গিরি সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পর পূর্বের মতো আবারও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দাওয়াত এবং তাবলীগের কাজ আরম্ভ করে দিলেন। অপরপক্ষে মুশরিকগণ যদিও বয়কট পরিহার করে নিয়েছিল, কিন্তু তবুও পূর্বের মতই মুসলিমদের উপর চাপসৃষ্টি এবং আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে থাকল। আবূ ত্বালিবও পূর্বের মতই জীবন বাজি রেখে ভ্রাতুষ্পুত্রকে সাহায্য করতে থাকলেন এবং তাঁর নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে থাকলেন। কিন্তু এখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ এবং বিশেষ করে গিরি সংকটে তিন বছর যাবৎ অবর্ণনীয় অভাব-অনটনের মধ্যে আবদ্ধ জীবন-যাপন করার ফলে তাঁর শক্তি সামর্থ্য প্রায় নিঃশেষিত হয়ে পড়েছিল এবং কোমর বক্রাকার ধারণ করেছিল। গিরি সংকটের আবদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে আসার পর এ সব কারণে তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঐ সময় মুশরিকগণ চিন্তা-ভাবনা করল যে, যদি আবূ ত্বালীবের মৃত্যু হয় এবং তারা তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের উপর অন্যায়-অত্যাচার করে তবে এতে তাদের খুব বড় রকমের বদনাম হয়ে যাবে। এ কারণে আবূ ত্বালীবের সামনেই মুহাম্মাদ (ﷺ) সম্পর্কে কোন একটা সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়া উচিত। এ ব্যাপারে তিনি কিছুটা সুযোগ-সুবিধাও দিতে পারেন আগে কোন দিনই যা দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। এ চিন্তা ভাবনার প্রেক্ষাপটে একটি কুরাইশ প্রতিনিধিদল আবূ ত্বালীবের নিকট গিয়ে উপস্থিত হল এবং এটিই ছিল তাঁর নিকট অনুরূপ শেষ প্রতিনিধি দল।
ইবনে ইসহাক্ব এবং অন্যান্যদের বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, যখন অসুস্থ আবূ ত্বালিব শয্যাগত হয়ে পড়লেন এবং দিনে দিনে তাঁর অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকল তখন কুরাইশগণ এ মর্মে পরস্পর বলাবলি করতে থাকল যে, ‘হামযাহ ও উমার মুসলিম হয়ে গিয়েছে এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ধর্ম বিভিন্ন কুরাইশ গোত্রে বিস্তার লাভ করেছে। কাজেই, চল আমরা আবূ ত্বালীবের নিকট গিয়ে তাঁকে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের ধর্ম প্রচার থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে একটি অঙ্গীকার আদায়ের কথা বলি এবং আমাদের পক্ষ থেকেও কোন প্রকার অনিষ্ট না করার ব্যাপারে তাঁর অনুকূলে একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করে নেই। কারণ, এ ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত ভীত এবং আতংকিত যে, এই ধারায় মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর প্রচার অব্যাহত রাখলে লোকজনেরা তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করে আমাদের আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে।
অন্য এক বর্ণনায় কুরাইশগণের বক্তব্য এ মর্মে প্রমাণ করা হয়েছে ‘আমাদের ভয় হচ্ছে যে, বৃদ্ধ আবূ ত্বালিব মৃত্যু বরণ করলে এবং তারপর মুহাম্মাদ(ﷺ)-এর সঙ্গে কোন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে গেলে আরবের লোকেরা আমাদের নিন্দা করবে এবং বলবে যে, তারা মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে ছেড়ে রেখেছিল। (অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে কোন কিছুই করতে পারে নি) কিন্তু যখন তাঁর চাচা মৃত্যু মুখে পতিত হলেন তখন তারা তাঁর উপর আক্রমণ করে বসল।
