২. ২. ১. মালাকগণে বিশ্বাসের প্রকৃতি
আরবী ভাষায় ‘‘মালাক’’ শব্দকে ফার্সী ভাষায় ফিরিশতা বলা হয়। ‘মালাক’ (مَلَك) শব্দটির অর্থ পত্র, বাণী বা দূত বা আল্লাহর দূত (angel)।[1]
‘ঈমান বিল মালাইকা’ বা মালাকগণে বিশ্বাসের অর্থ তাঁদের বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসে যা বর্ণিত হয়েছে তা সরলভাবে বিশ্বাস করা। কুরআনের বর্ণনা অনুসারে আমরা বিশ্বাস করি যে, মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ অগণিত মালাইকা সৃষ্টি করেছেন, যাঁরা আল্লাহর সম্মানিত সৃষ্টি। তাঁরা মানবীয় দুর্বলতা ও কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত। তাঁরা সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার কোনো অনুভূতি তাঁদের মধ্যে নেই। সর্বদা আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর প্রশংসা ও মহত্ব বর্ণনা করা, তাঁর নির্দেশে সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করা তাঁদের কর্ম।[2] সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মালাকগণ নূর বা আলো থেকে সৃষ্ট।[3]
২. ২. ২. মালাকগণ বিষয়ক বিভ্রান্তি
ফিরিশতাগণ অদৃশ্য জগতের অংশ। তাঁদের বিষয়ে ওহীর বক্তব্য, অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের বক্তব্য আক্ষরিক ও সরল অর্থে বিশ্বাস করাই মুমিনের নাজাতের একমাত্র পথ। গাইবী বিষয়ে ওহীর সাথে কল্পনা, ধারণা, যুক্তি ইত্যাদি মিশ্রিত করে ওহীর অতিরিক্ত কিছু বলা বিভ্রান্তির পথ উন্মুক্ত করে। মালাকগণের বিষয়ে এ ধরনের কিছু বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে পূর্ববর্তী কোনো কোনো জাতি। এ জাতীয় বিভ্রান্তির একটি ছিল তাঁদেরকে আল্লাহর সন্তান বলে কল্পনা করা। আরবের মুশরিকগণ মালাকগণকে আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করত।[4]
এ জাতীয় আরেকটি বিভ্রান্তি দায়িত্বকে ক্ষমতা মনে করা। আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছেন, যেমন মৃত্যুর দায়িত্ব, বৃষ্টির দায়িত্ব, রিযকের দায়িত্ব ইত্যাদি। কিন্তু তিনি তাঁদেরকে কোনো ক্ষমতা দেন নি। এ দায়িত্বকে অতীত কালের অনেক বিভ্রান্ত সম্প্রদায় ‘ক্ষমতা’ বলে বিশ্বাস করেছে। এরপর তারা এ সকল ফিরিশতাকে ভক্তির নামে ইবাদত করেছে এবং এদের কাছে প্রার্থনা করেছে। মৃত্যুর ফিরিশতা, বৃষ্টির ফিরিশতা, রিযকের ফিরিশতা ও অন্যান্যের পূজা, ভক্তি বা আরাধনা করে তাঁদের কাছে দীর্ঘায়ূ, বৃষ্টি বা রিযক প্রার্থনা করেছেন।
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, মহান আল্লাহ মালাকদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কোনো জীবিত বা মৃত মানুষকে কোনোরূপ দায়িত্ব দিয়েছেন বলে জানান নি। কিন্তু অনেক বিভ্রান্ত জাতি তাদের মধ্যকার অনেক নবী, ওলী, ‘বীর’ ‘সাধু’ বা ‘সৎ’ মানুষকে মৃত্যুর পরে ‘মালাকগণের’ মত ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ বলে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে দাবি করেছে। এরপর তারা দায়িত্বকে ক্ষমতা বলে কল্পনা করেছে। এরপর তারা এভাবে তাদের ইবাদত, ভক্তি, অর্চনা বা পূজা করেছে ও তাদের কাছে অলৌকিক সাহায্য চেয়েছে।
ফিরিশতাগণের এরূপ ভক্তি বা পূজার অন্যতম কারণ ছিল তাঁদের শাফাআত বিষয়ক ওহীর নির্দেশনার অপব্যাখ্যা। আল্লাহ ফিরিশতাগণের দুআ, সুপারিশ বা শাফাআত কবুল করেন। কাফিরগণ ধারণা করত যে, এদের সুপারিশ ছাড়া সরাসরি আল্লাহকে ডাকলে কাজ হবে না। ভক্তি-অর্চনা করে এদেরকে খুশি করতে পারলেই এরা আমাদের জন্য দুআ করবেন। এজন্য তারা তাঁদের ইবাদত করত, অর্থাৎ তাঁদের স্মৃতি বা মৃর্তির সামনে নিজেদের চূড়ান্ত অসহায়ত্ব ও ভক্তি প্রকাশ করে সাহায্য প্রার্থনা করত, তাঁদের স্মৃতিকে চুম্বন, সাজদা, মানত ও উৎসর্গ করত। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে এ জাতীয় বিভ্রান্তি অপনোদন করা হয়েছে। আমরা ‘‘শাফাআত’’ বিষয়ক আলোচনায় তা দেখব, ইনশা আল্লাহ।
[2] দেখুন: সূরা (৭) আ’রাফ: ২০৬ আয়াত; সূরা (২১) আম্বিয়া: ২০ ও ২৬-২৮ আয়াত; সূরা (৬৬) তাহরীম: ৬ আয়াত...। বিস্তারিত দেখুন: কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ২৪৩-২৫৬।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৯৪ (কিতাবুয যুহদ, বাবুন ফী আহাদীস মুতাফার্রিকা)
[4] দেখুন: সূরা (৩৭) সাফফাত: ১৪৯-১৫২ আয়াত; সূরা (৪৩) যুখরুফ: ১৯ আয়াত।