ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে রোযাদার ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। আর সন্দেহের উপর পানাহার বন্ধ করবে না। যেহেতু মহান আল্লাহ পানাহার বন্ধ করার শেষ সময় নির্ধারিত করেছেন নিশ্চিত ও স্পষ্ট ফজরকে; সন্দিগ্ধ ও অস্পষ্ট ফজরকে নয়। তিনি বলেছেন,
(وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ)
অর্থাৎ, আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)
এক ব্যক্তি ইবনে আববাস (রাঃ)-কে বলল, ‘আমি সেহরী খেতে থাকি। অতঃপর যখন (ফজর হওয়ার) সন্দেহ হয়, তখন (পানাহার) বন্ধ করি।’ তিনি বললেন, ‘যতক্ষণ সন্দেহ থাকে ততক্ষণ খেতে থাক, সন্দেহ দূর হয়ে গেলে খাওয়া বন্ধ কর।’[1]
ইমাম আহমাদ (রঃ) বলেন, ‘ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না নিশ্চিত হওয়া গেছে ততক্ষণ রোযাদার পানাহার করতে পারবে।’[2]
যদি কোন ব্যক্তি ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ রেখে খায়, অথবা ফজর উদয় হয়নি মনে করে খায়, অতঃপর জানতে পারে যে, খাওয়ার আগেই ফজর উদয় হয়ে গেছে, অথবা ফজরের আযান হয়ে গেছে, তাহলে তার রোযা শুদ্ধ এবং তাকে ঐ রোযা কাযা করতে হবে না। যদিও সে আসলে ফজরের পর খেয়েছে। কারণ, সে না জেনে খেয়েছে। আর না জেনে খাওয়া ক্ষমার্হ। অর্থাৎ তা ধর্তব্য নয়।[3] পক্ষান্তরে যদি কেউ ঘুম থেকে জেগে উঠে জানতে পারে যে, ফজর বা ফজরের আযান হয়ে গেছে এবং তা সত্ত্বে পানি বা অন্য কিছু খায়, তাহলে তার রোযা হবে না। তাকে ঐ দিন পানাহার ইত্যাদি রোযার মতই বন্ধ রেখে রমাযান পর কাযা রাখতে হবে।
জ্ঞাতব্য যে, সেহরীর শেষ সময় হল পূর্ব আকাশে ছড়িয়ে পড়া সাদা আলোক রেখার উদ্ভব কাল। সামুরাহ বিন জুনদুব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘বিলালের আযান এবং (পূর্বাকাশে) আলম্বিত শুভ্র জ্যোতি যেন তোমাদেরকে সেহরী খাওয়াতে বাধা না দেয়। অবশ্য পূর্বাকাশে ছড়িয়ে পড়া জ্যোতি দেখে খাওয়া বন্ধ করো।’’[4]
বলা বাহুল্য, ছড়িয়ে পড়া উক্ত সাদা রেখা পরিদৃষ্ট হলে সাথে সাথে রোযাদারের জন্য পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত হওয়া ওয়াজেব। তাতে সে ফজরের আযান শুনুক, অথবা না শুনুক। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে।’’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)
আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘ইবনে উম্মে মাকতূমের আযান না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা পানাহার কর। কারণ, সে ফজর উদয় না হলে আযান দেয় না।’’[5]
লক্ষণীয় যে, ফজর উদয় হয়েছে কি না, তা-ই দেখার বিষয়; আযান হয়েছে কি না, তা নয়। অতএব মুআযযিন যদি নির্ভরযোগ্য হয় এবং জানা যায় যে, সে ফজর উদয় না হলে আযান দেয় না অথবা ফজর উদয় হওয়ার পরে দেরী করে আযান দেয় না, তাহলে তার আযান শোনামাত্র পানাহার থেকে বিরত হওয়া ওয়াজেব। পক্ষান্তরে মুআযযিন যদি (ফজর উদয়ের) সময় হওয়ার পূর্বেই আযান দেয়, তাহলে তার আযান শুনে পানাহার বন্ধ করা ওয়াজেব নয়। তদনরূপ মুআযযিন যদি ঢিলে হয় এবং যথাসময় থেকে দেরী করে আযান দেয়, তাহলে সময় শেষ জানা সত্ত্বেও আযান হয়নি বলে খেয়ে যাওয়া বৈধ নয়। কারণ, এতে রোযা হবে না।
