ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
নবীদের কাহিনী ২৫. হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাক্কী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
দ্বিতীয়বার আগমন (المرة الثانية প্রথমবারের কিছু পরে)

মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নির্যাতনের ভয়ে সকলে পার্শ্ববতী খ্রিষ্টান রাজ্য হাবশায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়ায় নেতারা প্রমাদ গুণলেন। অতঃপর বিদেশে তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এবং হিজরতকারীদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমর ইবনুল ‘আছ ও আবু জাহলের বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহকে নাজাশীর দরবারে প্রেরণ করেন। কিন্তু তারা নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মুহাম্মাদের দাওয়াত একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তাকে হত্যা করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যেকোন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পথে সবচাইতে বড় বাধা হ’লেন তার চাচা বর্ষীয়ান ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় গোত্রনেতা আবু ত্বালিব। ফলে নেতারা পুনরায় আবু তালেবের কাছে এলেন এবং বললেন, আমাদের মধ্যে বয়সে, সম্মানে ও পদমর্যাদায় আপনি বিশেষ স্থানের অধিকারী। আমরা চেয়েছিলাম যে, আপনি আপনার ভাতিজাকে বিরত রাখবেন। কিন্তু আপনি তাকে বিরত রাখেননি। আল্লাহর কসম! আমরা আর এ ব্যক্তির ব্যাপারে ধৈর্য রাখতে পারছি না। কেননা এ ব্যক্তি আমাদের বাপ-দাদাদের গালি দিচ্ছে, আমাদের জ্ঞানীদের বোকা বলছে, আমাদের উপাস্যদের দোষারোপ করছে’। এক্ষণে হয় আপনি তাকে বিরত রাখুন, নয়তো আমরা তাকে ও আপনাকে এ ব্যাপারে একই পর্যায়ে নামাবো। যতক্ষণ না আমাদের দু’পক্ষের একটি পক্ষ ধ্বংস হয়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, الَّذِي قَدْ خَالَفَ دِينَكَ وَدِينَ آبَائِكَ، وَفَرَّقَ جَمَاعَةَ قَوْمِكَ، وَسَفَّهُ أَحْلاَمَهُمْ، فَنَقْتُلَهُ ‘সে আপনার ও আপনার বাপ-দাদাদের দ্বীনের বিরোধিতা করেছে, আপনার সম্প্রদায়ের ঐক্যকে বিভক্ত করেছে এবং তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছে। অতএব আমরা তাকে হত্যা করব’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৭)।

গোত্রনেতাদের এই চূড়ান্ত হুমকি শুনে আবু তালেব দুশ্চিন্তায় পড়লেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-কে ডেকে এনে বললেন, يَا ابْنَ أَخِي إنّ قَوْمَك قَدْ جَاءُوْنِي فَقَالُوا لِي كَذَا وَكَذَا ... وَلاَ تُحَمِّلْنِي مِنَ الْأَمْرِ مَا لاَ أُطِيْقُ ‘হে ভাতিজা! তোমার বংশের নেতারা আমার কাছে এসেছিলেন এবং তারা এই এই কথা বলেছেন।... অতএব তুমি আমার উপরে এমন বোঝা চাপিয়ো না, যা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই’। চাচার এই কথা শুনে তিনি তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন ধারণা করে সাময়িকভাবে বিহবল নবী আল্লাহর উপরে গভীর আস্থা রেখে বলে উঠলেন, يَا عَمِّ، وَاللهِ لَوْ وَضَعُوا الشَّمْسَ فِي يَمِينِي، وَالْقَمَرَ فِي يَسَارِي عَلَى أَنْ أَتْرُكَ هَذَا الْأَمْرَ حَتَّى يُظْهِرَهُ اللهُ، أَوْ أَهْلِكَ فِيْهِ، مَا تَرَكْتُه ‘হে চাচাজী! যদি তারা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় তাওহীদের এই দাওয়াত বন্ধ করার বিনিময়ে, আমি তা কখনোই পরিত্যাগ করব না। যতক্ষণ না আল্লাহ এই দাওয়াতকে বিজয়ী করেন অথবা আমি তাতে ধ্বংস হয়ে যাই’ বলেই তিনি অশ্রুভরা নয়নে চলে যেতে উদ্যত হলেন। পরম স্নেহের ভাতিজার এই অসহায় দৃশ্য দেখে বয়োবৃদ্ধ চাচা তাকে পিছন থেকে ডাকলেন। তিনি তার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই চাচা বলে উঠলেন, إِذْهَبْ يَا بْنَ أَخِي، فَقُلْ مَا أَحْبَبْتَ، فَوَاللهِ لاَ أُسْلِمُكَ لِشَيْءٍ أَبَدًا ‘যাও ভাতিজা! তুমি যা খুশী প্রচার কর। আল্লাহর কসম! কোন কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে ওদের হাতে তুলে দেব না’।[1] এ সময় তিনি পাঁচ লাইন কবিতার মাধ্যমে স্বীয় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যেমন,

