উপর্যুক্ত রোযা নষ্টকারী (মাসিক ও নিফাসের খুন ব্যতীত) সকল জিনিস কেবল তখনই রোযা নষ্ট করবে, যখন তার সাথে ৩টি শর্ত অবশ্যই পাওয়া যাবে। আর সে শর্ত ৩টি নিম্নরূপঃ-
- রোযাদার জানবে যে, এই জিনিস এই সময়ে ব্যবহার করলে তার রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ, তা ব্যবহার করার সময় তার এ কথা অজানা থাকলে চলবে না যে, এই জিনিস রোযা নষ্ট করে অথবা এখন রোযার সময়।
- তা যেন মনে স্মরণ রাখার সাথে ব্যবহার করে; ভুলে গিয়ে নয়।
- তা যেন নিজস্ব ইচ্ছা ও এখতিয়ারে ব্যবহার করে; অপরের তরফ থেকে বাধ্য হয়ে নয়।
কেননা, মহান আল্লাহ বলেন,
(وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيْمَا أَخْطَأْتُمْ بِهِ، وَلَكِنْ مَّا تَعَمَّدَتْ قُلُوْبُكُمْ)
অর্থাৎ, কোন ব্যাপারে তোমরা ভুল করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই; কিন্তু ইচ্ছাকৃত করলে অপরাধ আছে। (কুরআনুল কারীম ৩৩/৫)
তিনি আরো বলেন,
(رَبَّنَا لاَ تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَّسِيْنَا أَوْ أَخْطَأْنَا)
অর্থাৎ, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা যদি ভুল ও ত্রুটি করে ফেলি, তাহলে তুমি আমাদেরকে অপরাধী করো না। (কুরআনুল কারীম ২/২৮৬) তিনি অন্যত্র বলেন,
(إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالإيْمَانِ)
অর্থাৎ, (কেউ ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং কুফরীর জন্য হৃদয় মুক্ত রাখলে তার উপর আল্লাহর ক্রোধ পতিত হবে। আর তার জন্য আছে মহাশাস্তি। তবে তার জন্য নয়, যাকে (কুফরী করতে) বাধ্য করা হয়; কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অটল থাকে। (কুরআনুল কারীম ১৬/১০৬)
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ আমার জন্য আমার উম্মতের ভুল-ত্রুটি এবং বাধ্য হয়ে কৃত পাপকে মার্জনা করে দিয়েছেন।’’[1]
আর এই ভিত্তিতে একাধিক মাসায়েল প্রমাণিত হয়ঃ
- যদি কোন (নও-মুসলিম) স্বামী-স্ত্রী রোযা রেখে সঙ্গম করলে রোযা নষ্ট হয় -এ কথা না জেনে সঙ্গম করে ফেলে, অথবা ফজর উদয় হয়ে যাওয়ার সময় না জানতে পেরে (সময় বাকী আছে মনে করে) ভুল করে সঙ্গম করে ফেলে, তাহলে তাদের উপর কাযা-কাফ্ফারা কিছুই ওয়াজেব নয়।
- স্বামী যদি মিলনের জন্য স্ত্রীকে জোর করে এবং স্ত্রী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা সত্ত্বেও বাধা দিতে পারঙ্গম না হয়ে সঙ্গম হয়েই যায়, তাহলে স্ত্রীর রোযা শুদ্ধ। কারণ, ঐ মিলনে তার ইচ্ছা ছিল না।
- রোযা রেখে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় স্বপ্নে কেউ সঙ্গম করলে এবং তার ফলে সত্যসত্যই (স্বপ্নদোষ ও) বীর্যপাত হয়ে গেলে তার রোযা নষ্ট হবে না। কেননা, ঘুমন্ত ব্যক্তির স্বপ্নে কোন ইচ্ছা থাকে না। বরং তার উপর থেকে ফিরিশ্তার নেকী-বদী লেখার কলমও তুলে নেওয়া হয়।
