনে বের করেন যেমনভাবে লোহার পেরেককে ভিজা পশমের মধ্য থেকে টেনে বের করা হয়। তার রূহ্ বের হওয়ার সময় শরীরের রগসমূহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার উপর আকাশ ও যমিনের মধ্যকার সকল ফেরেশতা লা’নত করতে থাকেন। আকাশের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রত্যেক দরজার ফেরেশতাগণ আল্লাহর কাছে দু’আ করেন যাতে ঐ ব্যক্তির রূহ তাদের দরজা দিয়ে না উঠানো হয়। তার রূহকে দুর্গন্ধযুক্ত কাপড়ে রাখা হয়। তা থেকে মরা-পঁচা মৃত দেহের দুর্গন্ধের ন্যায় দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। ফেরেশতাগণ তাকে আকাশের দিকে উঠাতে থাকেন। যেখান দিয়েই গমণ করেন সেখানের ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করেনঃ এই অপবিত্র আত্মা কার? উত্তরে ফেরেশতাগণ অতি মন্দ নাম উচ্চারণ করে বলতে থাকেনঃ অমুকের পুত্র অমুকের। আকাশে পৌঁছে তার জন্য আকাশের দরজা খুলতে বলা হলে আকাশের দরজা খোলা হয়না। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেনঃ
﴿لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ﴾
‘‘তাদের জন্য আকাশের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা যে পর্যন্ত না সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে’’। (সূরা আরাফঃ ৪০) তারপর বলা হয় সাত যমিনের নীচে সিজ্জীনে তার নাম লিখে দাও এবং তার রূহ যমিনের যেখানে দাফন করা হয়েছে সেখানে ফেরত দাও। কেননা আমি যমিন থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছি, যমিনেই ফিরিয়ে দিব এবং কিয়ামতের দিন যমিন থেকেই আবার বের করবো। তার রূহকে যমীনের দিকে নিক্ষেপ করা হয়। অতঃপর কাফেরের দেহ যেখানে দাফন করা হয়েছে রূহটি সেখানে গিয়ে পতিত হয়। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেনঃ
﴿وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنْ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ﴾
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করল সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল। অতঃপর মৃতভোজী পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল’’। (সূরা হজ্জঃ ৩১)
অতঃপর তার রূহকে দেহে ফেরত দেয়া হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তাকে দাফন করে যখন লোকেরা চলে যায় তখন দু’জন ফেরেশতা আগমণ করেন এবং কঠিনভাবে ধমকাতে থাকেন। অতঃপর তাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ তোর প্রভু কে? সে উত্তর দেয়ঃ আফসোস! আমি জানিনা। আবার জিজ্ঞেস করেনঃ তোর দ্বীন কি? জবাবে সে বলেঃ হায়! আমি তো এটা অবগত নই। তারপর জিজ্ঞেস করেনঃ তোদের কাছে যে লোকটিকে পাঠানো হয়েছিল তাঁর সম্পর্কে তোর ধারণা কী? সে উত্তরে বলেঃ হায় আফসোস! আমি তা জানিনা। তার সম্পর্কে মানুষ যা বলত আমিও তাই বলতাম। তখন আকাশ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করেনঃ এই লোক মিথ্যা বলছে। তাকে জাহান্নামের পোষাক পরিয়ে দাও, তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তার জন্য জাহান্নামের দরজা খুলে দাও। যাতে তার কাছে জাহান্নামের গরম বাতাসও তাপ পৌঁছতে পারে। তার কবর অতি সংকীর্ণ করে দেয়া হয়। মাটি তাকে এমনভাবে চেপে ধরে যাতে তার এক পার্শ্বের হাড় অপর পার্শ্বে ঢুকে যায়।
