এ ব্যাপারে জানার জন্য কুরআনই বড় উৎস। সে বর্ণনা অনুযায়ী জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের জন্য মনগড়া উপাস্য সমূহ নির্ধারণ করেছিল (ইউনুস ১০/১৮)। তারা আল্লাহকে স্বীকার করত। সেই সাথে সুফারিশকারী হিসাবে অন্যদের উপাস্য মানত (আন‘আম ৬/১৯)। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী তারা মূর্তিগুলিকে তাদের পূজিত ব্যক্তিদের ‘রূহের অবতরণ স্থল সমূহ’ (مَنَازِلُ الْأَرْوَاحِ) বলে মনে করত। মূর্তিপূজা তাদের আক্বীদা ও সমাজ-সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছিল। যুগ পরম্পরায় তারা এই আক্বীদায় বিশ্বাসী ও রীতি-নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল (যুখরুফ ৪৩/২২)। তারা কা‘বা গৃহে মূর্তি স্থাপন করেছিল এবং হজ্জের অনুষ্ঠানসমূহে পরিবর্তন এনেছিল। তাওয়াফের জন্য ‘হারামের পোষাক’ (ثِيَابُ الْحَرَمِ) নামে তারা নতুন পোষাক পরিধানের রীতি চালু করেছিল। নইলে লোকদের নগ্ন হয়ে তাওয়াফ করতে হ’ত। কুরায়েশরা মূর্তিপূজা করত। সেই সাথে নিজেদেরকে ইবরাহীম (আঃ)-এর একান্ত অনুসারী হিসাবে ‘হানীফ’ (حَنِيْف) ‘একনিষ্ঠ একত্ববাদী’ বলত। এছাড়া তারা নিজেদেরকে ‘হুম্স’ (حُمْس), ‘ক্বাত্বীনুল্লাহ’ (قَطِيْنُ اللهِ) ‘আহ্লুল্লাহ’ (أَهْلُ اللهِ) এবং ‘আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা’ (أَهْلُ بَيْتِ اللهِ) বলে দাবী করত’।[1] সেকারণ তারা মুযদালিফায় হজ্জ করত, আরাফাতের ময়দানে নয়। কেননা মুযদালিফা ছিল হারামের অন্তর্ভুক্ত এবং আরাফাত ছিল হারাম এলাকার বাইরে। যেখানে বহিরাগত হাজীরা অবস্থান করত। ইসলাম আসার পর এই প্রথা নিষিদ্ধ করা হয় এবং সকলকে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে বলা হয় (বাক্বারাহ ২/১৯৯)।
তারা হজ্জের মাস সমূহে ওমরাহ করাকে ‘সবচাইতে নিকৃষ্ট কাজ’ (أَفْجَرُ الْفُجُوْر) বলে ধারণা করত। তারা কা‘বাগৃহে ইবাদতের সময় শিস দিত ও তালি বাজাতো (আনফাল ৮/৩৫)। তারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে পরিবর্তন এনেছিল (আ‘রাফ ৭/১৮০)। তারা জিনদেরকে আল্লাহর শরীক নির্ধারণ করেছিল (আন‘আম ৬/১০০) এবং ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলত (নাহল ১৬/৫৭)। তারা তাকদীরকে এবং কিয়ামতকে অস্বীকার করত (আন‘আম ৬/১৪৮; নাহল ১৬/৩৮)। তারা ইবাদত করত, কুরবানী করত বা মানত করত আখেরাতে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে নয়, বরং দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলের জন্য। তারা মৃত্যু ও অন্য বিপদাপদকে আল্লাহর দিকে নয় বরং প্রকৃতির দিকে সম্বন্ধ করত (জাছিয়াহ ৪৫/২৩)। তারা মূর্তির সম্মানে কুরবানী চালু করেছিল (মায়েদাহ ৫/৩)। লাত ও ‘উযযার নামে কসম করত এবং নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করত’ (বুখারী হা/৩৮৫০)।
আরবদের বিশ্বাস ছিল যে, প্রতি ১৩ দিন পর একটি নক্ষত্র পশ্চিমে অস্ত যায় এবং একই সাথে পূর্ব দিকে একটি নক্ষত্র উদিত হয়। তাদের বিশ্বাস মতে উক্ত নক্ষত্র অস্ত যাওয়ার সময় অবশ্যই বৃষ্টি হয় অথবা ঠান্ডা হাওয়া প্রবাহিত হয়। সেকারণ বৃষ্টি হ’লে তারা উক্ত নক্ষত্রের দিকে সম্বন্ধ করে বলত,مُطِرْنَا بِنَوْءٍ كَذَا ‘আমরা উক্ত নক্ষত্রের কারণে বৃষ্টি প্রাপ্ত হয়েছি’।[2] আল্লাহর হুকুমে যে বৃষ্টি হয় এটা তারা বিশ্বাস করত না। এভাবে তারা তাওহীদ বিশ্বাস থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছিল। অথচ এটাই ছিল তাদের পিতা ইবরাহীমের মূল দাওয়াত।
