ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
আর-রাহীকুল মাখতূম গাযওয়ায়ে বদরে কুবরা- ইসলামের প্রথম ফায়সালাকারী যুদ্ধ (غَزْوَةُ بَدْرِ الْكُبْرٰى َاوَّلُ مَعْرِكَةٍ مِنْ مُعَارِكِ الْإِسْلَامِ الْفَاصِلَةِ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ)
বনু ক্বাইনুক্কা’র অঙ্গীকার ভঙ্গ (بَنُوْ قَينُقَاع يَنْقُضُوْنَ الْعَهْدَ):

ইহুদীরা যখন দেখল যে, আল্লাহ তা‘আলা বদর প্রান্তরে মুসলিমগণকে চরমভাবে সাহায্য করে তাদেরকে মর্যাদা মন্ডিত করলেন এবং দূরবর্তী নিকটবর্তী প্রতিটি স্থানের বাসিন্দাদের অন্তরে তাদের প্রভাব প্রতিফলিত হল, তখন তাদের প্রতি শত্রুতা ও হিংসায় তারা ফেটে পড়ল। প্রকাশ্যভাবে তারা শত্রুতার ভাব প্রদর্শন করতে লাগল এবং খোলাখুলিভাবে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করল ও দুঃখ কষ্ট দিবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হিংসুটে ও প্রতিহিংসাপরায়ন ছিল কাব বিন আশরাফ, যার আলোচনা সামনে আসছে। অনুরূপভাবে ইহুদীদের তিনটি গোত্রের মধ্যে সর্বাধিক হিংসুটে ছিল বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রটি। এরা সকলেই মদীনার মধ্যে অবস্থান করত এবং তাদের মহল্লাটি তাদের নামেই কথিত ছিল। পেশার দিকে দিয়ে তারা ছিল স্বর্ণকার, কর্মকার ও পাত্র নির্মাতা। এ কারণে ওদের প্রত্যেকের নিকটে বহুল পরিমাণে সমরাস্ত্র মওজুদ ছিল। তাদের যোদ্ধার সংখ্যা সাতশত। তারা ছিল মদীনার সবচেয়ে বাহাদুর ইহুদী গোষ্ঠী। তাদের সর্বপ্রথম অঙ্গীকার ভঙ্গের বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে নিম্নরূপ :

আল্লাহ তা‘আলা যখন বদর প্রান্তরে মুসলিমগণকে বিজয় দান করলেন তখন তাদের বিরুদ্ধাচরণ চরমে উঠল। তারা তাদের প্রতিহিংসা, অন্যায়াচরণ এবং ঝগড়া বাধানোর কার্যকলাপের সীমা আরো বাড়িয়ে দিল। সুতরাং যে মুসলিমই তাদের বাজারে যেতেন তাঁরই তারা ঠাট্টা তামাশা এবং বিদ্রূপাত্মক আচরণ শুরু করে দিত এবং নানাভাবে কষ্ট দিত। এমন কি মুসলিম মহিলাদের নিয়েও তারা উপহাস ও ঠাট্টা বিদ্রূপ করতে কসুর করত না।

এভাবে পরিস্থিতির যখন চরমে পৌঁছল এবং তাদের ঔদ্ধত্যপনা বেড়েই চলল তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং বনু ক্বাইনুক্কা’র বাজারে উপস্থিত হলেন এবং ইহুদীদেরকে ডেকে নানা প্রকার হিতোপদেশ প্রদান করলেন। ইমাম আবূ দাউদ এবং অন্যান্যরা ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বদর প্রান্তরে কুরাইশদেরকে পরাজিত করে যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন বনু ক্বাইনুক্কা’র বাজারে ইহুদীদের একত্রিত করে বললেন, ‘হে ইহুদী সমাজ, তোমরা আনুগত্য স্বীকার কর, অন্যথায় কুরাইশদের মতো তোমাদেরকেও বিপন্ন হতে হবে।’