অতঃপর কালো চেহারা বিশিষ্ট, কালো পোষাক পরিহিত ও দুর্গন্ধযুক্ত এক ভয়ানক আকারের লোক এসে বলতে থাকেঃ তুই দুঃখের সংবাদ গ্রহণ কর। ধ্বংস হোক তোর! আজ তোর সেই দিন যার অঙ্গিকার তোর সাথে করা হয়েছিল। তখন কাফের বা মুনাফিক ব্যক্তি বলেঃ তোমার পরিচয় কি? তোমার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে তুমি কোন দুঃখের সংবাদ নিয়ে এসেছো। উত্তরে লোকটি বলেঃ আমি তোর সেই খারাপ আমল যা তুই দুনিয়াতে করেছিলে। আল্লাহর শপথ করে বলছিঃ তুই ছিলি আল্লাহর আনুগত্যের কাজে গাফেল এবং আল্লাহর নাফরমানীতে অগ্রগামী।
অতঃপর তার কবরে একজন বোবা ও বধির ফেরেশতা পাঠানো হয়। তার হাতে থাকে লোহার এমন একটি হাতুড়ি, সেটা দিয়ে যদি কোন কঠিন পাহাড়ে আঘাত করা হতো তাহলে উক্ত পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ধূলায় পরিণত হয়ে যেত। তা দিয়ে তাকে এমন জোরে প্রহার করা হয় যাতে সে মাটির সাথে মিশে যায়। আল্লাহ তাকে পুনরায় জীবিত করেন। ফেরেশতা আবার তাকে আঘাত করেন। সে এমন প্রকটভাবে চিৎকার করতে থাকে যার আওয়াজ জিন-ইনসান ব্যতীত সকল সৃষ্টিজীবই শুনতে পায়। অতঃপর তার জন্য জাহান্নামের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দেয়া হয়। কিয়ামতের দিন যেহেতু তার জন্য আরো কঠিন আযাব রয়েছে তাই সে বলবেঃ হে আল্লাহ! কিয়ামত যেন না হয়। (দেখুনঃ আহকামুল জানায়েয, পৃষ্ঠা নং- ২০২)
[2] - কেননা বিবেক ও যুক্তির দাবী হচ্ছে মানুষকে এই দুনিয়াতে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ছেড়ে না দেয়া। তারা শুধু এখানে পানাহার করবে, খেলতামাশা করবে, যা ইচ্ছা তাই করবে এবং তাদের কোন হিসাব নেওয়া হবেনা, -পরিশুদ্ধ বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত স্বভাব এটি সমর্থন করেনা। সুতরাং এমন একটি দিন থাকা দরকার, যেখানে মানুষের সকল কাজের হিসাব নেয়া হবে। কেননা দুনিয়াতে যারা অন্যের উপর যুলুম করে, কুফরী করে, নানা অপরাধ ও পাপাচারে লিপ্ত হয়, স্রষ্টাকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দেয়, তাদের অনেকেই দুনিয়াতেই শাস্তি পায়। ঐদিকে আবার অনেকেই দুনিয়ায় শাস্তি পাওয়ার আগেই স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করে।
আবার দেখা যায় অনেকেই ভাল কাজ করেও যথোপযুক্ত বিনিময় পায়না। অনেকেই সারা জীবন আল্লাহর আনুগত্য করেও দুনিয়াতে বিনিময় না পেয়েই মৃত্যু বরণ করে। তাই বিবেক বলে যে, এমন একটি দিন অবশ্যই থাকা দরকার, যেখানে সকল মানুষ তাদের ভাল-মন্দ সব কাজের বিনিময় পাবে। অন্যথায় এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করা এবং তাদের জন্য নবী-রাসূলের মাধ্যমে শরীয়ত পাঠানো অনর্থক। শুধু তাই নয়; মহান রাববুল আলামীনের আদল তথা ন্যায় বিচার ছুটে যায়। তাই আল্লাহ তাআলা মানুষের আমলের হিসাব নেওয়ার জন্য এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আখেরাত দিবস নামে একটি দিবস নির্ধারণ করেছেন। তাতে আল্লাহ তাআলা বনী আদমের প্রত্যেক আমলের হিসাব নিবেন, সবাইকে যথাযোগ্য প্রাপ্য প্রদান করবেন এবং তাঁর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ﴾
‘‘তোমরা কি মনে করেছিলে আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের কখনো আমার দিকে ফিরে আসতে হবেনা? (সূরা মুমিনুনঃ ১১৫)
