রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্মান ও ভালবাসার অংশ তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্মান করা ও ভালবাসা। তাঁর সাহাবীগণকে, তাঁর পরিবার ও বংশধরদেরকে, তাঁর উম্মাতকে, তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারীদেরকে এবং তাঁর সুন্নাতের ধারক ও প্রচারকদেরকে তাঁর কারণে সম্মান করা ও ভালবাসা তাঁরই সম্মান ও ভালবাসার অংশ। বিশেষত তাঁর সাহাবী ও আহল বাইতের বিষয়টি কুরআন ও হাদীসে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলাম বিশ্বজনীন ধর্ম। এখানে কোনো বংশ বা বর্ণের ‘অলৌকিকত্ব’ বা পবিত্রতা ঘোষণা করা হয় নি। ইসলামে মর্যাদার ভিত্তি তাকওয়া; বংশ বা রক্ত নয়। কুরআনে বংশ, বর্ণ বা দেশ নির্বিশেষে সকল সাহাবীর প্রশংসা করা হয়েছে তাঁদের কর্ম ও ত্যাগের কারণে, বংশ বা বর্ণের কারণে নয়। আর স্বভাবতই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশের যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন সকলেই এ প্রশংসা ও মর্যাদার মধ্যে শামিল হয়েছেন। কাজেই পৃথকভাবে ‘‘নবী-বংশের’’ মর্যাদার উল্লেখ করা হয় নি।
কুরআনে ‘আহল বাইত’ দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে। একস্থানে ইবরাহীম (আঃ)-এর স্ত্রীকে ফিরিশতারা ‘‘আহল বাইত’’ বলে সম্বোধন করেন।[1] অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلاً مَعْرُوفًا وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلاةَ وَآَتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
‘‘হে নবী-পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর তবে পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে যার অন্তরে ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন যুগের মত নিজদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তোমরা সালাত কায়েম করবে ও যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকবে। হে আহল বাইত (নবী-পরিবার)! আল্লাহ্ তো শুধু চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দুর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’’[2]
এখানে আমরা দেখছি যে, মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্ত্রীগণকে ‘‘আহল-বাইত’’ বা ‘‘নবী-পরিবার’’ বলে সম্বোধন করে তাঁদের পরিপূর্ণ পবিত্রতার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু ‘‘আহল-বাইত’’ বিষয়ে শীয়াগণের বিশ্বাস কুরআনের এ ঘোষণার সাথে সাংঘর্ষিক। তারা নবী-পত্নীগণকে ‘‘আহল বাইত’’ বলে স্বীকার করেন না। উপরন্তু তাঁদের বিষয়ে তারা অত্যন্ত অশস্নীল ও নোংরা ধারণা পোষণ করেন।
শীয়াগণ মূলত আহল বাইত বলতে ‘‘আলী-বংশ’’ বুঝান। আর এ বিষয়ে কুরআন কারীমে কোনো নির্দেশনা নেই। একস্থানে আল্লাহ বলেন:
قُلْ لا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى
‘‘বল, ‘আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আত্মীয়তার সৌহার্দ্য ব্যতীত অন্য কোনো প্রতিদান চাই না।’’[3]
অর্থাৎ তোমাদের মাঝে দীন প্রচারের বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চাচ্ছি না। তবে তোমাদের সাথে আমার যে আত্মীয়তা রয়েছে সে আত্মীয়তার সৌহার্দ্য ও ভালবাসার দাবি যে, তোমরা আমাকে অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকবে এবং আমার সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করবে। আমি তোমাদের কাছে এ সৌহার্দ্যটুকু দাবি করছি।