তাদের চরিত্রে ও রীতি-নীতিতে এমন বহু কিছু ছিল যা ইসলামকে ধসিয়ে দিত। যেমন বংশগৌরব করা ও অন্য বংশকে তাচ্ছিল্য করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَرْبَعٌ فِى أُمَّتِى مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَتْرُكُونَهُنَّ الْفَخْرُ فِى الأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِى الأَنْسَابِ وَالاِسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُوْمِ وَالنِّيَاحَةُ ‘আমার উম্মতের মধ্যে চারটি বস্ত্ত রয়েছে জাহেলিয়াতের অংশ, যা তারা ছাড়েনি। আভিজাত্য গৌরব, বংশের নামে তাচ্ছিল্য করা, নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা এবং শোক করা’।[3] জাহেলী যুগের অন্যতম রীতি ছিল, পিতা-মাতার কাজের উপর বড়াই করা, মাসজিদুল হারামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে গর্ব করা (তওবা ৯/১৯, ৫৫)। ধনশালী ব্যক্তিদের সম্মানিত মনে করা (যুখরুফ ৪৩/৩১) এবং দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীকে হীন মনে করা (আন‘আম ৬/৫২)। যেকোন কাজে শুভাশুভ নির্ধারণ করা ও ভাগ্য গণনা করা (জিন ৭২/৬) ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে অনেক জাহেলী কবির মধ্যে তাওহীদের আক্বীদা ছিল। যেমন মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি যুহায়ের বিন আবী সুলমা ও কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ প্রমুখ।[4] কা‘বাগৃহে হজ্জ জারী ছিল। হারামের মাসগুলির পবিত্রতা বজায় ছিল। অদৃষ্টবাদের আধিক্য থাকলেও তাদের মধ্যে ক্বাযা ও ক্বদরের আক্বীদা মওজুদ ছিল। ইবরাহীমী দ্বীনের শিক্ষা ও ইবাদতের কিছু নমুনা মক্কা ও তার আশপাশে জাগরুক ছিল। তাদের মধ্যে সততা, বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা, আতিথেয়তা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা প্রভৃতি অনন্য গুণাবলী অক্ষুণ্ণ ছিল।
[2]. মুসলিম হা/৭১; বুখারী হা/৮৪৬; মিশকাত হা/৪৫৯৬।
[3]. বুখারী, ফৎহসহ হা/৩৮৫০, ৭/১৫৬; মুসলিম হা/৯৩৪।
[4]. কবি যুহায়ের বলেন,
فَلاَ تَكْتُمُنَّ اللهَ مَا فِي نُفُوسِكُمْ + لِيَخْفَى وَمَهْمَا يُكْتَمِ اللهُ يَعْلَمِ
يُؤَخَّرْ فَيُوضَعْ فِي كِتَابٍ فَيُدَّخَرْ + لِيَوْمِ الحِسَابِ أَوْ يُعَجَّلْ فَيُنْقَمِ
‘অতএব (হে পরস্পরে সন্ধিকারী বনু ‘আবাস ও যুবিয়ান!) তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে তা আল্লাহ থেকে অবশ্যই গোপন করো না। কেননা যখনই তোমরা আল্লাহ থেকে গোপন করবে, তখনই তিনি তা জেনে যাবেন’। ‘অতঃপর তিনি সেটাকে পিছিয়ে দিবেন এবং আমলনামায় রেখে বিচার দিবসের জন্য জমা রাখবেন। অথবা দ্রুত করা হবে এবং প্রতিশোধ নেওয়া হবে’ (মু‘আল্লাক্বা যুহায়ের বিন আবী সুলমা ২৭ ও ২৮ লাইন)। কবি লাবীদ বলেন, أَلاَ كلُّ شَيْء مَا خَلا اللهَ بَاطِلُ + وَكُلُّ نَعِيْمٍ لاَ مُحَالَةَ زَائِلُ ‘মনে রেখ, আল্লাহ ব্যতীত সকল বস্ত্তই বাতিল’ এবং সকল নে‘মত অবশ্যই বিদূরিত হবে’। তবে লাইনের দ্বিতীয় অংশটি লাবীদের নয় বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন (দীওয়ানে লাবীদ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৫০০; প্রথমাংশটি বুখারী হা/৩৮৪১; মুসলিম হা/২২৫৬; মিশকাত হা/৪৭৮৬)।