[3] - কবরের আযাব গোপন রাখার হিকমত ও উদ্দেশ্য এই হতে পারে যে, তিনি যদি তা প্রকাশ করতেন আর আমরা যদি তা শুনতাম, তাহলে পৃথিবীর এই শান্তিময় ও সুশৃংখল পরিবেশ ঠিক থাকতোনা। তাই আল্লাহ তাআলা আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন এবং কবরের আযাবকে আমাদের থেকে আড়াল করে রেখেছেন। আমাদের বাস গৃহের পাশেই কবরে শায়িত থাকে আমাদেরই পিতা-মাতা, সন্তানাদি, ভাই-বোন, প্রিয়জন এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজন। তাদের কেউ আযাবে নিপতিত হলে (আল্লাহ তাদেরকে কবরের আযাব থেকে হেফাযত করুন) এবং আমরা তা শুনলে আমাদের বেঁচে থাকা এবং সুখ-শান্তিতে জীবন ধারণ করা দূর্বিসহ হয়ে উঠতো। কবরে আত্মীয়-স্বজনের এমনকি অন্য কারো আযাবের আওয়াজ শুনে কেউ শান্তিতে বসবাস করতে পারতোনা। তাই আল্লাহ তাআলা দয়া করে কবরের আযাবকে ঈমান বিল গাইবের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। সেই সাথে পৃথিবীতে আমাদের বসবাসকেও শান্তিময় এবং আরাম দায়ক করেছেন।
[4] - সহীহ হাদীসে এসেছে একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা অথবা মদীনার দু’টি নতুন কবরের নিকট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেনঃ
إنَّهُماَ لَيُعَذَّباَنِ وَماَ يُعَذَّباَنِ فِيْ كَبِيْرٍ ثُمَّ قَالَ: بَلَى أماَّ أحَدُهُماَ فَكاَنَ يَسْعَي بِالنَّمِيْمَةِ, وَأمَّا الآخَرَ فَكَانَ لاَ يَسْتَتِرُ مِنْ بَوْلِهِ ০০০০০
‘‘কবর দু’টির অধিবাসীদেরকে আযাব দেয়া হচ্ছে। আযাবের কারণ খুব বড় নয়। হ্যাঁ উহা বড় পাপই তো। তাদের একজন ছিল চোগলখোর এবং অপরজন পেশাব থেকে ভালভাবে পবিত্রতা অর্জন করতোনা’’ (বুখারী ও মুসলিম)
[5] - আখেরাতের হুকুম-আহকাম দুনিয়ার হুকুম-আহকামের সম্পূর্ণ বিপরীত। দুনিয়ার হুকুম-আহকামের সম্পর্ক শরীরের সাথে। রূহ তার অনুগামী। আর আখেরাতের হুকুম-আহকামের সম্পর্ক রূহের সাথে। শরীর তার অনুগামী। সুতরাং কবরে আযাব হবে রূহের উপর। শরীরও তা অনুভব করবে। মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা হোক, হিংস্র প্রাণী বা সাগরের মাছ খেয়ে ফেলুক, মাটিতে মিশে যাক কিংবা তাকে আগুনে পুড়ে ছাই বানিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হোক, -আযাব হবেই হবে। মৃত ব্যক্তির রূহ সেই আযাবের কষ্ট অনুভব করবে। শরীরও তার অনুগামী হয়ে শাস্তি ভোগ করবে।
কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পর আখেরাতে যখন মানুষ জান্নাতে অথবা জাহান্নামে যাবে তখন দেহের সাথে রূহ এমনভাবে যুক্ত হবে যে, আর কখনো বিচ্ছিন্ন হবেনা। তখন দেহ এবং রূহ উভয়ই শান্তি অথবা শাস্তি পাবে।
[6] - মানুষ এমন অনেক জিনিষের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, যা সে দেখেনা। বিশ্বাস করার জন্য দেখা জরুরী নয়। পৃথিবীর অনেক দেশের নাম শুনেছি, কিন্তু দেখিনি। অথচ আমরা ঐ সব দেশ আছে বলেই বিশ্বাস করি। কাফেররা মক্কায় প্রবেশ করতে পারেনা। তারা বই-পুস্তক পড়ে কিংবা প্রচার মাধ্যমে মক্কা নগরীর অস্তিত্বের কথা জানতে পেরেছে। তারা এবং যেসব মুসলিম এখনো মক্কায় প্রবেশ করেনি তারা মক্কা নগরী আছে বলে বিশ্বাস করে। সুতরাং বিশ্বাস করার জন্য দেখা জরুরী নয়।
ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্নে যা দেখে, তার কাছের জাগ্রত ব্যক্তিরা তা দেখেনা। জাগ্রত হয়ে সে যখন স্বপ্নের কথা বলে, অন্যরা তা বিশ্বাস করে। ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ যদি স্বপ্নে দেখে যে, তাকে পেটানো হচ্ছে এবং সে যদি চিৎকার করে, সেই চিৎকার তার পাশের লোকেরা শুনতে পায়না। অথচ ঘুমন্ত ব্যক্তি আসলেই কষ্ট পায় এবং জাগ্রত হয়েও সেই কষ্ট অনুভব করে। অনেকেই আবার ঘুমন্ত অবস্থায় সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করে শান্তি অনুভব করে। এটি কেউ অস্বীকার করেনা। কবরের আযাব ও নেয়ামতের বিষয়টি বিশ্বাস করার জন্য এই বাস্তব অভিজ্ঞতা সহায়ক হতে পারে।