কিন্তু মুআযযেনের অবস্থা না জানা গেলে, অথবা একই শহরে একাধিক মসজিদের একাধিক মুআযযেনের বিভিন্ন সময়ে আযান হলে এবং শহরের ভিতরে ঘর-বাড়ি তথা লাইটের ফলে ফজর উদয় হওয়ার সময় নিজে নির্ধারণ না করতে পারলে নির্ভরযোগ্য সেই ইসলামী পঞ্জিকা অনুযায়ী আমল করা জরুরী, যাতে নিখুঁতভাবে ফজর উদয়ের স্থানীয় সময় ঘ¦টা-মিনিট সহ স্পষ্ট লিখা থাকে। অতঃপর নিজের ঘড়ি ঠিক রেখে সেই সময় অনুযায়ী সেহরী-ইফতার করলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সেই হাদীসের উপর আমল হবে, যাতে তিনি বলেন, ‘‘যে বিষয়ে সন্দেহ আছে সে বিষয় বর্জন করে তাই কর যাতে সন্দেহ নেই।’’[6] ‘‘সুতরাং যে সন্দিহান বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকবে, সে তার দ্বীন ও ইজ্জতকে বাঁচিয়ে নেবে।’’[7]
জ্ঞাতব্য যে, ফজর উদয় হওয়ার ৫/১০ মিনিট আগে সতর্কতামূলকভাবে পানাহার থেকে বিরত হওয়া একটি বিদআত। কোন কোন পঞ্জিকা (বা রমাযান-সওগাতে) যে একটি ঘর সেহরীর শেষ সময়ের এবং পৃথক আর একটি ঘর ফজরের আযানের লক্ষ্য করা যায়, তা আসলে শরীয়ত-বিরোধী কাজ।[8] কারণ, সেহরীর শেষ সময় যেটাই, সেটাই ফজরের আযানের সময়। আর ফজরের আযানের সময়ের আগে লোকেদের পানাহার বন্ধ করা অবশ্যই শরীয়ত-বিরোধী কাজ।
বলা বাহুল্য, (বিশেষ করে) রমাযান মাসে মুআযযিন-ইমামদের উচিৎ, যথাসময়ে আযান দেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রাখা। রাইট-টাইমের ঘড়ি দ্বারা ফজর উদয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আযান দেওয়া মোটেই উচিৎ নয়। যাতে তাঁরা লোকেদেরকে ধোকা দিয়ে এমন সময় আযান না দিয়ে বসেন, যে সময়ে তাদের জন্য আল্লাহর হালালকৃত খাদ্য তাদের জন্য হারাম করে দেন এবং সময় হওয়ার পূর্বেই ফজরের নামায হালাল করে বসেন। আর এ যে কত বড় বিপজ্জনক, তা অনুমেয়।[9]
আবূ হুরাইরা কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যখন তোমাদের কেউ আযান শোনে এবং সেই সময় তার হাতে (পানির) পাত্র থাকে, তখন সে যেন তা থেকে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ না করা পর্যন্ত রেখে না দেয়।’’[10]
অনেক উলামা উক্ত হাদীসটিকে এ কথার দলীল মনে করেন যে, যে ব্যক্তির হাতে খাবারের পাত্র (নিয়ে খেতে) থাকা অবস্থায় ফজর (বা তার আযান) হয়ে যায়, তার জন্য তা থেকে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ না করা পর্যন্ত রেখে দেওয়া (খাওয়া বন্ধ করা) বৈধ নয়। সুতরাং এ ব্যাপারটি আয়াতের সাধারণ নির্দেশ থেকে স্বতন্ত্র। মহান আল্লাহ বলেন,
(وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ)
‘‘আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে।’’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)
অতএব উক্ত আয়াত তথা অনুরূপ অর্থের সকল হাদীস উপর্যুক্ত হাদীসের বিরোধী নয়। তাছাড়া ইজমার প্রতিকূলও নয়। বরং সাহাবাদের একটি জামাআত এবং আরো অন্যান্যগণ উক্ত হাদীস অপেক্ষা আরো প্রশস্ততা রেখে মনে করেন যে, ফজর উজ্জ্বল হয়ে গেলে এবং ভোরের শুভ্র আলো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়লেও সে পর্যন্ত পানাহার করা বৈধ।[11]
অনেকে মনে করেন, উক্ত হাদীসে ‘আযান’ বলতে বিলালের আযানকে বুঝানো হয়েছে; যা প্রথম (সেহরী বা তাহাজ্জুদের) আযান এবং যা ফজরের আগে দেওয়া হত। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘বিলাল রাতে আযান দেয়। সুতরাং তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করতে থাক, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইবনে উম্মে মাকতূম আযান দেয়।’’[12]