وَاللهِ لَنْ يَصِلُوا إِلَيْكَ بِجَمْعِهِمْ * حَتَّى أُوَسَّدَ فِي التُّرَابِ دَفِينَا

فَامْضِيْ لِأَمْرِكَ مَا عَلَيْكَ غَضَاضَةٌ * أَبْشِرْ وَقَرَّ بِذَاكَ مِنْكَ عُيُونَا

‘আল্লাহর কসম! তারা কখনোই তাদের সম্মিলিত শক্তি নিয়েও তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি মাটিতে সমাহিত হব’। ‘অতএব তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। তোমার উপরে কোন বাধা আসবে না। তুমি খুশী হও এবং এর ফলে তোমার থেকে চক্ষুসমূহ শীতল হৌক’ (আল-বিদায়াহ ৩/৪২)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে তাঁর চাচার মাধ্যমে শত্রুদের হাত থেকে হেফাযত করেন। আল্লাহর এই বিধান সকল যুগের নিষ্ঠাবান মুমিনের জন্য সর্বদা কার্যকর।

[1]. ইবনু হিশাম ১/২৬৫-৬৬।

(১) প্রসিদ্ধ এ বর্ণনাটির সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২৬৬; যঈফাহ হা/৯০৯)। তবে উক্ত মর্মের অন্য বর্ণনাটি ‘হাসান’। যেখানে বলা হয়েছে, রাসূল (ছাঃ) আকাশের দিকে চোখ উঠিয়ে চাচাদের উদ্দেশ্যে বললেন,أَتَرَوْنَ هَذِهِ الشَّمْسَ؟ قَالُوا: نَعَمْ، قَالَ: مَا أَنَا بَأَقْدَرِ عَلَى أَنْ أَدَعَ لَكُمْ ذَلِكَ أَنْ تَشتعِلُوا لِي مِنْهَا بِشُعْلَةٍ، فَقَالَ أَبُو طَالِبٍ: مَا كَذَبَنَا ابْنُ أَخِي فَارْجِعُوا- ‘আপনারা কি এই সূর্যকে দেখছেন? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি আপনাদের কারণে আমার দাওয়াত পরিত্যাগ করব না, যতক্ষণ না আপনারা ঐ সূর্য থেকে আমার জন্য একটা স্ফুলিঙ্গ এনে দিবেন’। তখন আবু ত্বালিব বললেন, আমার ভাতিজা কখনোই আমাদেরকে মিথ্যা বলে না। অতএব তোমরা ফিরে যাও’ (হাকেম হা/৬৪৬৭); ছহীহাহ হা/৯২; মা শা-‘আ ৩০ পৃঃ।

(২) ইবনু ইসহাক এখানে নেতাদের তৃতীয় আরেকটি প্রতিনিধি দলের আগমনের কথা বলেছেন। যা রীতিমত বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য। তিনি সূত্রবিহীনভাবে লিখেছেন যে, নেতারা মক্কার ধনীশ্রেষ্ঠ ও অন্যতম নেতা অলীদ বিন মুগীরাহ্র পুত্র উমারাহ বিন অলীদ (عُمارة)-কে সাথে নিয়ে গেলেন এবং আবু ত্বালিবকে বললেন, হে আবু ত্বালিব! এই ছেলেটি হ’ল কুরায়েশদের সবচেয়ে সুন্দর ও ধীমান যুবক। আপনি একে পুত্ররূপে গ্রহণ করুন এবং মুহাম্মাদকে আমাদের হাতে সোপর্দ করুন’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৬-৬৭; আর-রাহীক্ব ৯৭-৯৮ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ’ (মা শা-‘আ ৩২ পৃঃ)। নিঃসন্দেহে এটি অবাস্তবও বটে।