(ক) আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (ছাঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসে বলাবলি করতে লাগল, কে উটের নাড়ি-ভুঁড়ি এনে এই ব্যক্তির উপর চাপাতে পারে, যখন সে সিজদায় যাবে? তখন ওক্ববা বিন আবী মু‘আইত্ব উটের ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুঁড়ির চাপে ও দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এতে শত্রুরা হেসে লুটোপুটি খেয়ে একে অপরের উপর গড়িয়ে পড়তে থাকে। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ছিল না। এই সময় ফাতেমার কাছে খবর পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। ইবনু হাজার বলেন, সম্ভবতঃ খবরটি রাবী নিজেই দিয়েছিলেন (বুখারী ফৎহসহ হা/৫২০-এর আলোচনা)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,
اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ، اللهُمَّ عَلَيْكَ بِقُرَيْشٍ- ثُمَّ سَمَّى- اللهُمَّ عَلَيْكَ بِعَمْرِو بْنِ هِشَامٍ، وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَشَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ، وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ، وَأُمَيَّةَ بْنِ خَلَفٍ، وَعُقْبَةَ بْنِ أَبِى مُعَيْطٍ، وَعُمَارَةَ بْنِ الْوَلِيدِ، قَالَ عَبْدُ اللهِ فَوَاللهِ لَقَدْ رَأَيْتُهُمْ صَرْعَى يَوْمَ بَدْرٍ، ثُمَّ سُحِبُوا إِلَى الْقَلِيبِ قَلِيبِ بَدْرٍ- متفق عليه-
‘হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধর (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম (আবু জাহল)-কে ধর। হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধর’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’।[1] উটের ভুঁড়ি চাপানোর এই নির্দেশ আবু জাহলই দিয়েছিলেন এবং অন্যেরা তা মেনে নিয়েছিল। সেমতে তার আগের দিন উটসমূহ নহর করা হয়েছিল।[2]
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নেককার ব্যক্তির দো‘আ বা বদ দো‘আ অবশ্যই আল্লাহর নিকটে কবুল হয়। তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হ’তে পারে অথবা আল্লাহ তার থেকে অনুরূপ একটি কষ্ট দূর করে দেন অথবা সেটি আখেরাতে প্রদানের জন্য রেখে দেন’ (আহমাদ হা/১১১৪৯)। কিন্তু আখেরাতের জন্য রেখে দেওয়ার কারণে বদকারগণ ঐ বদ দো‘আর কোন গুরুত্ব দেয় না। বরং পুনরায় কঠিনভাবে শত্রুতা করতে থাকে। যেমন আবু জাহ্ল গং রাসূল (ছাঃ)-এর বদ দো‘আ শুনে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে তা ভুলে যায় এবং বিপুল উৎসাহে শত্রুতা করতে থাকে। ফলে এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর বদর যুদ্ধে তাদের উপরে উক্ত বদ দো‘আর বাস্তবায়ন ঘটে ও সব নেতা একত্রে নিহত হয়। আর বদর যুদ্ধের পর এক সপ্তাহের মধ্যে আরেক নেতা আবু লাহাব গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পচে-গলে দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায় মক্কায় নিজ গৃহে মারা যায়। এভাবে মযলূম নবী বিজয়ী হন ও যালেম নেতারা ধ্বংস হয়।
উল্লেখ্য যে, রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) উক্ত হাদীছে বর্ণিত মুশরিক নেতাদের সবাইকে বদরের যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হ’তে দেখেছেন’ বলে যে কথা বর্ণনায় এসেছে, তার অর্থ হ’ল তিনি এদের ‘অধিকাংশ’কে দেখেছেন। কেননা ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব বদরে যুদ্ধাবস্থায় নিহত হননি। বরং তাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার পথে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়। উমাইয়া বিন খালাফ বদরে নিহত হ’লেও উক্ত কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হননি। বরং অধিক স্থূলদেহী হওয়ায় ও ফুলে যাওয়ার কারণে কূয়ায় ফেলা সম্ভব হয়নি। ফলে তাকে কূয়ার অদূরে একটি গর্তে ফেলে মাটি ও পাথর চাপা দেওয়া হয়।[3] অতঃপর ‘উমারাহ বিন অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী, যাকে কুরায়েশরা দূত হিসাবে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে পাঠিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে জাদুর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর হাবশার জঙ্গলে কাফের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। তখন ছিল দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকাল।[4]
