ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ঈমানের রুকনসমূহ ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
الإيمان بالقدر خيره وشره তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনয়ন করা

الإيمان بالقدر خيره وشره তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনয়ন করা: তাকদীরের ভাল ও মন্দের[1] উপর ঈমান আনয়ন করার অর্থ হচ্ছে, অন্তর দিয়ে এই দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তাআলা মাখলুক সৃষ্টি করার আগেই সমস্ত বস্ত্তর তাকদীরসমূহ এবং উহার সময়কাল সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। অর্থাৎ প্রত্যেক সৃষ্টির ভাগ্যে কী রয়েছে এবং তা সে কখন পাবে? আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সৃষ্টি করার পূর্ব হতেই অবগত আছেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা স্বীয় ইলম মোতাবেক উহাকে লাওহে মাহফুযে লিখে দিয়েছেন। অতঃপর স্বীয় ক্ষমতা ও ইচ্ছা দ্বারা প্রত্যেক সৃষ্টিকে তার নির্ধারিত সময়ে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং ভাল-মন্দ প্রত্যেক সৃষ্টিই তাঁর ইলম, তাঁর নির্ধারণ, তাঁর ইচ্ছা অনুপাতেই হয়ে থাকে। তাই আল্লাহ তাআলা যা চান, তা হয়। আর তিনি যা চান না, তা হয়না।

এই ছিল ঈমানের মূলনীতিগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ। ইনশা-আল্লাহ এই মূলনীতিগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা সামনে আসছে।


[1] - তাকদীরকে ভাল ও মন্দ এই দু’টি বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে। তাকদীরের ভাল বিষয়গুলো তো সুস্পষ্ট। মানুষ ইহপরকালে যেসব কল্যাণ অর্জন করবে, তা আল্লাহ তাআলা পূর্ব থেকেই অবগত আছেন এবং তিনি তা নির্ধারণ করেছেন। এমনি তাকদীরের মন্দ বিষয়গুলোও আল্লাহ তাআলা তাঁর ইলমে আযালীর (চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর জ্ঞানের) মাধ্যমে অবগত আছেন। তাকদীরের মধ্যে যেহেতু অকল্যাণও রয়েছে, তাই স্বভাবত একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, তাহলে কি আল্লাহ তাআলা মন্দ জিনিষও সৃষ্টি করেন এবং বান্দার জন্য নির্ধারণ করেন? আল্লাহর কাজের মধ্যেও কি অকল্যাণকর কিছু আছে?

এই প্রশ্নের জবাবে শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন অত্যন্ত সুন্দর কথা বলেছেন এবং তিনি বেশ কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি খোলাসা করেছেন। পাঠক সমীপে এখানে তা উল্লেখ করা হলো।

তিনি বলেনঃ এখানে তাকদীরের অকল্যাণ বলতে ঐসব অকল্যাণ উদ্দেশ্য, যা রয়েছে আল্লাহর সৃষ্টি ও নির্ধারিত বস্ত্ত ও বিষয়ের মধ্যে। তাকদীরের অকল্যাণ তথা ঐ নির্ধারণের অকল্যাণ উদ্দেশ্য নয়, যা আল্লাহর ক্রিয়া ও কাজ। কেননা আল্লাহর কাজের মধ্যে কোন অকল্যাণ নেই। তাঁর সকল কাজই ভাল এবং তাঁর প্রত্যেকটি কাজই হিকমত ও প্রজ্ঞা পূর্ণ। তবে আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন এবং যা তিনি নির্ধারণ করেছেন, তার কোন কোনটিতে অকল্যাণ রয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ভাগ্যে যা নির্ধারিত রয়েছে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যা সৃষ্টি করেছেন, তাতে অকল্যাণ রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর কোন فعل বা কাজের মধ্যে অকল্যাণ নেই। এই জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ والشر ليس إليك তোমার দিকে অকল্যাণের সম্বন্ধ শোভনীয় নয়।

