বনু খোযা‘আহ গোত্রের জনৈকা মহিলা উম্মে আনমার-এর গোলাম ছিলেন। তিনি ষষ্ঠ মুসলমান ছিলেন এবং দুর্বলদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম ইসলাম প্রকাশকারী এবং আললাহ্র পথে কঠিন নির্যাতন ভোগকারী’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ২২১২)। মুসলমান হওয়ার অপরাধে মুশরিক নেতারা তার উপরে লোমহর্ষক নির্যাতন চালায়। নানাবিধ অত্যাচারের মধ্যে সবচাইতে মর্মান্তিক ছিল এই যে, তাকে জ্বলন্ত লোহার উপরে চিৎ করে শুইয়ে বুকের উপরে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছিল। ফলে পিঠের চামড়া ও মাংস গলে লোহার আগুন নিভে গিয়েছিল। বারবার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গমন করেন। তখন তিনি কা‘বা চত্বরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করার জন্য আকুলভাবে দাবী করেন। তখন উঠে রাগতঃস্বরে রাসূল (ছাঃ) তাকে দ্বীনের জন্য বিগত উম্মতগণের কঠিন নির্যাতন ভোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং বলেন,
كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِى الأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ، فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ، مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ، لاَ يَخَافُ إِلاَّ اللهَ أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ
‘তোমাদের পূর্বেকার জাতিসমূহের লোকদের দ্বীনের কারণে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। অতঃপর তাতে নিক্ষেপ করে তাদের মাথার মাঝখানে করাত রেখে দেহকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। তথাপি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। লোহার চিরুনী দিয়ে মাংস ও শিরাসমূহ হাড্ডি থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছে। তথাপি এগুলি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তিনি এই ইসলামী শাসনকে এমনভাবে পূর্ণতা দান করবেন যে, একজন আরোহী (ইয়ামনের রাজধানী) ছান‘আ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। অথচ সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করবে না। অথবা তার ছাগপালের উপরে নেকড়ের ভয় করবে। কিন্তু তোমরা বড়ই ব্যস্ততা দেখাচ্ছ’।[1] এ হাদীছ শোনার পরে তার ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়।
খাববাব কর্মকারের কাজ করতেন। তিনি কুরাইশ নেতা ‘আছ বিন ওয়ায়েল-এর জন্য একটি তরবারী তৈরী করে দেন। পরে তার মূল্য নিতে গেলে ‘আছ বলেন, আমি তোমাকে মূল্য দিব না, যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদের সাথে কুফরী করবে। জবাবে খাববাব বললেন, বরং যতক্ষণ না আপনি মরবেন ও পুনরুত্থিত হবেন’। ‘আছ তাকে বিদ্রুপ করে বললেন, ‘ঠিক আছে ক্বিয়ামতের দিনেও আমার নিকটে মাল-সম্পদ ও সন্তানাদি থাকবে, সেখানে তোমার পাওনা পরিশোধ করে দিব’। তখন নাযিল হয়,أَفَرَأَيْتَ الَّذِي كَفَرَ بِآيَاتِنَا وَقَالَ لَأُوتَيَنَّ مَالاً وَوَلَدًا- أَطَّلَعَ الْغَيْبَ أَمِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে, যে আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখান করে এবং বলে, আমাকে অবশ্যই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেওয়া হবে’। ‘সে কি অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত হয়েছে, না-কি দয়াময়ের নিকট থেকে সে কোন প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে?’ (মারিয়াম ১৯/৭৭-৭৮)।[2]
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা মুসলমানদের কেবল দৈহিক নির্যাতনই করেনি, বরং জাহেলী যুগের বিখ্যাত হিলফুল ফুযূল-এর চুক্তিনামাও তারা ভঙ্গ করেছিল, যা ছিল কুরাইশদের চিরাচরিত রীতির বিরোধী। কেননা মুসলমানদের ক্ষেত্রে তারা সকল প্রকার যুলুমকে সিদ্ধ মনে করত। আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, মুসলমানের সংখ্যা যখন কম ছিল, তখন তারা দ্বীনের কারণে ফিৎনায় পতিত হ’ত। হয় তাদেরকে হত্যা করা হ’ত, নয় তাদেরকে চরমভাবে নির্যাতন করা হ’ত। অবশেষে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, তখন আর ফিৎনা রইল না’ (বুখারী হা/৪৬৫০)।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) একদিন খাববাবকে ডেকে বলেন, তোমার উপরে নির্যাতনের কাহিনী আমাকে একটু শুনাও। তখন তিনি নিজের পিঠ দেখিয়ে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পিঠ দেখুন। আমাকে জ্বলন্ত লোহার গনগনে আগুনের উপরে চাপা দিয়ে রাখা হ’ত। আমার পিঠের মাংস গলে উক্ত আগুন নিভে যেত’। তখন ওমর (রাঃ) বলেন, এরূপ দৃশ্য আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি’। তিনি খারেজীদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে এবং পরে ছিফফীনের যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে ছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বদর-ওহোদসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
