আমলবিহীন আলেম সম্পর্কে কুরআন-হাদীছে অনেক বর্ণনা রয়েছে। আমরা এখানে তা থেকে কতিপয় বর্ণনা উপস্থাপনের চেষ্টা করব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ- كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ.
হে মুমিনগণ! তোমরা যা কর না তা তোমরা কেন বল? তোমরা যা কর না তোমাদের তা বলা আল্লাহর দৃষ্টিতে অতিশয় অসমেত্মাষজনক (ছফ ২-৩)।
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم رَأَيْتُ لَيْلَةَ أُسرِيَ بِيْ رِجَالاً تُقرَضُ شَفَاهُهُمْ بِمَقَارِيْضَ مِنَ النَّارِ فَقُلتُ مَنْ هَؤُلاَءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ الْخُطَبَاءُ مِنْ أُمَّتِكَ الَّذِيْنَ يَأْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَيَنسَوْنَ أَنْفُسَهُمْ وَهُمْ يَتْلُوْنَ الْكِتَابَ أَفَلاَ يَعْقِلُوْنَ.
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যখন আমাকে মে‘রাজের রাতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমি কতিপয় লোককে দেখলাম, যাদের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দ্বারা কেটে দেওয়া হচ্ছে। আমি বললাম, হে জিব্রীল! এরা কারা? তিনি বললেন, তারা আপনার উম্মতের বক্তাগণ, যারা মানুষকে ভাল কাজের জন্য আদেশ করত এবং নিজেদেরকে ভুলে যেত তারা কুরআন তেলাওয়াত করত। কিন্তু তারা চর্চা করত না। (তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৩২৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯১)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إنَّ أوَّلَ النَّاسِ يُقْضَ عَلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ أُسْتُشْهِدَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعْمَتَهُ فَعَرَفَهَا فَقَالَ مَا عَمِلْتَ فِيْهِ؟ قَالَ قَاتَلْتُ فِيْكَ حَتَّى أُسْتُشْهِدْتُ قَالَ كَذَبْتَ وَ لَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُّقَالَ جَرِيٌ فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأّ الْقُرآنَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعْمَهُ فَعَرَّفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا؟ قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَ قَرَأتُ فِيْكَ الْقُرْآنَ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ إنَّكَ عَالِمٌ وَ قَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِيٌ فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ وَ أعْطَاهُ مِنْ أصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعْمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا قَالَ مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيْلٍ تُحِبُّ أنْ يُّنْفَقَ فِيْهَا إلاَّ أنْفَقْتُ فِيْهَا لَكَ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তিকে বিচারের জন্য পেশ করা হবে সে হবে একজন শহীদ। তাকে আল্লাহর নিকট নিয়ে যাওয়া হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে স্বায়ী নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। আর সেও তা স্মরণ করবে। তারপর আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এত নে‘মতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? সে উত্তরে বলবে, আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য যুদ্ধ করেছি। এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, বরং তুমি লড়াই করেছ এজন্য যে, তোমাকে বাহাদুর বলা হবে। এমনকি তোমাকে তা বলাও হয়েছে। অতএব তার ব্যাপারে আদেশ করা হবে। তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অতঃপর ঐ ব্যক্তিকে বিচারের জন্য উপস্থিত করা হবে, যে নিজে ইলম শিক্ষা করেছে ও অপরকে শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন অধ্যয়ন করেছে। আল্লাহ তাকে তাঁর নে‘মত স্মরণ করাবেন এবং সেও তা স্মরণ করবে। অতঃপর আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, এ নে‘মতের জন্য তুমি কি আমল করেছ? সে বলবে আমি ইলম শিক্ষা করেছি এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার সুন্তুষ্টির জন্য কুরআন অধ্যয়ন করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এজন্য ইলম শিক্ষা করেছ, যেন তোমাকে বিদ্বান বলা হয় এবং এজন্য কুরআন পড়েছ যাতে তোমাকে ক্বারী বলা হয়। তোমাকে বিদ্বান ও ক্বারী বলা হয়েছে। অতঃপর তার সম্পর্কে আদেশ করা হবে। তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তারপর এমন ব্যক্তিকে বিচারের জন্য উপস্থিত করা হবে, যাকে আল্লাহ বিপুল সম্পদ দান করেছেন। আল্লাহ প্রথমে তাকে তার নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সেও তা স্মরণ করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞেস করবেন এত কিছু নে‘মতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? সে বলবে, যে সব ক্ষেত্রে সম্পদ ব্যয় করা তুমি পসন্দ কর তা হাতছাড়া করিনি। তোমার সন্তুষ্টির জন্য সবক্ষেত্রেই সম্পদ ব্যয় করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এ জন্য দান করেছ যে, তোমাকে দানবীর বলা হবে। এমনকি তোমাকে তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার সম্পর্কে আদেশ করা হবে, তাকে উপুড় করে টেনে হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২০৫; বাংলা মিশকাত হা/১৯৫ ’ইলম’ অধ্যায়)।
আলোচ্য হাদীছে তিন শ্রেণীর মানুষ ভাল আমল করেও জাহান্নামে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (১) এমন মুজাহিদ যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জিহাদ করেনি। বরং দুনিয়াবী স্বার্থে নিজের বিরত্ব প্রমাণ করার জন্য জিহাদ করেছে এবং দুনিয়াতে সুখ্যাতি লাভ করেছে। (২) এমন আলেম বা ক্বারী, যিনি দুনিয়া উপার্জনের উদ্দেশ্যে শিক্ষা অর্জন করেছে এবং সমাজে নিজের সুনাম ছড়ানোর জন্য বিভিন্ন ভঙ্গিতে জাল হাদীছ ও বানাওয়াট কিচ্ছা-কাহিনী বলে মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করেছে। সমাজে সুখ্যাতি লাভের আশায় বিভিন্ন ক্বায়দায় কুরআন তিলাওয়াত করেছে। এরূপ বক্তা ও ক্বারী বর্তমান সমাজে প্রচুর দেখা যাচ্ছে। যাদের থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। (৩) এমন দানশীল, যে সমাজে সুনাম অর্জনের জন্য দানবীর হিসাবে খ্যাতি অর্জনের জন্য দান করে। হাদীছের বক্তব্য অনুযায়ী এ তিন শ্রেণীর মানুষ যতই কুরআন -হাদীছসম্বলিত আমল করুক জান্নাতে যাবে না।
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُجَاءُ بِالرَّجُلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُلْقَى فِي النَّارِ فَتَنْدَلِقُ أَقْتَابُهُ فِي النَّارِ فَيُطْحَنُ فِيْهَا كَطَحْنِ الْحِمَارُ بِرَحَاهُ فَيَجْتَمِعُ أَهْلُ النَّارِ عَلَيْهِ فَيَقُولُونَ أَيْ فُلاَنُ مَا شَأْنُكَ أَلَيْسَ كُنْتَ تَأْمُرُنَا بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَانَا عَنْ الْمُنْكَرِ قَالَ كُنْتُ آمُرُكُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَلاَ آتِيهِ وَأَنْهَاكُمْ عَنْ الْمُنْكَرِ وَآتِيهِ.
ওসামা ইবনু যায়েদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘এক ব্যক্তিকে ক্বিয়ামতের দিন নিয়ে আসা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে করে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। আর সে তা নিয়ে ঘুরতে থাকবে যেমনিভাবে গাধা আটা পিষা জাঁতার সাথে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামীরা তার নিকট একত্রিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কি আমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করতেন না? সে বলবে, হ্যাঁ। আমি তোমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ করতাম, কিন্তু নিজেই তা করতাম না। আর খারাপ কাজ হ’তেতোমাদেরকে নিষেধ করতাম, কিন্তু আমি নিজেই তা করতাম’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৩৯, ৯ম খন্ড হা/৪৯১২ ‘আদব’ অধ্যায়, ‘সৎ কাজের নির্দেশ’ অনুচ্ছেদ)।
অত্র হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ সব বক্তা বা আলেম জাহান্নামে যাবে, যারা বক্তব্য অনুযায়ী নিজে আমল করে না এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে সে অনুযায়ী আমল করতে বাধ্য করে না। যারা মিথ্যা এবং চুক্তিবদ্ধ হয়ে বক্তব্য দেয়, তারাও বড় অপরাধী।