কারো কারো মতে এ আয়াতের অর্থ: ‘আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না, শুধু আমার আত্মীয়দের প্রতি তোমাদের সৌহার্দপূর্ণ আচরণ চাই।’ অর্থাৎ এখানে তাঁর আত্মীয়দের ভালবাসতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ অর্থ কুরআনের স্বাভাবিক বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখানে তিনি ‘আত্মীয়তার সৌহার্দ্য’ দাবি করেছেন, ‘আত্মীয়দের প্রতি বা আত্মীয়দের জন্য সৌহার্দ্য’ দাবি করেন নি। এছাড়া তাঁর আত্মীয়দের অধিকাংশই সে সময়ে কাফির ছিলেন এবং তাদের সাথে অন্যান্য কাফির সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতো। উপরন্তু তিনি মক্কার যে কাফিরগণকে এ কথা বলেছিলেন তারাই তো তাঁর আত্মীয় ছিলেন। কাজেই তাদের কাছে তিনি কিভাবে তাঁর আত্মীয়দের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ আচরণ দাবি করবেন।
এদ্বারা তাঁর আত্মীয়দের অবমূল্যায়ন বা অবমর্যাদা উদ্দেশ্য নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সম্পৃক্ত সকলকে ভালবাসা ঈমানের স্বাভাবিক দাবি। তাঁর পরিবার ও বংশধরের প্রতি ভালবাসা তাঁরই ভালবাসার অংশ। তাঁর বংশের যারা ঈমান ও সাহচর্য গ্রহণ করেছেন তাঁদের মর্যাদাও কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা। এ মর্যাদার পাশাপাশি আত্মীয়তার মর্যাদা তাঁদেরকে মহিমান্বিত করে। সর্বোপরি হাদীসে তাঁদের মর্যাদার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
যাইদ ইবন আরকাম (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী ‘খুম’ নামক স্থানে আমাদের মাঝে বক্তৃতা করেন। তিনি আল্লাহর গুণগান করলেন, ওয়ায করলেন ও উপদেশ প্রদান করলেন। অতঃপর তিনি বললেন:
أَمَّا بَعْدُ أَلا أَيُّهَا النَّاسُ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رَسُولُ رَبِّي فَأُجِيبَ وَأَنَا تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللَّهِ فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ فَخُذُوا بِكِتَابِ اللَّهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ ... ثُمَّ قَالَ وَأَهْلُ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي... ثلاثا.
‘‘হে মানুষেরা, তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমি একজন মানুষ মাত্র। হয়ত শীঘ্রই আমার প্রভুর দূত এসে পড়বেন এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যাব। আমি তোমাদের মধ্যে দুটি মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয় রেখে যাচ্ছি। প্রথমত আল্লাহর কিতাব, যার মধ্যে রয়েছে পথের দিশা ও আলো। তোমরা আল্লাহর কিতাবকে গ্রহণ করবে এবং দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে। .... এরপর তিনি বললেন : ‘এবং আমার বাড়ির মানুষ (আহল বাইত)। আমি আমার ‘আহল বাইত’ বিষয়ে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা মনে রাখতে উপদেশ প্রদান করছি।’ এ কথা তিনি তিনবার বলেন।’’[4]
ইবন আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
أَحِبُّوا اللَّهَ (لِمَا يَغْذُوكُمْ مِنْ نِعَمِهِ) وَأَحِبُّونِي (بِحُبِّ اللَّهِ) وَأَحِبُّوا أَهْلَ بَيْتِي (بِحُبِّي)
‘‘তোমরা আল্লাহকে ভালবাসবে কারণ তিনি তোমাদেরকে অগণিত নিয়ামত প্রদান করেন, এবং আল্লাহর ভালবাসায় আমাকে ভালবাসবে এবং আমার ভালবাসায় আমার ‘আহল বাইত’ বা বাড়ির মানুষদের (বংশধর ও আত্মীয়দের) ভালবাসবে।’’[5]
[2] সূরা (৩৩) আহযাব: ৩২-৩৩ আয়াত।
[3] সূরা (৪২) শূরা: ২৩ আয়াত।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৮৭৩ (কিতাব ফাযাইলুস সাহাবা, বাবুন মিন ফাযাইল আলী)
[5] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৬৬৪ (কিতাবুল মানাকিব, বাবু মানাকিবি আহলি বাইতিন নাবিয়্যি); হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/১৬২। হাদীসটিকে তিরমিযী হাসান এবং হাকিম ও যাহাবী সহীহ বলেছেন।