পক্ষান্তরে তিনটি বিষয়ে ‘অল্প যয়ীফ’ হাদীস বলা বা আমল করা অনেকে অনুমোদন করেছেন: (১) কুরআনের ‘তাফসীর’ বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে, (২) ইতিহাস বা ঐতিহাসিক বর্ণনার ক্ষেত্রে এবং (৩) বিভিন্ন নেক আমলের ‘ফযীলত’-এর ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে তাঁরা নিম্নরূপ শর্তগুলো উল্লেখ করেছেন:
(১) যয়ীফ হাদীসটি ‘‘অল্প দুর্বল’ হবে, বেশি দুর্বল হবে না।
(২) যয়ীফ হাদীসটি এমন একটি কর্মের ফযীলত বর্ণনা করবে যা মূলত সহীহ হাদীসের আলোকে জায়েয ও ভালো।
(৩) যয়ীফ হাদীসকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা বলে বিশ্বাস করা যাবে না। এবং কোনোভাবেই তা আকীদা বা বিশ্বাসের জগতে প্রবেশ করবে না। যয়ীফ হাদীসের উপর আমল করার ক্ষেত্রে একথা মনে করা যাবে না যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ সত্যিই একথা বলেছেন। সাবধানতামূলকভাবে আমল করতে হবে। অর্থাৎ মনে করতে হবে, হাদীসটি নবীজী ﷺ -এর কথা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, তবে যদি সত্য হয় তাহলে এ সাওয়াবটা পাওয়া যাবে, কাজেই আমল করে রাখি। আর সত্য না হলেও মূল কাজটি যেহেতু সহীহ হাদীসের আলোকে মুস্তাহাব সেহেতু কিছু সাওয়াব তো পাওয়া যাবে।
(৪) এরূপ দুর্বল হাদীস নির্ভর কোনো আমল প্রকাশ্যে করা যাবে না; বরং একান্ত ব্যক্তিগতভাবে তা পালন করতে হবে।[1]
আল্লামা ইবন হাজার আসকালানী বলেন:
اشتهر أن أهل العلم يتسامحون في إيراد الأحاديث في الفضائل وإن كان فيها ضعف، ما لم تكن موضوعة. وينبغي مع ذلك اشتراط أن يعتقد العامل كون ذلك الحديث ضعيفا، وأن لا يشهر بذلك، لئلا يعمل المرء بحديث ضعيف، فيشرع ما ليس بشرع، أو يراه بعض الجهال فيظن أنه سنة صحيحة. وقد صرح بمعنى ذلك الأستاذ أبو محمد بن عبد السلام وغيره. وليحذر المرء من دخوله تحت قوله صلى الله عليه وسلم: "من حدث عني بحديث يرى أنه كذب فهو أحد الكذابين". فكيف بمن عمل به. ولا فرق في العمل بالحديث في الأحكام، أو في الفضائل، إذ الكل شرع.
‘‘এ কথা প্রসিদ্ধ যে, ফাযায়িল বিষয়ে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আলিমগণ কিছুটা ঢিলেমি দেখান। এ বিষয়ক হাদীসটি যদি জাল না হয় তবে তাতে দুর্বলতা থাকলেও আলিমগণ তা বর্ণনা করেন। এর সাথে নিম্নের বিষয় শর্ত করা প্রয়োজন। তা হলো: যদি কেউ এরূপ হাদীস পালন করতে চায় তবে তাকে বিশ্বাস ও আকীদা পোষণ করতে হবে যে, হাদীসটিকে যয়ীফ। এছাড়া সে এরূপ দুর্বল হাদীস নির্ভর আমল প্রকাশ্যে করতে পারবে না। কারণ একজন মানুষ দুর্বল হাদীসের উপর আমল করে শরীয়তের মধ্যে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না যা মূলত শরীয়তের অংশ নয়। অথবা তার দুর্বল হাদীস নির্ভর আমলটি দেখে একজন মুর্খ মানুষ ধারণা করতে পারে যে, একটি একটি সহীহ সুন্নাত। (সপ্তম শতকের মুজাদ্দিদ ও সুলতানুল উলামা নামে খ্যাত) উসতায (ইয্যুদ্দীন আব্দুল আযীয) ইবন আব্দুস সালাম (৬৬০ হি) এবং অন্যান্য আলিম এ অর্থে সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসে ঘোষিত শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আত্মরক্ষা করা মুমিনের দায়িত্ব। তিনি বলেছেন: ‘‘যে হাদীসটির বিষয়ে ধারণা হয় যে তা মিথ্যা সে হাদীস যে বর্ণনা করে সেও একজন মিথ্যাবাদী।’’ এরূপ (সন্দেহভাজন বা দুর্বল) হাদীস বর্ণনা করার পরিণতি যদি এরূপ হয় তাহলে তার পালন বা আমল করার পরিণতি কী হতে পারে? আর কোনো হাদীস আমল বা পালন করার ক্ষেত্রে হালাল-হারাম এবং ফযীলত-সাওয়াব উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ হালাল-হারাম ও ফযীলত-সাওয়াব সবই শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত।’’[2]
‘যয়ীফ’ হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের এ মতটি ভুল বুঝে অনেক সময় এর মাধ্যমে সমাজে ‘জাল’ হাদীসের প্রচলন ঘটেছে। বস্ত্তত, বিভিন্ন মুসলিম সমাজে প্রচলিত অধিকাংশ জাল ও ভিত্তিহীন ‘হাদীস’ এ ‘পথ’ দিয়ে মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে। সমাজে অগণিত জাল হাদীসের প্রচলনের পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে: (১) অযোগ্য ও ইলমহীন মানুষদের ওয়ায, নসীহত ও বিভিন্ন দীনী দায়িত্ব পালন, (২) সাধারণ আলিমদের অবহেলা বা অলসতা, (৩) প্রসিদ্ধ ও যোগ্য আলিমদের ঢিলেমী, (৪) হেদায়েতের আগ্রহ এবং (৫) ইতিহাস, সীরাত ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুজিযা বর্ণনার আগ্রহ।
[2] ইবন হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রাজাব, পৃ. ২।