যে মাসে রাযী এর ঘটনা সংঘটিত হয় ঠিক সেই মাসেই বি’রে মাউনার বেদনাদায়ক ঘটনাও সংঘটিত হয়। এ ঘটনা রাযী’র ঘটনার চাইতেও কঠিন ও বেদনাদায়ক।
এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, আবূ বারা’ ‘আমির বিন মালিক যিনি ‘মুলায়েবুল আসিন্নাহ’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন (বর্শা নিয়ে যিনি খেলা করেন) এক দফা মদীনায় নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হলেন। নাবী কারীম (ﷺ) তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন কিন্তু তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন না কিংবা তা থেকে সরেও গেলেন না। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য সাহাবীগণকে (রাঃ) নাজদবাসীগণের নিকট প্রেরণ করেন তাহলে তারা আপনার দাওয়াত গ্রহণ করবে বলে আশা করি।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (إِنِّيْ أَخَافُ عَلَيْهِمْ أَهْلَ نَجْدٍ) ‘নাজদবাসীদের থেকে নিজ সাহাবীগণ সম্পর্কে আমি ভয় করছি।’
আবূ বারা‘ বললেন, ‘তারা আমার আশ্রয়ে থাকবেন।’
এ কারণে ইতিহাসবিদ ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনা মতে ৪০ জন এবং সহীহুল বুখারীর তথ্য মোতাবেক ৭০ জন সাহাবাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সঙ্গে প্রেরণ। ৭০ জনের সংখ্যাটি সঠিক বলে প্রমাণিত। মুনযির বিন আমিরকে (বনু সায়েদা গোত্রের সঙ্গে যার সম্পর্ক ছিল এবং ‘মু’নিক লিইয়ামূত’ (মৃত্যুর জন্য স্বাধীনকৃত) উপাধিতে ভূষিত ছিলেন, দলের নেতা নিযুক্ত করেন। এ সাহাবাবৃন্দ (রাঃ) ছিলেন বিজ্ঞ, ক্কারী, এবং শীর্ষ স্থানীয়। তাঁরা দিবা ভাগে জঙ্গল থেকে জ্বালানী সংগ্রহ করে তার বিনিময়ে আহলে সুফফাদের জন্য খাদ্য ক্রয় করতেন ও কুরআন শিক্ষা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন এবং রাত্রি বেলা আল্লাহর সমীপে মুনাজাত ও সালাতের জন্য দন্ডায়মান থাকতেন। এ ধারা অবলম্বনের মাধ্যমে তাঁরা মাউনার কূপের নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। এ কূপটি বনু ‘আমির এবং হাররাহ বনু সুলাইমের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল।
সেই স্থানে শিবির স্থাপনের পর এ সাহাবীগণ (রাঃ) উম্মু সুলাইমের ভ্রাতা হারাম বিন মিলহানকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পত্রসহ আল্লাহর শত্রু ‘আমির বিন তোফাইলের নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু পত্রটি পাঠ করা তো দূরের কথা তার ইঙ্গিতে এক ব্যক্তি হারামকে পিছন দিক থেকে এত জোরে বর্শা দ্বারা আঘাত করল যে, দেহের অপর দিক দিয়ে ফুটা হয়ে বের হয়ে গেল। বর্শা-বিদ্ধ রক্তাক্তদেহী হারাম বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর মহান! কাবার প্রভূর কসম! আমি কৃতকার্য হয়েছি।’
এরপর পরই আল্লাহর শত্রু আমির অবশিষ্ট সাহাবাদের (রাঃ) আক্রমণ করার জন্য তার গোত্র বনু আমিরকে আহবান জানাল। কিন্তু যেহেতু তাঁরা আবূ বারা’র আশ্রয়ে ছিলেন সেহেতু তারা সেই আহবানে সাড়া দিল না। এদিক থেকে সাড়া না পেয়ে সে বনু সুলাইমকে আহবান জানাল। বুন সুলাইমের তিনটি গোত্র উমাউয়া, রে’ল এবং যাকওয়ান। এ আহবানে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ সাহাবীগণ (রাঃ)-কে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল। প্রত্যুত্তরে সাহাবায়ে কেরাম যুদ্ধে লিপ্ত হলেন এবং একজন বাদে সকলেই শাহাদত বরণ করলেন। কেবলমাত্র কা‘ব বিন যায়দ (রাঃ) জীবিত ছিলেন। তাঁকে শহীদগণের মধ্য থেকে উঠিয়ে আনা হয়। খন্দকের যু্দ্ধ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন।
তাছাড়া আরও দু’জন সাহাবী- ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ) এবং মুনযির বিন উক্ববা বিন আমির (রাঃ) উট চরাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে তাঁরা পাখী উড়তে দেখে সেখানে গিয়ে পৌঁছেন। অতঃপর মুনযির তাঁর বন্ধুগণের সংখ্যা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শাহাদতবরণ করেন। ‘আমর বিন উমাইয়া যামরীকে বন্দী করা হয়। কিন্তু যখন তারা অবগত হয়ে যে, মুযার গোত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে তখন আমির তার কপালের চুল কেটে দিয়ে তার মায়ের পক্ষ হতে- যার উপর একটি দাসকে স্বাধীন করার মানত ছিল- তাঁকে মুক্ত করে দেয়।
