এ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও শহীদদেরকে পরিদর্শন করেন এবং বলেন,
أَنَا أَشْهَدُ عَلٰى هٰؤُلاَءِ إِنَّهُ مَا مِنْ جَرِيْحٍ يُجْرَحُ فِيْ اللهِ إِلَّا وَاللهِ بَعَثَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَدْمَى اللَّوْنُ لَوْنُ الدَّمِ وَالرِّيْحُ رِيْحُ الْمِسْكِ
‘আমি এ লোকদের ব্যাপারে সাক্ষী থাকব। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহত হয়, আল্লাহ তাঁকে কিয়ামতের দিন এ অবস্থায় উঠাবেন যে, তাঁর ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত বইতে থাকবে। রঙ তো রক্তেরই হবে, কিন্তু সুগন্ধি হবে মিশকের মতো।’[1]
কতিপয় সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তাঁদের শহীদদেরকে মদীনায় স্থানান্তরিত করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁরা যেন শহীদদেরকে ফিরিয়ে এনে তাঁদের শাহাদতের স্থানেই দাফন করেন এবং আরো নির্দেশ দেন যে, তাঁদের অস্ত্র-শস্ত্র এবং চর্ম নির্মিত (যুদ্ধের) পোষাক যেন খুলে নেয়া না হয়, আর গোসল দেয়া ছাড়াই যে অবস্থায় তাঁরা রয়েছেন সেই অবস্থাতেই যেন তাঁদেরকে দাফন করে দেয়া হয়। তিনি দু’দুজনকে একই কাপড়ে জড়াতেন এবং দুই কিংবা তিন শহীদকে একই কবরে দাফন করতেন এবং প্রশ্ন করতেন, (أَيُّهُمْ أَكْثَرُ أَخْذًا لِلْقُرْآنِ؟)‘এদের মধ্যে কুরআন কার বেশী মুখস্থ ছিল?’ সাহাবী যার দিকে ইশারা করতেন তাকেই তিনি কবরে আগে রাখতেন এবং বলতেন, (أَنَا شَهِيْدٌ عَلٰى هٰؤُلاَءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ) ‘কিয়ামতের দিন আমি এ লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দান করব।’ আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনু হারাম (রাঃ) এবং ‘আমর ইবনু জমূহ (রাঃ)-কে একই কবরে দাফন করা হয়। কেননা তাঁদের দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল।[2]
হানযালার (রাঃ) মৃতদেহ অদৃশ্য ছিল। অনুসন্ধানের পর এক জায়গায় এমন অবস্থায় দেখা গেল যে, যমীন হতে উপরে রয়েছে এবং ওটা হতে টপ্ টপ্ করে পানি পড়ছে। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবায়ে কিরামকে জানালেন যে, ‘ফিরিশতারা একে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন।’ তখন নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (سَلُوْا أَهْلَهُ مَا شَأْنُهُ؟) ‘তাঁর বিবিকে জিজ্ঞাসা কর প্রকৃত ব্যাপারটি কী ছিল?’ তাঁর বিবিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তার প্রকৃত ঘটনাটি বলেন। এখান থেকেই হানযালা (রাঃ)-এর নাম (غَسِيْلُ الْمَلاَئِكَةِ) (অর্থাৎ ফিরিশতাগণ কর্তৃক গোসল প্রদত্ত) হয়ে যায়।[3]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর চাচা হামযাহ (রাঃ)-এর অবস্থা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হন। তাঁর ফুফু সাফিয়্যাহহ (রাঃ) আগমন করেন এবং তিনিও তাঁর ভ্রাতা হামযাহ (রাঃ)-কে দেখার বাসনা প্রকাশ করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর পুত্র যুবাইর (রাঃ)-কে বলেন যে, তিনি যেন তাঁর মাতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং তাঁর ভাইকে দেখতে না দেন।