(খ) একদিন ছালাতরত অবস্থায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এসে গলায় জোরে কাপড় পেঁচিয়ে ধরল, যাতে রাসূল (ছাঃ) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে গিয়ে এ খবর দিলে আবুবকর (রাঃ) ছুটে এসে পেঁচানো কাপড় খুলে দিলেন ও বদমায়েশগুলিকে ধিক্কার দিয়ে বললেন,أَتَقْتُلُونَ رَجُلاً أَنْ يَقُولَ رَبِّىَ اللهُ؟ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ ‘তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছ, যিনি বলেন আমার প্রভু আল্লাহ। অথচ তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ এ সময় তারা রাসূল (ছাঃ)-কে ছেড়ে আবুবকরকে বেদম প্রহার করে’ (বুখারী, হা/৬৩৭৮, ৪৮১৫)।
ওরওয়া বিন যুবায়ের বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, মুশরিকরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সবচাইতে কষ্টদায়ক আচরণ কোনটি করেছিল, আমাকে বলুন। তখন তিনি ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের অত্র ঘটনাটি বর্ণনা করেন’ (বুখারী হা/৩৮৫৬)।
রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের অত্র ঘটনায় তার প্রিয় আবুবকরের উপরোক্ত বক্তব্য অন্যূন দু’হাযার বছর পূর্বে মূসা (আঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্মুখে তাঁর জনৈক গোপন ভক্ত যে কথা বলেছিলেন, তার কুরআনী বর্ণনার সাথে শব্দে শব্দে মিলে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَقَالَ رَجُلٌ مُّؤْمِنٌ مِّنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيْمَانَهُ أَتَقْتُلُوْنَ رَجُلاً أَنْ يَّقُوْلَ رَبِّيَ اللهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَّبِّكُمْ- (مؤمن ২৮)-
‘ফেরাঊন গোত্রের জনৈক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, লোকদের বলল, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে, যিনি বলেন, আমার পালনকর্তা আল্লাহ এবং তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ (গাফের/মুমিন ৪০/২৮)।
আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ঘটনা স্মরণ করে একদিন হযরত আলী (রাঃ) লোকদের বলেন, বল তো সবচেয়ে বড় বীর কে? তারা বলল, আপনি। তিনি বললেন, না। বরং আবুবকর। আমি দেখেছি কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কাপড় ধরে টানাটানি করছে ও গালি দিয়ে বলছে, তুমি আমাদেরকে বহু উপাস্য ছেড়ে এক উপাস্য গ্রহণ করতে বলে থাক’। সেই কঠিন সময়ে কেউ এগিয়ে যায়নি আবুবকর ছাড়া। তিনি একে ধরেন ওকে ঠেলেন, আর বলতে থাকেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক। তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে যিনি বলেন, আমার প্রতিপালক আল্লাহ? অতঃপর আলী (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। অতঃপর বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা বল ফেরাঊন কওমের ঈমান গোপনকারী মুমিন ব্যক্তি উত্তম না আবুবকর? লোকেরা চুপ থাকল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! ঐ সময়ের ঘটনায় আবুবকর উত্তম। কেননা ফেরাঊন কওমের মুমিন ঈমান গোপন করেছিল। কিন্তু আবুবকর তার ঈমান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন’।[5]
[2]. মুসলিম হা/১৭৯৪; বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০, ১/৪১৭ পৃঃ; মা শা-‘আ ৫০ পৃঃ।
[3]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৮১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[4]. বুখারী ফৎহসহ হা/২৪০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬৮৩৩।
[5]. মুসনাদে বাযযার হা/৭৬১। ইবনু হাজার এটিকে বুখারী হা/৩৮৫৬-এর ‘সমর্থক’ (شاهد) হিসাবে এনেছেন। হায়ছামী বলেন, এর সনদে একজন রাবী আছেন, যাকে আমি চিনি না (মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৪৩৩৩)।