‘আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ) এ বেদনা-দায়ক ঘটনার খবর নিয়ে মদীনায় পৌঁছলেন। ৭০ জন বিজ্ঞ মুসলিমের এ হৃদয় বিদারক শাহাদাত উহুদ যুদ্ধের ক্ষতকে আরও বহুগুণে বর্ধিত করে তোলে। কিন্তু উহুদের তুলনায় এ ঘটনা আরও মর্মান্তিক ছিল এ কারণে যে, উহুদ যুদ্ধে মুসলিমগণ শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখী যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেন, কিন্তু এক্ষেত্রে মুসলিমগণ চরম এক বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
‘আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ) প্রত্যাবর্তন কালে কানাত উপত্যাকার প্রান্তভাবে অবস্থিত কারকারা নামক স্থানে পৌঁছে একটি বৃক্ষের ছায়ায় অবতরণ করেন। বনু কিলাব গোত্রের দু’ ব্যক্তিও তথায় অবস্থান গ্রহণ করে। তারা উভয়েই যখন ঘুমে নিমগ্ন হয়ে পড়ে তখন ‘আমর বিন উমাইয়া (রাঃ) তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলল। তাঁর ধারণা ছিল যে, এদের হত্যা করে তার সঙ্গীদের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করলেন। অথচ তাদের দু’ জনের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে অঙ্গীকার ছিল, কিন্তু ‘আমর বিন উমাইয়া (রাঃ) তা জানতেন না। কাজেই, মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর যখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ব্যাপারটি অবহিত করেন তখন তিনি বললেন যে, (لَقَدْ قَتَلْتَ قَتِيْلَيْنِ لَأَدِيَنَّهُمَا) ‘তুমি এমন দুজনকে হত্যা করেছ যাদের শোনিত পাতের খেসারত অবশ্যই আমাকে করতে হবে।’ এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিম এবং তাঁদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ইহুদীদের নিকট থেকে শোনিত পাতের খেসারত একত্রিত করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটাই পরিণামে বনু নাযীর যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।[1] এর বিবরণ পরবর্তীতে আসছে।
মা’উনাহ এবং রাযী’র উল্লেখিত বেদনা-দায়ক ঘটনাবলীতে যা মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এতই ব্যথিত[2] হয়েছিলেন এবং এ পরিমাণ চিন্তিত ও মর্মাহত[3] হন যে, যে সকল গোত্র ও সম্প্রদায় বিশ্বাসঘাতকতা ক’রে সাহাবীগণকে (রাঃ) হত্যা করে নাবী কারীম (ﷺ) এক মাস যাবৎ তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর সমীপে বদ দু‘আ করতে থাকেন। তিনি ফজরের সালাতে রে’ল যেকওয়ান, লাহইয়ান এবং উসাইয়া গোত্রের বিরুদ্ধে বদ্-দোয়া করেন এবং বললেন যে, (عُصَيَّةٌ عَصَتْ اللهَ وَرَسُوْلَهُ) ‘উসাইয়া আল্লাহ এবং তার রাসূলের নাফারমানী করেছে।’
আল্লাহ তা‘আলা সে সম্পর্কে স্বীয় নাবীর উপর আয়াত অবতীর্ণ করেন যা পরবর্তী কালে মানসুখ হয়ে যায়। সেই আয়াত ছিল এইরূপ- (بَلِّغُوْا عَنَّا قَوْمَنَا أَنَا لَقِيْنَا رَبَّنَا فَرَضِيَ عَنَّا وَرَضِيْنَا عَنْهُ) ‘আমার সম্প্রদায়কে এ কথা বলে দাও যে, আমরা আপন প্রতিপালকের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। তিনি আমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, আমারও তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়েছি। এরপর থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুনুত পাঠ করা ছেড়ে দেন।[4]
[2] ইমাম ওয়াক্বিদী লিখেছেন যে, ‘রাযী’’ এবং ‘মউনা’ ঘটনার সংবাদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট একই রাত্রিতে পৌঁছেছিল।
[3] আনাস (রাঃ) হতে ইবনে সা‘দ বর্ণনা করেন যে, বীরে মাউনার মর্মান্তিক ঘটনায় নাবী কারীম (সাঃ)-কে যে পরিমাণ ব্যথিত ও মর্মাহত হতে দেখা গিয়েছিল অন্য কোন ব্যাপারেই তাঁকে এত অধিক পরিমাণে মর্মাহত হতে দেখি নাই। শাইখ আব্দুল্লাহ রচিত মুখতাসারুস সীরাহ ২৬০ পৃঃ।
[4] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৮৬-৫৮৮।