কবরের আযাব যেহেতু আখেরাতের বিষয় এবং আখেরাতের জন্য যেহেতু দুনিয়ার জীবনের চেয়ে ভিন্ন কানুন (নিয়ম ও বিধান) রয়েছে, তাই কবরের আযাব জীবিতরা দেখবেনা, শুনবেওনা। এমনকি দুইজন মানুষকে একই কবরে পাশাপাশি রাখা হলে সেখানে একজনের আযাব হলে এবং অন্যজন আরামে থাকলে তাদের একজন অন্যজনের অবস্থা জানতে পারেনা। যেমন পাশাপাশি দুইজন ঘুমন্ত ব্যক্তিই স্বপ্নে দেখলে একজনের স্বপ্ন অন্যজন জানতে পারেনা।
কবরের আযাব বা নেয়ামত গায়েবী বিষয় হলেও আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা কবরের আযাব দেখিয়ে থাকেন। যেমন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবরের আযাব দেখানো হয়েছে। ইবনে রজব (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের যাকে ইচ্ছা কবরের আযাব দেখিয়ে থাকেন। ইতিহাস বলে যে, অনেকেই কবরের আযাব দেখেছেন। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রঃ) তাঁর কিতাবুর্ রূহে এবং ইবনে আবীদ দুনয়া তার কিতাবুল কুবুরে এরকম অনেক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহই এগুলোর সত্যতা সম্পর্কে অধিক জানেন।
[7] - কবরের আযাব গোপন রাখার মধ্যে আরো যেসব বড় বড় হিকমতে ইলাহী লুকায়িত রয়েছে, তার মধ্যে এও রয়েছে যে, (১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ মৃতদেরকে দাফন করা থেকে বিরত থাকার আশঙ্কা না থাকলে আমি আল্লাহ তাআলার কাছে দু’আ করতাম, তিনি যেন তোমাদেরকে কবরের আযাব থেকে কিছু শুনান। (২) কবরের আযাব গোপন রাখার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মৃতের পরিবারের প্রতি রহম করেছেন। কেননা তারা যদি তাদের মাইয়্যেতের আযাব ও চিৎকার শুনতো, তাহলে তারা স্থির থাকতে পারতোনা। (৩) আযাব গোপন রাখার মাধ্যমে মৃতের মান-মর্যাদার দিকটার প্রতিও খেয়াল রাখা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তার জীবিত আত্মীয় স্বজনকে তার বেহাল অবস্থা জানাতে চান নি। (৪) মৃতের পরিবারের মান-ইজ্জতের প্রতিও খেয়াল রাখা হয়েছে। কেননা মাইয়্যেতের আযাব শুনলে লোকেরা হয়ত তার আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে দোষারোপ করে বলতোঃ এই তো তোমার পিতাকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, এই তো তোমার মা খুব আযাবে আছে! এই তো তোমার ছেলে.....ভাই... ইত্যাদি। (৫) আযাবের আওয়াজ ও চিৎকার শুনেই কারো মৃত্যু হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল। কেননা এই আওয়াজ সাধারণ আওয়াজ নয়। এতে অন্তর ফেটে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলে মৃত্যু অথবা অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু তাই নয়; এর ফলে পৃথিবীর এই সুন্দর নিয়ম-কানুন লন্ড-ভন্ড হয়ে যেত, যা হিকমতে ইলাহীর খেলাফ। (৬) মানুষ যদি আযাবে নিপতিত লোকদের এই চিৎকার শুনতো, তাহলে ঈমান বিল গায়েব (না দেখে বিশ্বাস করা) ঈমান বিল মুশাহদাহয় (দেখে বিশ্বাস করায়) পরিণত হতো। আর আযাব ও নিদর্শন দেখিয়ে কাউকে বিশ্বাসী বানিয়ে পরীক্ষা করার কোন অর্থই হয়না এবং সেই বিশ্বাসের কোন মূল্যও থাকেনা। কেননা কিয়ামতের পূর্বে যখন মানুষ পশ্চিমাকাশে সূর্য উঠতে দেখবে, তখন সকলেই ঈমান আনয়ন করবে। কিন্তু সেই ঈমান কোন উপকারে আসবেনা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا﴾
‘‘যে দিন তোমার পালনকর্তার নিদর্শনসমূহের কিছু এসে যাবে তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোন উপকারে আসবেনা যে পূর্ব থেকে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কোন সৎকাজ করেনি’’। (সূরা আনআমঃ ১৫৮)