যাহোক, এ কুরাইশ প্রতিনিধি দল আবূ ত্বালীবের নিকট গিয়ে পৌঁছল এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও মত বিনিময় করল। কুরাইশগণের মধ্য থেকে বিশিষ্ট এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে এই প্রতিনিধিদ দল গঠিত হয়েছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্যে ছিলেন উতবাহ বিন রাবী’আহহ্, শায়বাহ বিন রাবী’আহ, আবূ জাহল বিন হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, এবং আবূ সুফইয়ান বিন হারব। এ প্রতিনিধিদলে ছিল মোট পাঁচ জন সদস্য।
বৃদ্ধ আবূ ত্বালিবকে সম্বোধন করে তারা বলল, ‘হে আবূ ত্বালিব! আমাদের মধ্যে মান-মর্যাদার যে আসনে আপনি সমাসীন রয়েছেন তা সম্যক অবহিত রয়েছেন এবং বর্তমানে যে অবস্থার মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করছেন তাও আপনার নিকট সুস্পষ্ট। আমাদের ভয় হচ্ছে যে, আপনি আপনার জীবনের অন্তিম পর্যায় অতিবাহিত করছেন। এ দিকে আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র এবং আমাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও মতদ্বৈধতা চলে আসছে সেও আপনার অজানা নেই। আমরা চাচ্ছি যে, আপনি তাঁকে ডাকিয়ে নেবেন এবং তাঁর সম্পর্কে আমাদের নিকট থেকে এবং আমাদের সম্পর্কে তাঁর নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করবেন। এ অঙ্গীকারের উদ্দেশ্য হবে আমরা তাঁর থেকে এবং সে আমাদের থেকে পৃথক থাকবে। অর্থাৎ আমাদের ধর্মমতের উপর সে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না এবং আমরাও তার ধর্মমতের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করব না।
কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে আবূ ত্বালিব তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে ডাকিয়ে নিলেন এবং বললেন ভ্রাতুষ্পুত্র! তুমি অবশ্যই অবগত আছ যে, এরা হচ্ছেন তোমার স্বজাতীয় সম্মানিত ব্যক্তি। তোমার জন্যই এরা এখানে সমবেত হয়েছেন। এরা চাচ্ছেন যে, তোমাকে কিছু ওয়াদা বা অঙ্গীকার প্রদান করবেন এবং তোমাকেও তাঁদের কিছু ওয়াদা বা অঙ্গীকার প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ ধর্মমতের ব্যাপারে তাঁরা তোমার প্রতি কোন কটাক্ষ করবেন না এবং তুমিও তাঁদের প্রতি কোন প্রকার কটাক্ষ করবে না।
প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রতিনিধিদলকে সম্বোধন করে বললেন,
(أَرَأَيْتُمْ إِنْ أُعْطِيْتُكُمْ كَلِمَةً تَكَلَّمْتُمْ بِهَا، مَلَّكْتُمْ بِهَا الْعَرَبَ، وَدَانَتْ لَكُمْ بِهَا الْعَجَمُ)
‘আমি যদি এমন একটি প্রস্তাব পেশ করি যা মেনে নিলে গোটা আরবের সম্রাট হওয়া যাবে এবং আজম অধীনস্থ হয়ে যাবে তাহলে এ ব্যাপারে আপনাদের মতামত কী হতে পারে তা বলুন। কোন কোন বর্ণনায় এমনটিও বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর চাচা আবূ ত্বালিবকে সম্বোধন করে বলেছেন, চাচা জান! আমি তাঁদের নিকট থেকে এমন এক প্রস্তাবের প্রতি স্বীকৃতি ও সমর্থন চাই যা মেনে নিলে সমগ্র আরব জাহান তাঁদের অধীনস্থ হয়ে যাবে এবং আজম তাঁদের নিকট কর দিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হবে।
অন্য এক বর্ণনায় কথাও উল্লেখ রয়েছে যে, নাবী (ﷺ) বললেন, ‘চাচাজান! আপনি তাদেরকে এমন কথার প্রতি আহবান জানান না কেন যা প্রকৃতই তাদের মঙ্গল জনক।’
তিনি বললেন, তুমি কোন্ কথার প্রতি তাদের আহবান জানাতে বলছ?