এ কথা শুনে সাফিয়্যাহহ (রাঃ) বলেন, ‘এটা কেন? আমি জানতে পেরেছি যে, আমার ভাই এর নাক, কান ইত্যাদি কেটে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার ভাই আল্লাহর পথে রয়েছে। সুতরাং তার উপর যা কিছু করা হয়েছে তাতে আমি পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট আছি। আমি পুণ্য মনে করে ইনশাআল্লাহ ধৈর্য্য ধারণ করব।’ অতঃপর তিনি হামযাহ (রাঃ)-এর নিকট আসেন, তাঁকে দেখেন, তাঁর জন্যে ইন্নালিল্লাহ পড়েন এবং দুআ করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ অনুযায়ী হামযাহ (রাঃ)-কে আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ)-এর সাথে দাফন করা হয়। তিনি হামযাহ (রাঃ)-এর ভাগিনা এবং দুধভাইও ছিলেন। ইবনু মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হামযাহ ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রাঃ)-এর জন্যে যে ভাবে কেঁদেছেন তার চেয়ে বেশী কাঁদতে আমরা তাঁকে কখনো দেখি নি। তিনি তাঁকে ক্বিবলাহমুখী করে রাখেন। অতঃপর তাঁর জানাযায় দাঁড়িয়ে তিনি এমনভাবে ক্রন্দন করেন যে, শব্দ উঁচু হয়ে যায়।[4]
প্রকৃতপক্ষে শহীদদের দৃশ্য ছিল অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। খাব্বাব ইবনু আরত বর্ণনা করেছেন যে, হামযাহ (রাঃ)-এর জন্যে কালো প্রান্তবিশিষ্ট একটি চাদর ছাড়া কোন কাফন পাওয়া যায় নি। ঐ চাদর দ্বারা মাথা আবৃত করলে পা খোলা থেকে যেত এবং পা আবৃত করলে মাথা খোলা থেকে যেত। অবশেষে মাথা ঢেকে দেয়া হয় এবং পায়ের উপর ইযখির[5] ঘাস চাপিয়ে দেয়া হয়।[6]
আব্দুর রহমান ইবনু আউস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘মুসআব ইবনু উমায়ের (রাঃ) শহীদ হন এবং তিনি আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন। তাঁকে একটি মাত্র চাদর দ্বারা তাঁর মাথা ঢাকলে পা খোলা থাকত এবং পা ঢাকলে মাথা খোলা থেকে যেত।’ এ অবস্থার কথা খাব্বাবও (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি শুধু এটুকু বেশী বলেছেন, ‘(এ অবস্থা দেখে) নাবী (ﷺ) আমাদেরকে বলেন, (غُطُّوْا بِهَا رَأْسَهُ، وَاجْعَلُوْا عَلٰى رِجْلَيْهِ الْإِذْخِرْ) তার মাথা ঢেকে দাও, আর তার পায়ের উপর ইযখির (ঘাষ) ফেলে দাও।’[7]
[2] যাদুল মা‘আদ, ২য় খন্ড ৯৮ পৃঃ, এবং সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড ৫৮৪ পৃঃ।
[3] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড, ৯৪ পৃঃ।
[4] এটা ইবনে শাযানের বর্ণনা। শায়খ আব্দুল্লাহর মুখতাসারুস সীরাহ এর ২৫৫ পৃ: দ্রঃ।
[5] এটা মুযের সাথে সম্পূর্ণরূপে সাদৃশ্যযুক্ত এক প্রকার সুগন্ধময় ঘাস যা বহু জায়গায় চায়ে ফেলে দিয়ে চা তৈরি করা হয়। আরবে এ ঘাস এক হতে দেড় হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। আর হিন্দুস্তানে এটা এক মিটারের চেয়েও বেশী লম্বা হয়।
[6] মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত, ১ম খন্ড ১৪০ পৃঃ।
[7] সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড ৫৭৯ ও ৫৮৪ পৃঃ।