অথবা উক্ত হাদীসের অর্থ এই যে, আযান শুনেও যদি ফজর উদয়ে সন্দেহ হয়, যেমন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার ফলে অন্ধকার থাকে, তাহলে সে সময় কেবল আযানে ফজর হওয়ার কথা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। কারণ, ফজর জানার যে মাধ্যম তা (ফজরের জ্যোতি) নেই। আর মুআযযিন তা দেখে ফজর উদয়ের কথা জানতে পারলে সেও জানতে পারত। পক্ষান্তরে ফজর উদয় হওয়ার কথা এমনিই বুঝতে পারা গেলে মুআযযেনের আযান শোনার প্রয়োজন নেই। কারণ, সে তো (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হলেই পানাহার থেকে বিরত থাকতে আদিষ্ট। এ কথা বলেছেন খাত্ত্বাবী।
বাইহাক্বী বলেন, ‘উক্ত হাদীস সহীহ হলে অধিকাংশ উলামার নিকট তার ব্যাখ্যা এই যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জেনেছিলেন, মুআযযিন ফজর হওয়ার আগে আযান দেয়। সুতরাং তখন সে পান করলে ফজর উদয়ের আগেই পান করা হবে।’[13]
আলী আল-ক্বারী বলেন, ‘উক্ত নির্দেশ তখন প্রযোজ্য, যখন ফজর উদয়ে সন্দেহ হয়।’ ইবনুল মালেক বলেন, ‘উক্ত নির্দেশ তখন প্রযোজ্য, যখন জানতে পারবে না যে, ফজর উদয় হয়ে গেছে। নচেৎ, যখন ফজর উদয় হওয়ার কথা জানতে পারবে এবং তাতে সন্দেহ করবে তখন নয়।’[14] এ ছাড়া আরো অন্য ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহই ভালো জানেন।
বলা বাহুল্য, শেষোক্ত উলামাদের মতানুসারে যখন কোন রোযাদার মুখে কোন খাদ্য বা পানীয় থাকা অবস্থায় ফজরের আযান শুনবে, তখনই সে তা মুখ থেকে উগলে ফেলে দেবে। আর এতে তার রোযা শুদ্ধ হয়ে যাবে।[15]
প্রকাশ থাকে যে, সেহরী খাওয়ার পর মুআযযিনের আযানের অপেক্ষা করে তার ‘আল্লা--’ বলার সাথে সাথে তৈরী রাখা পানি শেষ বারের মত পান করা বৈধ নয়। কারণ, আযান হয় ফজর উদয় হওয়ার সাথে সাথে এবং এ কথা জানাবার উদ্দেশ্যে যে সেহরীর সময় শেষ। অতএব খাবার সময় নেই জানার পরেও খাওয়া শরীয়তের বিরোধিতা তথা রোযা নষ্ট করার কাজ।[16]
পূর্বের আলোচনায় আমরা জানতে পেরেছি যে, ফজরের আগে একটি আযান আছে, যা তাহাজ্জুদ ও সেহরীর সময় জানাবার জন্য ব্যবহার করা হত মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে। অতএব সেহরীর সময় লোকেদেরকে জাগানোর জন্য সেই আযানের বদলে কুরআন বা গজল পড়া, বেল বা ঘ¦টা বাজানো, অথবা তোপ দাগা বিদআত।[17]
[2] (ফিকহুস সুন্নাহ ১/৪০৪)
[3] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪০৯-৪১১)
[4] (আহমাদ, মুসলিম, আবূ দাঊদ ২৩৪৬, তিরমিযী, ইবনে আবী শাইবাহঃ, দারাকুত্বনী, বাইহাকী, ইরওয়াউল গালীল ৯১৫নং)
[5] (বুখারী ১৯১৮, মুসলিম ১০৯২নং)
[6] (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী ২৫১৮, নাসাঈ, ইবনে হিববান, সহীহ, ত্বাবারানী, মু’জাম প্রমুখ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২০৭৪, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৩৭৭, ৩৩৭৮নং)
[7] (আহমাদ, মুসনাদ ৪/২৬৯, ২৭০, বুখারী ৫২, মুসলিম ১৫৯৯নং, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দাঃ)
[8] (দ্রঃ তামামুল মিন্নাহ, আল্লামা আলবানী ৪১৮পৃঃ, সামানিয়া ওয়া আরবাঊন সুআলান ফিস্-সিয়াম ৪৮পৃঃ)
[9] (ইবনে উষাইমীন ফাসিঃ মুসনিদ ৩৬পৃঃ)
[10] (আহমাদ, মুসনাদ ২/৪৩২, ৫১০, আবূ দাঊদ ২৩৫০, দারাকুত্বনী, সুনান ২১৬২, হাকেম, মুস্তাদ্রাক ১/২০৩, বাইহাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৩৯৪নং)
[11] (দ্রঃ ফাতহুল বারী ৪/১৬২-১৬৩, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৩/৩৮২-৩৮৪, তামামুল মিন্নাহ, আল্লামা আলবানী ৪১৭-৪১৮পৃঃ)
[12] (বুখারী ৬১৭নং, মুসলিম)
[13] (বাইহাকী ৪/২১৮)
[14] (আউনুল মাবুদ ৬/৩৪১-৩৪২)
[15] (সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম ৬১নং)
[16] (তাওজীহাতুন অফাওয়াএদ লিসসা-য়েমীনা অসসায়েমাত ৪০পৃঃ দ্রঃ)
[17] (মু’জামুল বিদা’ ২৬৮পৃঃ)