আলী (রাঃ) ৩৭ হিজরীতে ছিফফীন যুদ্ধে রওয়ানার পর ৬৩ বছর বয়সে খাববাব (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে আলী (রাঃ) তাঁর কবর যিয়ারত করেন। অতঃপর বলেন,رَحِمَ اللهُ خَبَّابًا، لَقَدْ أَسْلَمَ رَاغِبًا، وَهَاجَرَ طَائِعًا، وَعَاشَ مُجَاهِدًا، وَابْتُلِيَ فِي جِسْمِهِ أَحْوَالاً، وَلَنْ يُضَيِّعَ اللهُ أَجْرَهُ ‘আল্লাহ রহম করুন খাববাবের উপর, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আগ্রহের সাথে, হিজরত করেছিলেন আনুগত্যের সাথে, জীবন যাপন করেছেন মুজাহিদ হিসাবে, নির্যাতিত হয়েছেন দৈহিকভাবে বিভিন্ন অবস্থায়। অতএব কখনোই আল্লাহ তার পুরস্কার বিনষ্ট করবেন না’। সম্ভবতঃ যৌবনকালে লোহার আগুনে পিঠ পুড়িয়ে দেওয়ার যন্ত্রণাদায়ক ঘা থেকে পরবর্তীতে তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। যেকারণ মাঝে-মধ্যে বলতেন, মৃত্যু কামনা নিষিদ্ধ না হ’লে আমি সেটাই কামনা করতাম।[3]
ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর আমলে যখন মুসলমানদের সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তখন অগ্রবর্তী মুহাজির হিসাবে খাববাব (রাঃ)-এর জন্য বড় অংকের রাষ্ট্রীয় ভাতা নির্ধারণ করা হয়। যাতে তিনি বহু সম্পদের অধিকারী হন এবং কূফাতে বাড়ি করেন। এসময় তিনি একটি কক্ষে অর্থ জমা রাখতেন। যা তার সাথীদের জানিয়ে দিতেন। অতঃপর অভাবগ্রস্তরা সেখানে যেত এবং প্রয়োজনমত নিয়ে নিত। তিনি বলতেন,وَلَقَدْ رَأَيْتُنِي مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا أَمْلِكُ دِينَارًا وَلا دِرْهَمًا وَإِنَّ فِي نَاحِيَةِ بَيْتِي فِي تَابُوتِي لأَرْبَعِينَ أَلْفٍ وَافٍ وَلَقَدْ خَشِيتُ أَنْ تَكُونَ قَدْ عُجِّلَتْ لَنَا طَيِّبَاتُنَا فِي حَيَاتِنَا الدُّنْيَا ‘আমি যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম, তখন আমি একটি দীনার বা দিরহামেরও মালিক ছিলাম না। আর এখন আমার সিন্দুকের কোণায় চল্লিশ হাযার দীনার জমা আছে। আমি ভয় পাচ্ছি আল্লাহ আমার সকল নেক আমলের ছওয়াব আমার জীবদ্দশায় আমার ঘরেই দিয়ে দেন কি-না!’। মৃত্যুর সময় তাকে পরিচর্যাকারী জনৈক সাথী বললেন,أَبْشِرْ يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ، فَإِنَّكَ مُلاَقٍ إِخْوَانَكَ غَدًا ‘হে আবু আব্দুল্লাহ! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কেননা কালই আপনি আপনার সাথীদের সঙ্গে মিলিত হবেন’। জবাবে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন,ذَكَّرتموني أقواماً، وإخواناً مَضَوْا بِأُجُورهم كُلِّهَا لَمْ يَنالُوا مِنَ الدُّنيا شَيْئًا ‘তোমরা আমাকে এমন ভাইদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে, যারা তাদের সম্পূর্ণ নেকী নিয়ে বিদায় হয়ে গেছেন। দুনিয়ার কিছুই তারা পাননি’। আর আমরা তাঁদের পরে বেঁচে আছি। অবশেষে দুনিয়ার অনেক কিছু পেয়েছি। অথচ তাঁদের জন্য আমরা মাটি ব্যতীত কিছুই পাইনি। এসময় তিনি তার বাড়ি এবং বাড়ির সম্পদ রাখার কক্ষের দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, মদীনায় প্রথম দাঈ ও ওহোদ যুদ্ধের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন উমায়ের শহীদ হওয়ার পর কিছুই ছেড়ে যায়নি একটি চাদর ব্যতীত। অতঃপর তিনি তার কাফনের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা হামযার জন্য এতটুকু কাফনও জুটেনি। মাথা ঢাকলে পা ঢাকেনি। পা ঢাকলে মাথা ঢাকেনি। অতঃপর সেখানে ইযখির ঘাস দিয়ে ঢাকা হয়েছিল’।[4]
[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৭; আহমাদ হা/২১১০৫, ২১১১২; সনদ ছহীহ -আরনাঊত্ব।
[3]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৩৬১৮; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫৬৩২; আল-ইছাবাহ, খাববাব ক্রমিক ২২১২।
[4]. ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৩/১২২-২৩; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৮৪।
উল্লেখ্য যে, ছাহাবীগণের উপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ইবনু ইসহাক সাঈদ বিন জুবায়ের হ’তে বর্ণনা করেন যে, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-কে বললাম, মুশরিকরা কি ছাহাবীগণকে দ্বীন ত্যাগ করার শর্তে শাস্তি দিত? জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! যখন তারা মুসলমানদের কাউকে মারপিট করত, তাদেরকে ক্ষুধার্ত রাখত ও পিপাসায় কাতর করে ফেলত এবং অবশেষে অবস্থা এমন হ’ত যে, তারা উঠে বসার ক্ষমতা রাখত না। তখন তাদের বলা হ’ত, আল্লাহকে ছেড়ে লাত-‘উযযাকে উপাস্য ধর। তারা না বললে আরও কঠিনভাবে অত্যাচার করা হ’ত। ফলে তারা বলতেন, হ্যাঁ। এমনকি গোবরের বড় কালো পোকা তাদের কারু সামনে এনে বলা হ’ত এই পোকা কি তোমার উপাস্য? কঠিন কষ্টের কারণে তিনি বলতেন, হ্যাঁ’ (ইবনু হিশাম ১/৩২০; ফাৎহুল বারী হা/৩৮৫৬-এর আলোচনা)। এ বক্তব্য যঈফ (মা শা-‘আ ৩৪ পৃঃ)। বরং সঠিক সেটাই যা ইবনু মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে (আহমাদ হা/৩৮৩২)।