এই সময় দাওয়াতের সারবস্ত্ত ছিল পাঁচটি। (১) তাওহীদ (২) রিসালাত (৩) আখেরাত বিশ্বাস (৪) তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর উপরে ভরসা এবং উক্ত বিশ্বাসসমূহের আলোকে (৫) তাযকিয়াহ বা আত্মশুদ্ধি অর্জন করা।
বস্ত্ততঃ রাসূল (ছাঃ)-এর সরাসরি নির্দেশনায় এই প্রশিক্ষণ পরিচালিত হ’ত। এভাবে তিনি আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান একদল নিবেদিতপ্রাণ মানুষ গড়ে তুলতে সমর্থ হন। যাঁদের হাতেই পরবর্তীকালে ইসলামের বস্ত্তগত বিজয় সাধিত হয়।
কয়েক বছর যাবৎ সীমিতভাবে দাওয়াত দেওয়ার পর এবার আল্লাহর হুকুম হ’ল বৃহত্তর পরিসরে প্রকাশ্য দাওয়াত দেওয়ার জন্য। নাযিল হ’ল,فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ- إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ ‘অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর’। ‘বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)। আরও নাযিল হ’ল, وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ‘তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক কর’ (শো‘আরা ২৬/২১৪)।
কিন্তু এতে কুরায়েশ নেতাদের প্রতিক্রিয়া যে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে, সে বিষয়ে আগেভাগেই স্বীয় নবীর মন-মানসিকতাকে প্রস্ত্তত করে নেন সূরা শো‘আরা নাযিল করে। ২২৭ আয়াত বিশিষ্ট এই বিরাট সূরার শুরুতেই আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন,لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ أَلاَّ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ، إِنْ نَشَأْ نُنَزِّلْ عَلَيْهِم مِّنَ السَّمَاء آيَةً فَظَلَّتْ أَعْنَاقُهُمْ لَهَا خَاضِعِينَ- (الشعراء ৩-৪) ‘লোকেরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করছে না দেখে তুমি হয়ত মর্মবেদনায় নিজেকে শেষ করে ফেলবে’। ‘আমরা চাইলে আকাশ থেকে তাদের উপরে এমন নিদর্শন (শাস্তি) নাযিল করতাম, যার সামনে তাদের গর্দান অবনত হয়ে যেত’ (শো‘আরা ২৬/৩-৪)। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, অহংকারী সমাজনেতাদের আচরণে বেদনাহত হয়ে তাওহীদের দাওয়াত থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না। বরং আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে বুকে বল নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এরপর আল্লাহ অতীতের সাতজন শ্রেষ্ঠ নবীর দাওয়াতী জীবন ও তাদের স্ব স্ব কওমের অবাধ্যাচরণ ও তাদের মন্দ পরিণতি সংক্ষেপে আবেগময় ভাষায় বর্ণনা করেছেন। যাতে আগামীতে বৃহত্তর দাওয়াতের রূঢ় প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে শেষনবীর কোনরূপ মনোকষ্ট না হয়। শুরুতেই হযরত মূসা (আঃ)-এর জীবনালেখ্য ১০-৬৮ আয়াত পর্যন্ত, অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) ৬৯-১০৪, তারপর নূহ (আঃ) ১০৫-১২২, অতঃপর হূদ (আঃ)-এর কওমে ‘আদ ১২৩-১২৪, তারপর হযরত ছালেহ (আঃ)-এর কওমে ছামূদ ১৪১-১৫৯, তারপর লূত্ব (আঃ)-এর কওম ১৬০-১৭৫, অতঃপর হযরত শু‘আয়েব (আঃ)-এর কওম আছহাবুল আইকাহ ১৭৬-১৯১ পর্যন্ত তাদের স্ব স্ব কওমের উপর আসমানী গযবসমূহ নাযিল হওয়ার ঘটনাবলী বর্ণনা করার পর সবশেষে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
فَلاَ تَدْعُ مَعَ اللهِ إِلَهاً آخَرَ فَتَكُوْنَ مِنَ الْمُعَذَّبِيْنَ- وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ- وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ- فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّيْ بَرِيءٌ مِّمَّا تَعْمَلُوْنَ- وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيْزِ الرَّحِيْمِ- (الشعراء ২১৩-২১৭)-
‘অতএব তুমি আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করো না। তাতে তুমি শাস্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। ‘তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক কর’। ‘এবং তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হও’। ‘অতঃপর যদি তারা তোমার অবাধ্যতা করে, তবে বলে দাও, তোমরা যা কর, তা থেকে আমি মুক্ত’। আর তুমি ভরসা কর মহাপরাক্রমশালী দয়ালু সত্তার উপরে’ (শো‘আরা ২৬/২১৩-১৭)।
উল্লেখ্য যে, কুরআনে বর্ণিত নবীগণের উপরোক্ত ক্রমধারায় আগপিছ রয়েছে। প্রকৃত ক্রমধারা হবে প্রথমে নূহ (আঃ), অতঃপর হূদ, অতঃপর ছালেহ, অতঃপর ইবরাহীম, লূত্ব, শু‘আয়েব ও মূসা (‘আলাইহিমুস সালাম)। কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে এরূপ আগপিছ হয়েছে। কেননা ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা করা নয়, বরং বিষয়বস্ত্ত পেশ করাই হ’ল কুরআনের মূল উদ্দেশ্য।