বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত হাদীসকে হাদীসের নামে কথিত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল বা মিথ্যা থেকে পৃথক করার জন্য মুহাদ্দিসগণের দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছিল সনদে উল্লিখিত সকল ‘রাবী’-র ব্যক্তিগত তথ্যাদি সংগ্রহ করা এবং তাদের ব্যক্তিগত সততা, সত্যপরায়ণতা ও ধার্মিকতা (عدالة) সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এ বিষয়ে তাঁরা নিজেরা ‘রাবী’র কর্ম পর্যবেক্ষণ করতেন এবং প্রয়োজনে সমকালীন আলিম, মুহাদ্দিস ও শিক্ষার্থীদেরকে প্রশ্ন করতেন।
১ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী আবুল আলিয়া রুফাই’ ইবনু মিহরান (৯০ হি) বলেন: কোনো স্থানে কোনো ব্যক্তি হাদীস বলেন বা শিক্ষাদান করেন জানলে আমি হাদীস সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তার কাছে গমন করতাম। সেখানে যেয়ে আমি তার সালাত পর্যবেক্ষণ করতাম। যদি দেখতাম, তিনি সুন্দর ও পূর্ণরূপে সালাত প্রতিষ্ঠা করছেন তবে আমি তার কাছে অবস্থান করতাম এবং তার কাছ থেকে হাদীস লিখতাম। আর যদি তার সালাতের বিষয়ে অবহেলা দেখতাম তাহলে আমি তার কাছে থেকে হাদীস শিক্ষা না করেই ফিরে আসতাম। আমি বলতাম: যে সালাতে অবহেলা করতে পারে সে অন্য বিষয়ে বেশি অবহেলা করবে।[1]
তাঁরা শুধু হাদীস বর্ণনাকারীর বাহ্যিক কর্মই দেখতেন না, তার আচরণ, আখলাক, সততা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদিও জানার চেষ্টা করতেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ তাবিয়ী আসিম ইবনু সুলাইমান আল-আহওয়াল (১৪০ হি) বলেন, আমি আবুল আলিয়া (৯০ হি)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা (দ্বিতীয় শতকের তাবিয়ীগণ) তোমাদের পূর্ববর্তীদের চেয়ে সালাত- সিয়াম বেশি পালন কর বটে, কিন্তু মিথ্যা তোমাদের জিহবায় প্রবাহিত হয়ে গিয়েছে।[2]
এছাড়া উক্ত রাবীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে এবং তার পান্ডুলিপির সাথে মুখের বর্ণনা মিলিয়ে তাঁর সততা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। নিজেদের পর্যবেক্ষণের পাশাপশি মূলত সমকালীন আলিমদের মতামতের মাধ্যমে তারা রাবীর সততা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করতেন। ইয়াহইয়া ইবনু মুগীরাহ (২৫৩ হি) বলেন: আমি প্রখ্যাত তাবি-তাবিয়ী জারীর ইবনু আব্দুল হামীদ (১৮৮ হি)-কে তার ভাই আনাস ইবনু আব্দুল হামীদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন: তার হাদীস লিখবে না; কারণ সে মানুষের সাথে কথাবার্তায় মিথ্যা বলে। সে হিশাম ইবনু উরওয়াহ, উবাইদুল্লাহ ইবনু উমার প্রমুখ মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শিখেছে। কিন্তু যেহেতু মানুষের সাথে কথাবার্তায় তার মিথ্যা বলার অভ্যাস আছে সেহেতু তার হাদীস গ্রহণ করবে না।[3]
তবে সর্বাবস্থায় তাঁদের মূল সিদ্ধান্তের ভিত্তি হতো ব্যক্তির প্রদত্ত তথ্যের তুলনামূলক নিরীক্ষা। এজন্য অগণিত ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, একজন মুহাদ্দিস কোনো একজন রাবী সম্পর্কে অনেক প্রশংসা শুনে প্রবল ভক্তি ও আগ্রহ সহকারে তার কাছে হাদীস শিখতে গিয়েছেন। কিন্তু যখনই তার বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা ও ভুল দেখতে পেয়েছেন তখনই সে ব্যক্তির বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত পাল্টে গিয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুহার্রির আল-জাযারী ২য় শতকের একজন আলিম ও বুযুর্গ ছিলেন। খলীফা মনসূরের শাসনামলে (১৩৬-১৫৮ হি) তিনি বিচারকের দায়িত্বও পালন করেন। তবে তিনি হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। তিনি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলতেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১৮১হি) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুহার্রিরের নেক আমল, বুজুর্গী ও প্রসিদ্ধির কথা শুনে আমার মনে তার প্রতি এত প্রবল ভক্তি জন্মেছিল যে, আমাকে যদি ইখতিয়ার দেয়া হতো যে, তুমি জান্নাতে যাবে অথবা আব্দুল্লাহ ইবনুল মুহাররিরের সাথে সাক্ষাত করবে, তাহলে আমি তার সাথে সাক্ষাতের পরে জান্নাতে যেতে চেতাম। কিন্তু যখন আমি তার সাথে সাক্ষাত করলাম তখন তার বর্ণিত হাদীসের মধ্যে মিথ্যার ছড়াছড়ি দেখে আমার মনের সব ভক্তি উবে গেল। ছাগলের শুকনো লাদিও আমার কাছে তার চেয়ে বেশি প্রিয়।[4]
[2] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/১৩৩।
[3] ইবনু আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ২/২৮৯।
[4] ইবনু আদী, আল-কামিল ৪/১৩২; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৪/১৯৩।