এ মূলনীতির উপর ঐকমত্যের পর খুঁটিনাটি কিছু বিষয়ে আলিমদের মতভেদ রয়েছে। আল্লামা উমর ইবন মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭হি.) এ বিষয়ে বলেন:
كُلُّهُمْ كَانُوْا مُخْبِرِيْنَ مُبَلِّغِيْنَ عَنِ اللهِ تَعَالَى صَادِقِيْنَ نَاصِحِيْنَ لِلْخَلْقِ
‘‘তাঁরা সকলেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ প্রদান করেছেন এবং প্রচার করেছেন, সত্যবাদী ছিলেন, সৃষ্টির উপদেশদাতা ও কল্যাণকামী ছিলেন।’’[1]
এ কথার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা সা’দ উদ্দীন তাফতাযানী (৭৯১হি) বলেন:
‘‘এতে ইশারা করা হয়েছে যে, নবীগণ বিশেষভাবে শরীয়তের বিষয়ে, দীনের আহকাম প্রচারের বিষয়ে ও উম্মাতকে নির্দেশনা প্রদানের বিষয়ে মা’সূম বা নির্ভুল ও সংরক্ষিত। এক্ষেত্রে তাঁরা ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল করেন না সে বিষয়ে সকলেই একমত। অধিকাংশের মতে এক্ষেত্রে তাঁরা অনিচ্ছাকৃত বা বেখেয়ালেও কোনো ভুল করতে পারেন না। অন্যান্য সকল পাপ থেকে তাঁদের মাসূম বা নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। বিস্তারিত আলোচনা নিম্নরূপ: মুসলিম উম্মাহর ইজমা এই যে, নবীগণ ওহী বা নুবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে কুফরী থেকে সংরক্ষিত। অনুরূপভাবে অধিকাংশের মতে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া থেকেও মা’সূম। হাশাবিয়া সম্প্রদায় এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। .... আর ইচ্ছাকৃত সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে অধিকাংশের মত এই যে, তা সম্ভব। তবে মুতাযিলী নেতা আল-জুবাঈ[2] ও তাঁর অনুসারীরা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। আর নবীগণের জন্য অনিচ্ছাকৃত বা ভুলক্রমে সগীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া সকলের মতেই সম্ভব, তবে যে সকল সগীরা গোনাহ নীচতা প্রমাণ করে তা তাঁদের দ্বারা সম্ভব নয়, যেমন এক লোকমা খাদ্য চুরি করা, একটি দানা ওযনে কম দেওয়া, ইত্যাদি। এক্ষেত্রে (সগীরা গোনাহের ক্ষেত্রে) মুহাক্কিক আলিমগণ শর্ত করেছেন যে, নবীগণকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাঁরা তা বর্জন করেন। এ মতভেদ সবই ওহী বা নুবুওয়াত প্রাপ্তির পরের অবস্থার সাথে সম্পর্কিত। নুবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে নবীগণ থেকে কবীরা গোনাহ প্রকাশ পাওয়া অসম্ভব বলে কোনো দলীল নেই। মু’তাযিলাগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, নুবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও নবীগণ কর্তৃক কবীরা গোনাহ সংঘটিত হতে পারে না; কারণ এর ফলে জনগণের মধ্যে তাঁর প্রতি অভক্তি সৃষ্টি হয়, যা তাঁর অনুসরণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ফলে নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। সত্য কথা এই যে, যে কর্ম তাঁদের প্রতি অভক্তি সৃষ্টি করে তা তাঁরা করতে পারেন না, যেমন, মাতৃগণের সাথে অনাচার, অশ্লীলতা ও নীচতা জ্ঞাপক সগীরা গোনাহ। শীয়াগণ মনে করেন যে, নবীগণ থেকে নুবুওয়াতের পূর্বে ও পরে কখনোই কোনো সগীরা বা কবীরা গোনাহ প্রকাশিত বা সংঘটিত হতে পারে না। তবে তারা তাকিয়্যাহ বা আত্মরক্ষামূলকভাবে কুফর প্রকাশ সম্ভব বলেছে।’’[3]
মোল্লা আলী কারী বলেন, ইবনুল হুমাম বলেছেন: আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অধিকাংশ আলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য মত এই যে, নবীগণ কবীরা গোনাহ থেকে সংরক্ষিত, ভুলক্রমে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে একক সগীরা গোনাহ করে ফেলা থেকে সংরক্ষিত নন। আহলুস সুন্নাতের কেউ কেউ নবীদের ক্ষেত্রে ভুল করাও অসম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন। সঠিকতর বা সহীহ কথা এই যে, কর্মের মধ্যে ভুল হওয়া সম্ভব। সার কথা এই যে, আহলুস সুন্নাতের সকলেই একমত যে, নবীগণ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো নিষিদ্ধ কর্ম করতে পারেন না। তবে অসতর্কতা বা ভুলের কারণে যা ঘটে তা পদস্খলন বলে অভিহিত।[4]
[2] আবূ আলী মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব আল-জুবাঈ (৩০৩ হি)। তিনি মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের একজন প্রসিদ্ধ আলিম ও নেতা ছিলেন। মু’তাযিলাদের একটি সম্প্রদায়ের বা উপদলের নাম ‘জুবাইয়্যাহ’ যারা তার অনুসারী ছিলেন। দেখুন, বাগদাদী, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ১৮৩-১৮৪।
[3] তাফতাযানী, শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, পৃ. ১৩৯-১৪০।
[4] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১০৪-১০৫।