কিন্তু তারা তাঁর উপদেশ গ্রহণ করল না। চরম ধৃষ্টতা সহকারে তারা বলতে লাগল, ‘হে মুহাম্মাদ কতিপয় আনাড়ী কুরাইশকে হত্যা করেছ বলে গর্বিত হয়ো না। যুদ্ধ সম্বন্ধে তারা একেবারে অনভিজ্ঞ ছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যখন যুদ্ধ হবে তখন বুঝবে যে, ব্যাপারটি কত কঠিন।’ তাদের এ সবের জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‏(‏قُل لِّلَّذِيْنَ كَفَرُوْا سَتُغْلَبُوْنَ وَتُحْشَرُوْنَ إِلٰى جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمِهَادُ‏ قَدْ كَانَ لَكُمْ آيَةٌ فِيْ فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَأُخْرَى كَافِرَةٌ يَرَوْنَهُم مِّثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ وَاللهُ يُؤَيِّدُ بِنَصْرِهِ مَن يَشَاء إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَعِبْرَةً لَّأُوْلِي الأَبْصَارِ‏)‏ ‏[‏آل عمران 12، 13‏]

‘‘যারা কুফরী করে তাদেরকে বলে দাও, ‘তোমরা অচিরেই পরাজিত হবে আর তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে হাঁকানো হবে, ওটা কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থান’! ১৩. তোমাদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে সেই দু’দল সৈন্যের মধ্যে যারা পরস্পর প্রতিদ্বনদ্বীরূপে দাঁড়িয়েছিল (বাদ্র প্রান্তরে)। একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছিল এবং অপরদল ছিল কাফির, কাফিররা মুসলিমগণকে প্রকাশ্য চোখে দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে স্বীয় সাহায্যের দ্বারা শক্তিশালী করে থাকেন, নিশ্চয়ই এতে দৃষ্টিমানদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।’ (আলু-‘ইমরান ৩ : ১২-১৩)

মোট কথা, বনু ক্বাইনুক্কা’ যে জবাব দিয়েছিল তাতে পরিস্কারভাবে যুদ্ধের ঘোষণাই ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ক্রোধ সম্বরণ করে ধৈর্য্য ধারণ করেন। অন্যান্য মুসলিমগণও ধৈর্য্য ধারণ করে পরবর্তী অবস্থার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

এদিকে ঐ হিতোপদেশের পর বনু ক্বাইনুক্কা’র ইহুদীগণের ঔদ্ধত্য আরও বেড়ে যায় এবং অল্প দিনের মধ্যেই তারা মদীনাতে হাঙ্গামা শুরু করে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে তারা নিজের কবর নিজের হাতেই খনন করে এবং নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তোলে।

আবূ আওন থেকে ইবনু হিশাম বর্ণনা করেছেন যে, এ সময়ে জনৈকা মুসলিম মহিলা বানুক্বাইনুক্কা’র বাজারে দুধ বিক্রী করে বিশেষ কোন প্রয়োজনে এক ইহুদী স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বসে পড়েন। কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইহুদী তাঁর মুখের অবগুণ্ঠন খোলাবার অপচেষ্টা করে, তাতে মহিলাটি অস্বীকার করেন। এ স্বর্ণকার গোপনে মহিলাটির পরিহিত বস্ত্রের এক প্রান্ত তার পিঠের উপরে গিরা দিয়েছিল, তিনি তা বুঝতেই পারলেন না। তিনি উঠতে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়লেন। এ ভদ্র মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় প্রত্যক্ষ করে নর পিশাচের দল হো হো করে হাত তালি দিতে থাকল। মহিলাটি ক্ষোভে ও লজ্জায় মৃত প্রায় হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন। তা শুনে জনৈক মুসলিম ঐ স্বর্ণকারকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। প্রত্যুত্তরে ইহুদীগণ মুসলিমটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যা করে।

এরপর নিহত মুসলিমটির পরিবার বর্গ চিৎকার করে ইহুদীদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের নিকট ফরিয়াদ করলেন। এর ফলে মুসলিম ও বনু ক্বাইনুক্কা’র ইহুদীদের মধ্যে সংঘাত বেধে গেল।[1]

[1] ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৪৭ পৃঃ।