আমরা দেখেছি যে, ইবাদত অর্থ ‘চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি’। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন: (১) মারিফাত অর্জন করেই ঈমান অর্জন করতে হয়, এজন্য মারিফাতের ক্ষেত্রে সকল মুমিনই সমান। মুমিনের প্রকৃত প্রতিযোগিতা মারিফাতে নয়, বরং আল্লাহর ইবাদতে; কারণ প্রকৃত হক্ক আদায় করে ইবাদত কেউই করতে পারে না। (২) কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে তা জানার একমাত্র মাধ্যম আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত। এ বিষয়ে তিনি বলেন: ‘‘কেউই মহান আল্লাহর সঠিক পরিপূর্ণ ইবাদত করতে সক্ষম নয়, যেরূপ ইবাদত তাঁর পাওনা। তবে বান্দা তাঁর ইবাদত করে তাঁর নির্দেশ মত, যেভাবে তিনি তাঁর কিতাবে এবং তাঁর রাসূলের (ﷺ) সুন্নাতে নির্দেশ দিয়েছেন।’’
এখানে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) মুমিন জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর ইবাদতের আগ্রহ ও আবেগ অনেক সময় মুমিনকে অতি-উৎসাহী করে তোলে এবং অধিক ইবাদত, নৈকট্য ও বিলায়াতের আগ্রহে মুমিন দুটি ভুল করেন: (১) নিজের উপর কাঠিন্য আরোপ করেন এবং (২) সুন্নাতের অতিরিক্ত ইবাদত করেন।
দুটি বিষয় মূলত একই সূত্রে গাঁথা। কুরআন ও সুন্নাতের অতিরিক্ত আমলই কাঠিন্যের মধ্যে নিপতিত করে। এক্ষেত্রে মুমিনকে বুঝতে হবে যে, আল্লাহর ‘যথাযোগ্য’ (كما حقه) ইবাদত করা তার দায়িত্ব নয়, বরং ‘নির্দেশিত’ ইবাদত পালন তার দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
سَدِّدُوا وَقَارِبُوا وَأَبْشِرُوا فَإِنَّهُ لا يُدْخِلُ أَحَدًا الْجَنَّةَ عَمَلُهُ قَالُوا وَلا أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ وَلا أَنَا إِلا أَنْ يَتَغَمَّدَنِي اللَّهُ بِمَغْفِرَةٍ وَرَحْمَةٍ، وَاعْلَمُوا أَنَّ أَحَبَّ الْعَمَلِ إِلَى اللَّهِ أَدْوَمُهُ وَإِنْ قَلَّ.... إنَّ هذا الدِّين يُسْرٌ ولنْ يُشادَّ الدِّينَ أحدٌ إلا غَلَبَه.
‘‘তোমরা সঠিক আমল কর, কাছাকাছি থাক এবং আনন্দচিত্ত হও; কারণ কাউকেই তার নিজ কর্ম জান্নাতে প্রবেশ করাবে না। সাহাবীগণ বললেন: আপনিও নন, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বলেন, না, আল্লাহ যদি আমাকে ক্ষমা ও করুণা দিয়ে অভিষিক্ত না করেন তবে আমিও শুধু নিজের আমলের কারণে জান্নাতের দাবিদার হতে পারব না। আর জেনে রাখ, আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় কর্ম হলো নিয়মিত কর্ম, তা যদি অল্পও হয়।’’[1] অন্য হাদীসে তিনি বলেন: ‘‘নিশ্চয় এ দীন সহজ, যে কোনো ব্যক্তি যদি এ দীনকে কঠিন করে নেয় তবে তা অবশ্যই তার অসাধ্যে পরিণত হবে।’’[2]
এ অর্থে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীসে ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে পূর্ণতা বা আধিক্যের চেয়ে বিশুদ্ধতা ও সঠিকত্বের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সঠিকত্বের একমাত্র মাপকাঠি সুন্নাতে রাসূল (ﷺ)। তাঁর সুন্নাতের মধ্যে থেকে অল্প হলেও নিয়মিত আমল করাই মুমিনের দায়িত্ব। অধিক ইবাদতের আবেগে সুন্নাতের ব্যতিক্রমের পরিণতি ভয়াবহ। এ বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেন, আমার আববা আমাকে বিবাহ দেন, কিন্তু ইবাদতের আগ্রহের কারণে আমি রাতদিন নামায রোযায় ব্যস্ত থাকতাম এবং আমার স্ত্রীর কাছে যেতাম না। তখন আমার আববা আমাকে অনেক রাগ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেন। আব্দুল্লাহ (রা) বলেন:
فَأَرْسَلَ إِلَيَّ النَّبِيُّ ﷺ فَأَتَيْتُهُ فَقَالَ لِي أَتَصُومُ النَّهَارَ قُلْتُ نَعَمْ قَالَ وَتَقُومُ اللَّيْلَ قُلْتُ نَعَمْ قَالَ لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّي وَأَنَامُ وَأَمَسُّ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي ... ثُمَّ قَالَ ﷺ فَإِنَّ لِكُلِّ عَابِدٍ شِرَّةً وَلِكُلِّ شِرَّةٍ فَتْرَةً فَإِمَّا إِلَى سُنَّةٍ وَإِمَّا إِلَى بِدْعَةٍ فَمَنْ كَانَتْ فَتْرَتُهُ إِلَى سُنَّةٍ فَقَدِ اهْتَدَى وَمَنْ كَانَتْ فَتْرَتُهُ إِلَى غَيْرِ ذَلِكَ فَقَدْ هَلَكَ.
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন: তুমি কি প্রতিদিন রোযা রাখ? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বলেন: তুমি কি সারা রাত জেগে নামায পড়? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: কিন্তু আমি তো রোযাও রাখি আবার মাঝে মাঝে বাদ দিই, রাতে নামায পড়ি আবার ঘুমাই, স্ত্রীদেরকে সঙ্গ প্রদান করি। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে অপছন্দ করল আমার সাথে তার সম্পর্ক থাকবে না।... এরপর তিনি বলেন : প্রত্যেক আবিদের (ইবাদতকারীর) কর্মের উদ্দীপনার জোয়ার ভাটা আছে। ইবাদতের উদ্দীপনা কখনো তীব্র হয় আবার এ তীব্রতা এক সময় স্থিতি পায়, কখনো সুন্নাতের দিকে, কখনো বিদ‘আতের দিকে। যার স্থিতি সুন্নাতের প্রতি হবে সে হেদায়াত প্রাপ্ত হবে। আর যার স্থিতি সুন্নাতের ব্যতিক্রমের (বিদআতের) দিকে হবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’’[3]
এ অর্থের আরো অনেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, তাঁর কর্ম ও বর্জনের সামগ্রিক রূপই সুন্নাত। ইবাদতের আবেগে সুন্নাতের ব্যতিক্রম ইবাদত ধ্বংসের পথ।[4]
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৩ (কিতাবুল ঈমান, বাবুদ দীন ইউসরুন)
[3] হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ২/৩৯৪, নং ৬৫৩, ইবনু আবী আসিম, আস-সুন্নাহ, পৃ: ২৭- ২৮, নং ৫১, আলবানী, সাহীহুত তারগীব ১/৯৮।
[4] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৫০-৮৫।