- রোযাদার ভুলে কিছু খেয়ে অথবা পান করে নিলে রোযা নষ্ট হবে না। কারণ, রোযার কথা সে ভুলে গিয়েছিল। আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে রোযাদার ভুলে গিয়ে পানাহার করে ফেলে, সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে নেয়। এ পানাহার তাকে আল্লাহই করিয়েছেন।’’[2] অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘যে ব্যক্তি রমাযান মাসে ভুলবশতঃ রোযা নষ্টকারী কোন কাজ করে ফেলে, তার উপর কাযা ও কাফ্ফারা কিছুই নেই।’’[3]
- যদি কেউ এই মনে করে খায় অথবা পান করে যে, সূর্য ডুবে গেছে অথবা এখনো ফজর উদয় হয় নি, তাহলে তার রোযা নষ্ট হবে না। যেহেতু সে না জেনে খেয়েছে।
- যদি ওযূ বা গোসল করতে গিয়ে অথবা সাঁতার কাটতে গিয়ে পেটে পানি চলে যায়, কিংবা নলে পানি, পেট্রোল অথবা অন্য কোন তরল পদার্থ মুখে করে টানতে গিয়ে গলার নিচে নেমে যায়, তাহলে তাতেও রোযা নষ্ট হবে না। কারণ, এ সবে রোযাদারের ইচ্ছা থাকে না।
- ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় যদি কারো মুখে খাবার (যেমন পান ইত্যাদি) থেকে যায়, অতঃপর সেই অবস্থায় ফজর হয়ে যায়, তাহলে জাগার সাথে সাথে তা উগলে ফেলে দিয়ে কুল্লি করে নিলে তার রোযা হয়ে যাবে। কেননা, সে ঘুমিয়ে ছিল এবং ফজর হওয়ার পর সে ইচ্ছাকৃত সে খাবার গিলে খায়নি।
- কেউ জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলে তার মুখে পানি দিয়ে যদি তার জ্ঞান ফিরে যায়, তাহলে তার রোযা শুদ্ধ। কারণ, ঐ পানি সে নিজের ইচ্ছায় খায় নি।[4]
এখানে একটি সতর্কতার বিষয় এই যে, যদি কেউ কোন রোযাদারকে না জেনে বা ভুলে খেতে অথবা পান করতে প্রত্যক্ষ করে, তাহলে তাকে রোযার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরী। যেহেতু মহান আল্লাহর ব্যাপক নির্দেশ হল,
(وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى)
অর্থাৎ, তোমরা সৎকার্য ও আল্লাহভীতির ব্যাপারে একে অপরকে সাহায্য কর। (কুরআনুল কারীম ৫/২)
আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর ব্যাপক নির্দেশ হল, ‘‘আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিও।’’[5]
তাছাড়া আসলে এটি একটি আপত্তিকর কর্ম। অতএব তা প্রতিহত করা ওয়াজেব।[6]
- বমি সামলাতে না পারলে রোযার কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, তা রোযাদারের এখতিয়ারের বাইরে। আর তার দলীল হল উল্লেখিত স্পষ্ট হাদীস। এ ক্ষেত্রে মুখ ভর্তি হওয়া বা না হওয়ার কোন শর্ত কার্যকর নয়।
[2] (বুখারী ১৯৩৩, মুসলিম ১১৫৫, আবূ দাঊদ ২৩৯৮, তিরমিযী, দারেমী, ইবনে মাজাহ ১৬৭৩, দারাকুত্বনী, সুনান, বাইহাকী ৪/২২৯, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৯৫, ৪২৫, ৪৯১, ৫১৩)
[3] (ইবনে হিববান, সহীহ মাওয়ারিদ ৯০৬নং, হাকেম, মুস্তাদ্রাক ১/৪৩০, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৪/৮৭)
[4] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪০১)
[5] (বুখারী ৪০১, মুসলিম ৫৭২, আবূ দাঊদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)
[6] (ইবনে উষাইমীন ফাসিঃ মুসনিদ ৪৬পৃঃ, সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম ৪৪নং)