নাবী (ﷺ) বললেন, আমি এমন এক কথার প্রতি আহবান জানাচ্ছি যে, কথা মেনে নিলে সমগ্র আরব তাদের অধীনস্থ হয়ে যাবে এবং অনারবদের উপর তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। ইবনে ইসহাক্বের এক বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের বললেন,
كلمة واحدة تعطونها تملكون بها العرب وتدين لكم بها العجم
‘‘আপনারা শুধুমাত্র একটি কথা মেনে নিন যার বদৌলতে আপনারা হয়ে যাবেন আরবের সম্রাট এবং আজম হয়ে যাবে আপনাদের অধীনস্থ।’’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুখ থেকে যখন তার একথা শুনল তখন তারা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে গেল এবং মনে হল যেন তাদের হতবুদ্ধিতায় পেয়ে বসেছে। মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শুধু একটি কথা মেনে নিলে তারা এত বেশী লাভবান হতে পারবে এ চিন্তা তাদের মন মগজকে একদম আচ্ছন্ন করে ফেলল। তারা মনে মনে বলতে থাকল যে, একটি মাত্র কথাতে যদি এত বড় উপকার হয় তাহলে তা ছেড়ে দেয়া যায় কী করে? আবূ জাহল বলল, ‘আচ্ছা তুমি বলত ঠিক সে কথাটি কী? তোমার পিতার কসম, কথাটা যদি সত্য হয় তাহলে একটি কেন দশটি বললেও আমরা মান্য করতে প্রস্তুত আছি।’ নাবী (ﷺ) বললেন,
(لَا إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ ، وَتَخْلَعُوْنَ مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ)
‘‘আপনারা বলুন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আল্লাহ ছাড়া যার উপাসনা করেন তা পরিহার করুন।’’
নাবী কারীম (ﷺ)-এর এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে তারা হাতে হাত মারতে মারতে এবং তালি দিতে দিতে বলল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) তুমি এটাই চাচ্ছ যে, সকল আল্লাহর জায়গায় মাত্র এক আল্লাহকে আমরা মেনে নেই। বাস্তবিক তোমার ব্যাপার বড়ই আশ্চর্য্যজনক!’
তারপর তারা নিজেদের মধ্যে একে অন্যকে বলল, ‘আল্লাহর শপথ! এ ব্যক্তি তোমাদের একটি কথাও মান্য করার জন্য প্রস্তুত নয়। অতএব, চলো এবং পূর্ব পুরুষগণের নিকট থেকে বংশ পরম্পরা সূত্রে প্রাপ্ত দ্বীনের উপরেই অটল থাক যাবৎ আল্লাহ আমাদের এবং তার মধ্যে একটা মীমাংসা করে না দেন। এর পর তারা নিজ নিজ রাস্তায় চলে গেল।
এ ঘটনার পর সেই সব লোকজনকে কেন্দ্র করে কুরআন মাজীদে এ আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হল[1] :
(ص وَالْقُرْآنِ ذِي الذِّكْرِ بَلِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ عِزَّةٍ وَشِقَاقٍ كَمْ أَهْلَكْنَا مِن قَبْلِهِم مِّن قَرْنٍ فَنَادَوْا وَلَاتَ حِيْنَ مَنَاصٍ وَعَجِبُوْا أَن جَاءهُم مُّنذِرٌ مِّنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُوْنَ هٰذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ أَجَعَلَ الآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ وَانطَلَقَ الْمَلأُ× مِنْهُمْ أَنِ امْشُوْا وَاصْبِرُوْا عَلٰى آلِهَتِكُمْ إِنَّ هٰذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ مَا سَمِعْنَا بِهٰذَا فِي الْمِلَّةِ الآخِرَةِ إِنْ هٰذَا إِلَّا اخْتِلَاقٌ) [ص:1: 7]
‘‘১. সা‘দ, নাসীহাতে পূর্ণ কুরআনের শপথ- (এটা সত্য)। ২. কিন্তু কাফিররা আত্মম্ভরিতা আর বিরোধিতায় নিমজ্জিত। ৩. তাদের পূর্বে আমি কত মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছি, অবশেষে তারা (ক্ষমা লাভের জন্য) আর্তচিৎকার করেছিল, কিন্তু তখন পরিত্রাণ লাভের আর কোন অবকাশই ছিল না। ৪. আর তারা (এ ব্যাপারে) বিস্ময়বোধ করল যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন সতর্ককারী এসেছে। কাফিরগণ বলল- ’এটা একটা যাদুকর, মিথ্যুক। ৫. সে কি সব ইলাহকে এক ইলাহ বানিয়ে ফেলেছে? এটা বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার তো!’ ৬. তাদের প্রধানরা প্রস্থান করল এই ব’লে যে, ‘তোমরা চলে যাও আর অবিচলিত চিত্তে তোমাদের ইলাহ্দের পূজায় লেগে থাক। অবশ্যই এ ব্যাপারটির পিছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে। ৭. এমন কথা তো আমাদের নিকট অতীতের মিল্লাতগুলো থেকে শুনিনি। এটা শ্রেফ একটা মন-গড়া কথা।’ ( সোয়াদ ৩৮ : ১-৭)