ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর সংক্ষিপ্ত জীবনী ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
ওয়াহদাতুল উজুদ ও সর্বেশ্বরবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

অষ্টম হিজরী শতকে দু’টি দার্শনিক মতবাদ মুসলিম সুফী ও দার্শনিকদের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠে। ইমাম ইবনে তাইমীয়াকে এ ভ্রান্ত মতবাদ দু’টির বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করতে হয়। একটি হলো ওয়াহদাতুল উজুদ এবং অন্যটি হুলুল ও ইত্তেহাদ। আমাদের ভারতবর্ষের দার্শনিক পরিভাষায় এ মতবাদ দু’টিকে বলা হয় অদ্বৈতবাদ ও সর্বেশ্বরবাদ। পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সুফীদের মধ্যেও এ মতবাদ দু’টি প্রবেশ করে। আনন্দের বিষয় হলো, মুজাদ্দেদ আলফেসানী এই মতবাদ দু’টির বিরুদ্ধে প্রচন্ড সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। তবে অতি দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, ভারতবর্ষের সুফীদের মধ্যে আজও এই মতবাদ দু’টির উপস্থিতি প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায়।

এখন পাঠকগণ প্রশ্ন করতে পারেন, আসলে এই মতবাদ দু’টির ব্যাখ্যা কী? ইমাম ইবনে তাইমীয়া এই মতবাদ দু’টির প্রধান প্রবক্তা মুহীউদ্দীন ইবনে আরাবীর উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, অস্তিত্ব মাত্র একটি। সৃষ্টির অস্তিত্বই স্রষ্টার অস্তিত্ব। (নাউযুবিল্লাহ) তারা স্রষ্টা ও সৃষ্টি, -এ দু'টো পৃথক সত্তা হিসাবে তারা স্বীকার করেনা। বরং তাদের মতে স্রষ্টাই হলো সৃষ্টি আর সৃষ্টিই হলো স্রষ্টা। তাদের মতে বনী ইসরাঈলের যারা বাছুর পূজা করেছিল, তারা আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল। তারা আরো বলে, ফেরাউনের ‘‘আনা রাববুকুমুল আ’লা’’ অর্থাৎ আমি তোমাদের মহান প্রভু, -এই দাবীতে সত্যবাদী ছিল। ইবনে আরাবী নূহ আলাইহিস সাল্লামের সমালোচনা করে বলে যে, তার কাওমের লোকেরা মূর্তি পূজার মাধ্যমে আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল। আর তাঁর সময়ের মহাপ্লাবন ছিল মারেফতে ইলাহীর প্লাবন। এ প্লাবনে তারা ডুবে গিয়েছিল।
ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ওয়াহদাতুল উজুদ ও সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী মতবাদের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করাকে তাতারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।
সৃষ্টি এবং স্রষ্টা কখনই এক হতে পারে না। আমরা মস্তিস্কের মধ্যে যা কল্পনা করি তার সবগুলোর অস্তিত্ব মস্তিস্কের বাইরে খুঁজে পাওয়া যায়না। আমার মাথায় দশহাত বিশিষ্ট এবং তিন মুখ বিশিষ্ট মানুষের কল্পনা জাগতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, বাস্তবে এই ধরণের মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে। মস্তিস্কের বাইরে যেসব বস্ত্তর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে, তা মূলতঃ দুই প্রকার। (১) সৃষ্টি ও (২) স্রষ্টা। পৃথিবীতে এমন কোন জিনিষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যা এমনিতেই হয়ে গেছে। প্রত্যেক জিনিষের একজন উদ্ভাবক ও কারিগর রয়েছে। তাদের উভয়ের স্বভাব এবং বৈশিষ্ট এক ও অভিন্ন নয়। বরং কম্পিউটারের বৈশিষ্ট এবং যে উহা তৈরী করেছে, তার স্বভাব ও বৈশিষ্ট একরকম নয়। মহান আল্লাহ স্বীয় জ্ঞান, কুদরত এবং ইচ্ছা দ্বারা এই আসমান-যমীন ও এতোদুভয়ের মধ্যকার সকল বস্ত্ত তৈরী করেছেন। সুতরাং তিনি এবং তাঁর তৈরী মাখলুক এক হয় কিভাবে? তাঁর সুউচ্চ সিফাত এবং সৃষ্টির সাধারণ স্বভাব ও বৈশিষ্ট এক রকম হয় কিভাবে?
আল্লাহ্ ব্যতীত বাকী সকল বস্ত্ত হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ مَا لَكُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا شَفِيعٍ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ﴾


‘‘আল্লাহই আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দুইয়ের মাঝখানে যা কিছু আছে সব সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে এবং এরপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন তিনি ছাড়া তোমাদের কোন সাহায্যকারী নেই এবং নেই তার সামনে সুপারিশকারী, তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা?’’ (সূরা সাজদাহ: ৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنَّى يَكُونُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُنْ لَهُ صَاحِبَةٌ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾


‘‘তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। কিরূপে আল্লাহর পুত্র হতে পারে, অথচ তাঁর কোন সঙ্গিনী নেই? তিনি যাবতীয় কিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি সব বস্তু সম্পর্কে সুবিজ্ঞ। (সূরা আনআম: ১০১)
বাস্তব কথা হচ্ছে, অস্তিত্ব একটি নয়; বরং দু’টি। একটি স্রষ্টার (আল্লাহর) অস্তিত্ব, আরেকটি সৃষ্টির অস্তিত্ব।
কুরআন ও সহীহ হাদীছে দিবালোকের মত পরিস্কার করে বলা আছে যে, মহান আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, তিনি আরশের উপরে সমুন্নত, তার সুউচ্চ গুণাবলী সৃষ্টি জীবের গুণাগুণ, স্বভাব ও বৈশিষ্ট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সাথে মিশ্রিত নন, কোন সৃষ্টির ভিতরে নন; যেমন সুফীরা ধারণা করে থাকে। বরং তিনি সৃষ্টির বহু উপরে, সকল সৃষ্টি তার নীচে, তিনি আসমানের উপরে, আরশের উপর সমুন্নত। উপরে থাকাই আল্লাহর সত্তাগত সিফাত বা বিশেষণ।