বিষয়টি খোলাসা করার জন্য উদাহরণ পেশ করা দরকার। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি করেছেন এবং যা নির্ধারণ করেছেন, তার মধে ক্ষতির সৃষ্টিও রয়েছে। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে সাপ, বিচ্ছু, হিংস্র জীব-জন্তু, বিভিন্ন প্রকার রোগ-ব্যধি, অভাব-অনটন, দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি এবং এ ধরণের আরো কিছু। এগুলো মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কেননা এগুলো মানুষের চাহিদার পরিপন্থী। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে পাপাচার, অশ্লীলতা, কুফুরী, অবাধ্যতা, হত্যা এবং আরো বহু অন্যায় কাজ-কর্ম। এসব মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে এগুলো কল্যাণকর। কেননা আল্লাহ তাআলা এগুলোকে এক বিরাট ও সুমহান উদ্দেশ্যে সৃষ্টি ও নির্ধারণ করেছেন। যে ব্যক্তি তা জানতে পেরেছে, সে তো উহার হিকমত জানলই। পক্ষান্তরে যে উহা জানতে পারেনি, সে তো উহা সম্পর্কে অজ্ঞই রয়ে গেল।

সুতরাং আমাদের জানা আবশ্যক যে, তাকদীরে যেই অকল্যাণ থাকার কথা বলা হয়েছে, তা আল্লাহর সৃষ্টিসমূহ এবং তাঁর নির্ধারিত বস্ত্ত ও বিষয়গুলোর দিক থেকেই। আল্লাহর ঐ তাকদীরের দিক বিবেচনায় নয়, যার দ্বারা আল্লাহর নির্ধারণ এবং আল্লাহর কাজ বুঝায়। কেননা আল্লাহ বান্দার জন্য অকল্যাণ কিছুতেই করেন না।

অতঃপর হে পাঠক! আপনি জেনে রাখুন যে, আল্লাহর যেই সৃষ্টি অকল্যাণকর, তার মধ্যে মূলতই অকল্যাণ থাকতে পারে; কিন্তু অন্যদিক বিবেচনায় তাও কল্যাণকর। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ﴾

মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যার ফলে তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করানো যায়, হয়তো তারা ফিরে আসবে’’। (সূরা রুম: ৪১) সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিপর্যয়ের ফলাফলও ভাল। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় বিষয়টিতে তথা বিপর্যয় ও বিশৃংখলার যেই অকল্যাণ রয়েছে, তা তুলনামূলক ও আপেক্ষিক। অর্থাৎ একদিক থেকে অকল্যাণকর এবং অন্যদিক থেকে কল্যাণকর। সম্পূর্ণরূপে এবং প্রকৃতপক্ষে তা ক্ষতিকর নয়। কেননা অচিরেই এর ফলাফল ভাল হবে।

ব্যভিচারী ও মদখোরকে শাস্তি দেয়ার বিষয়টিও উদাহরণ স্বরূপ আসতে পারে। ব্যভিচারী অবিবাহিত হলে একশটি বেত্রাঘাত করাসহ একবছর পর্যন্ত দেশান্তর করতে হবে। কোন সন্দেহ নেই যে, এটি তার জন্য কষ্টকর। কেননা তার চাহিদার জন্য এটি উপযোগী নয়। কিন্তু অন্যদিকে এটি তার জন্য কল্যাণকর। শাস্তি প্রয়োগ করার কারণে তার গুনাহএর কাফফারা হবে। এটি ভাল। কেননা দুনিয়ার শাস্তি আখেরাতের শাস্তির চেয়ে সহজতর। সুতরাং দুনিয়াতে শাস্তি ভোগ করা তার জন্য ভাল। এই শাস্তি প্রয়োগের আরেকটি কল্যাণকর দিক হলো, তা দেখে অন্যরা সাবধান হবে। ফলে তা অন্যের জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ হবে। কেননা অন্যরা যখন ব্যভিচারের দিকে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা করবে এবং যখন সে জানতে পারবে যে, অমুক যেনাকারীকে যেই শাস্তি দেয়া হয়েছে, তার উপরও তা প্রয়োগ করা হবে, তখন সে এই জঘণ্য অপরাধ থেকে বিরত থাকবে। যাকে ব্যভিচারের শাস্তি দেয়া হলো, তার জন্য এই শাস্তি অন্য একদিক থেকেও ভাল হতে পারে। তা এই যে সে ভবিষ্যতে আর ব্যভিচারের দিকে অগ্রসর হবেনা।

আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যেও কিছু সৃষ্টি ক্ষতিকর। এটি শুধু মানুষকে কষ্ট দিবে- এই জন্য আল্লাহ উহা সৃষ্টি করেন নি। বরং নির্ধারিত বস্ত্ত হিসাবে গণ্য করার দিক থেকে তা ক্ষতিকর। উদাহরণ স্বরূপ রোগ-ব্যধির কথা বলা যেতে পারে। মানুষ যখন অসুস্থ হয়, তখন তার সেই অসুস্থতা অব্যশই কষ্টদায়ক। কিন্তু বাস্তবে সেই অসুখের মধ্যে তার জন্য বিরাট এক কল্যাণ রয়েছে। এর মাধ্যমে তার গুনাহ মাফ হয়। কখনো মানুষের এমন গুনাহ থাকে, যা তাওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে মাফ হয়না। গুনাহ মাফ হওয়ার পথে কোন না কোন প্রতিবন্ধক থাকার কারণেই এ রকম হয়। নিয়ত ও ইখলাসের মধ্যে ত্রুটি থাকার কারণে এবং আল্লাহর সাথে সত্যবাদী না হওয়ার কারণে এমনটি হতে পারে, তাই এসব অসুস্থতা এবং শাস্তির মাধ্যমে এই গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়।

রোগ-ব্যধির অন্যতম কল্যাণ হচ্ছে যে, সুস্বাস্থ্যের মূল্য বুঝা। সুস্বাস্থ্য যে একটি আল্লাহ তাআলার কত বড় নিয়ামত, মানুষ তা মূল্যায়ন করতে জানেনা। তবে সে যখন অসুস্থ হয়, কেবল তখনই এর মূল্য বুঝতে সক্ষম হয়। আমরা যখন সুস্থ থাকি, তখন সুস্থ থাকার মূল্য বুঝিনা। কিন্তু যখন অসুস্থ হয়ে যাই, তখন স্বাস্থ্যের মূল্য বুঝি। কথায় বলেঃ الصحة تاج على رؤوس الأصحاء لايعرفها إلا المرضى সুস্থতা সুস্থ লোকের মাথার মূকুট স্বরূপ। অসুস্থ ব্যতীত অন্য কেউ তা দেখতে পায়না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে অসুস্থ হওয়াও ভাল। যাতে করে আপনি সুস্থতার মূল্য অনুভব করতে পারেন।

অসুস্থ হওয়ার আরেকটি ভাল দিক হচ্ছে কোন কোন রোগের মধ্যে এমন জিনিষ থাকে, যা শরীরের অন্যান্য রোগ জীবাণু ধ্বংস করে দেয়। রোগ ছাড়া অন্য কিছু এই জীবাণুকে হত্যা করতে পারেনা। ডাক্তারগণ বলে থাকেনঃ কতক রোগ শরীরের অন্যান্য বড় বড় রোগজীবাণু হত্যা করে। অথচ আমরা টের পাইনা।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি, প্রথমতঃ যেই অকল্যাণ দ্বারা তাকদীরকে বিশেষিত করা হয়েছে, আল্লাহর সৃষ্ট বস্ত্ত ও নির্ধারিত বস্ত্তর দিক থেকে হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যা করেন, তার সবকিছু কল্যাণের জন্যই করেন। এই কথার দলীল হচ্ছে, وَالشَّرُّ لَيْسَ إِلَيْكَ অকল্যাণকে তোমার দিকে সম্বোধিত করা শোভনীয় নয়।

দ্বিতীয়ত: কিছু কিছু মাখলুকের মধ্যে যেই অকল্যাণ রয়েছে, তা শুধুই ক্ষতিকর নয়। কেননা এই অকল্যাণ থেকে কখনো এমন অনেক কল্যাণ চলে আসে, যা মানুষের জন্য খুবই উপকারী। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন মসীবতে নিপতিত হলো, তার জন্য ঐ মসীবত একদিক থেকে কষ্টদায়ক এবং অন্যদিক মূল্যায়নে উহা তার জন্য কল্যাণকর। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নিকট তাকদীরের স্তর সম্পর্কে আলোচনা করার সময় এ বিষয়ে আরো আলোচনা সামনে আসবে ইনশা-আল্লাহ।