১১. পরবর্তীগণের মতপার্থক্য পর্যালোচনা
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, জাহমী, মুতাযিলী ও সমমনা ফিরকা ছাড়াও সাহাবী-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীদের মধ্যেও নানাবিধ মতভেদ ও প্রান্তিকতা জন্ম নিয়েছে। নিম্নের কয়েকটি বিষয় হয়ত আমাদেরকে এ বিষয়ক প্রান্তিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে:
১১. ১. বিশেষণগুলোর অর্থ অজ্ঞাত অথবা জ্ঞাত
কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, সালাফ সালিহীন আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলো ‘‘অজ্ঞাতঅর্থ’’ বা ‘‘অর্থ বিহীন শব্দ’’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা এগুলোর অর্থ মানবীয় জ্ঞানের আওতা বহির্ভূত বলে গণ্য করেছেন এবং অর্থের বিষয়টি মহান আল্লাহর উপর সমর্পন করেছেন। সালাফ সালিহীনের দু-একটি বক্তব্যকে তাঁরা তাঁদের এ মতের পক্ষে প্রমাণ পেশ করেছেন। আমরা দেখেছি সুফইয়ান ইবন উআইনা বলেছেন: ‘‘আল্লাহ কুরআনে নিজের বিষয়ে যে সকল বিশেষণ উল্লেখ করেছেন তার পাঠই তার ব্যাখ্যা কোনো স্বরূপ নেই এবং তুলনা নেই।’’ আওযায়ী, মালিক, সুফিয়ান সাওরী, লাইস ইবন সা’দ প্রমুখ আলিম বলেছেন: ‘‘এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই চালিয়ে নাও; কোনোরূপ স্বরূপ-প্রকৃতি ব্যতিরেকে।’’ আহমদ ইবন হাম্বাল বলেছেন: ‘‘আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, সত্য বলে গ্রহণ করি, কোনো ‘কিভাবে’ নেই এবং কোনো অর্থ নেই। ’’ এ সকল বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তাঁরা বলেন যে, সালাফ সালিহীনের মতে মহান আল্লাহর বিশেষণগুলোর অর্থ ‘‘অজ্ঞাত’’।
কিন্তু আমরা যখন সালফ সালিহীনের বক্তব্যগুলো পূর্ণভাবে পাঠ করি তখন আমরা নিশ্চিত হই যে, তাঁরা এ সকল বিশেষণের অর্থ জ্ঞাত তবে ব্যাখ্যা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা অর্থ বিশ্বাস করেছেন এবং স্বরূপ, হাকীকত বা ব্যাখ্যার জ্ঞানকে আল্লাহর উপর সমর্পন করেছেন। তাঁরা সর্বদা বলেছেন, এ সকল বিশেষণ পাঠ বা শ্রবণ করলে যা বুঝা যায় তাই এর অর্থ এবং তুলনামুক্ত ও স্বরূপহীনভাবে এ অর্থ বিশ্বাস করতে হবে। এর অতিরিক্ত কোনো অর্থ, তাবীল বা ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করা যাবে না।
আমরা দেখেছি তাবিয়ী মুজাহিদ বলেছেন: ‘আরশের উপর ‘ইসতিওয়া’ করেছেন অর্থ আরশের ঊর্ধ্বে থেকেছেন।’’ তিনি বলেন নি যে, এ বাক্যটির অর্থ অজ্ঞাত। ‘ইসতিওয়া’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে ইমাম মালিক ও অন্যান্য ইমাম বলেন নি যে, আল্লাহর ক্ষেত্রে ইসতিওয়া কথাটির অর্থ আমরা জানি না। বরং তাঁরা স্পষ্টভাবেই বলেছেন ‘ইসতিওয়া’ একটি জ্ঞাত বিষয়, তবে তার পদ্ধতি, স্বরূপ বা প্রকৃতি অজ্ঞাত।
ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ‘‘তাঁর হস্ত আছে, মুখমণ্ডল আছে, নফস আছে, কারণ আল্লাহ কুরআনে এগুলো উল্লেখ করেছেন।’’ এখানে লক্ষণীয় যে, এ কথাগুলো কুরআনের হুবহু বক্তব্য নয়। কুরআনের বক্তব্য: তিনি হস্ত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর হস্তদ্বয় প্রসারিত... ইত্যাদি। ইমাম আযমের বক্তব্য কুরআনের বক্তব্যের ‘আরবী অনুবাদ’। এ থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, তারা এগুলোর অর্থ পরিজ্ঞাত ও বাহ্যিক অর্থে ব্যবহৃত বলে গণ্য করেছেন। তাঁকে অবতরণ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন নি যে, তিনি অবতরণ করেন না অথবা অবতরণ শব্দের অর্থ অপরিজ্ঞাত। বরং তিনি বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহ অবতরণ করেন, কোনোরূপ পদ্ধতি বা স্বরূপ ব্যতিরেকে।’’
আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফা আল্লাহর বিশেষণসমূহ অনুবাদ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ ইসলাম সকল ভাষার মানুষের জন্য। অনুবাদ না করলে অন্য ভাষার মানুষেরা এ বিশেষণগুলো কিভাবে বিশ্বাস করবেন? ‘অর্থহীন শব্দ’- বিশ্বাস করবেন? না ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করবেন? ‘রহমান আরশের উপর অধিষ্ঠান করলেন’ কথাটির অনুবাদে কী লিখতে হবে? ‘ইসতিওয়া’ লিখলে অন্য ভাষার মুমিনগণ কী বিশ্বাস করবেন? আর ‘ক্ষমতা গ্রহণ’ লিখলে তো নিষিদ্ধ ব্যাখ্যা চাপিয়ে দেওয়া হলো। ‘আল্লাহর শেষ রাত্রে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন’ হাদীসটির অনুবাদ কিভাবে হবে? ‘নুযুল করেন’ লিখলে অনারব পাঠক কী বুঝবেন ও বিশ্বাস করবেন? আর ব্যাখ্যা লিখলে তো মুতাযিলা ও কাদারিয়াদের পথে চলা হলো। এতে সুস্পষ্ট যে, ইমামগণ এ সকল বিশেষণের অর্থ জ্ঞাত (মুহকাম) ও হাকীকত অজ্ঞাত (মুতাশাবিহ) বলে গণ্য করতেন।