হে প্রিয় ভাই! আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে ও আপনাকে সঠিক কথা জানার এবং তার অনুসরণ করার তাওফীক দিন। জেনে রাখুন! কা’ব বিন মালেক (রাঃ) এর ঘটনা থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জানা যায়-
মুসলমানের গীবত করা হলে গীবতকারীর প্রতিবাদ করা মুস্তাহাব। যেমন করেছিলেন মুআয বিন জাবাল (রাঃ)
পরিস্থিতি যতই জটিল হোক, সদা সত্য বলা জরুরী। কেননা এর পরিণতি ভাল হয়।
সফর হতে আগমণ করে সর্বপ্রথম মসজিদে গিয়ে দুই রাকআত সলাত পড়া মুস্তাহাব।
সফর থেকে ফেরত এসে প্রয়োজন বশতঃ মানুষের সাথে মুলাকাত করার জন্য খোলা জায়গায় বসা মুস্তাহাব। চাই সে জায়গা মসজিদ হোক বা অন্য কোন জায়গা।
মানুষের বাহ্যিক অবস্থার প্রতি খেয়াল করেই দুনিয়ার হুকুম-আহকাম প্রয়োগ করা হবে। অন্তরের অবস্থা আল্লাহর উপর সোপর্দ করে দিতে হবে।
প্রকাশ্যে পাপ কাজে লিপ্ত এবং বিদআতীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সালাম-কালাম বন্ধ করে দেয়া জায়েয আছে। যাতে এর মাধ্যমে তাদেরকে তিরস্কার করা যায় এবং অন্যদের জন্য শিক্ষণীয় হয়।
কোন গুনাহ্-এর কাজ হয়ে গেলে অনুতপ্ত হয়ে ক্রন্দন করা শুধু মুস্তাহাবই নয়; বরং ক্রন্দন করাই উচিৎ।
যেই কাগজে ও পত্রে আল্লাহর যিকির ও নাম লিখা আছে, বিশেষ স্বার্থে তা আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলা জায়েয আছে। যেমনটি করেছিলেন কা’ব বিন মালেক (রাঃ)
তালাকে কিনায়া তথা নিয়ত ব্যতীত ইঙ্গিত সূচক শব্দে তালাক কার্যকর হয়না। যেমন কেউ তার স্ত্রীকে বলল- তোমার পরিবারের সাথে মিলিত হয়ে যাও। এ ধরণের বাক্য ব্যবহারের সময় তালাকের নিয়ত না করলে তালাক কার্যকর হবেনা।
মহিলার জন্য তার স্বামীর খেদমত করা বৈধ। তবে এটি ওয়াজিব ও আবশ্যক নয়।
কোন নিয়ামাত অর্জিত হলে সিজদায়ে শুকরিয়া আদায় করা মুস্তাহাব। এমনি কোন প্রকাশ্য কোন বালা-মসীবত দূর হয়ে গেলেও সিজদায়ে শুকরিয়া আদায় করা এবং দান-খয়রাত করা মুস্তাহাব।
কাউকে সুখবর দেয়া এবং মোবারকবাদ জানানো মুস্তাহাব। এমনি সুসংবাদ দানকারীকে কাপড় বা অন্য কিছু দিয়ে সম্মান করাও মুস্তাহাব।
সম্মানিত ব্যক্তির আগমণে দাঁড়িয়ে সম্মান করা মুস্তাহাব। এর মাধ্যমে কেউ খুশী হলে তাও জায়েয। যেমন কা’ব (রাঃ) তালহা (রাঃ) এর দাঁড়ানোর মাধ্যমে খুশী হয়েছিলেন। এটি রসূল (ﷺ) এর সেই হাদীছের বিরোধী নয়, যেখানে তিনি বলেছেন- যে ব্যক্তি চায় যে, মানুষেরা তার সামনে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকুক, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা নির্ধারণ করে নেয়। কেননা এই ধমকি অহংকারীদের জন্য এবং যারা না দাঁড়ালে রসূান্বিত হয় তাদের জন্য। নাবী (ﷺ) ফাতেমার আগমণে খুশী হয়ে দাঁড়াতেন এবং ফাতেমাও নাবী (ﷺ) এর সম্মানে দাঁড়াতেন। এমনি ঐ সমস্ত কিয়ামের একই হুকুম, যা আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য ভালবাসা পয়দা করে এবং যা আল্লাহর অনুগ্রহে কোন মুসলমান ভাইয়ের অন্তরে আনন্দ দেয়। আমলসমূহ নিয়তের উপরই হয়ে থাকে। (আল্লাহই ভাল জানেন)
মানুষ নিজেই নিজের প্রশংসা করতে পারে। তবে শর্ত হল তা যেন অহংকার বশত না হয়।
আকাবার ঘটনা তথা বায়আতে আকাবা ছিল ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম একটি ফযীলতপূর্ণ ঘটনা।
রসূল (ﷺ) এর বরকতময় যামানায় সৈনিকদের নাম লিখে রাখার জন্য কোন দফতর ও রেজিষ্টারের ব্যবস্থা ছিলনা। উমার (রাঃ) এর যুগ থেকেই সেনাবাহিনীর জন্য আলাদা বিভাগ ও দফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
কোন মানুষের যখন কোন ইবাদত করার এবং আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করার সুযোগ আসে, তখন প্রচুর আগ্রহ ও উদ্যোমসহ সেই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করা দরকার। কেননা ইবাদত-বন্দেগীর ইচ্ছা ও দৃঢ়তা দ্রুত গতিতে দুর্বল হয়ে যায়। খুব কম সংখ্যক লোকই দ্বীনের উপর সর্বদা কায়েম থাকার সুযোগ পায়। কারও যদি নেকীর কাজ করার সুযোগ হয়, আর সে যদি সেই সুযোগ কাজে না লাগায়, তাহলে শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ্ তার অন্তর এবং তার ইচ্ছার মাঝে অন্তরায় হয়ে যান। ফলে সে আর উক্ত ভাল কাজটি করার সুযোগ পায়না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ يَحُولُ بَيْنَ
الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
‘‘ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্ ও তাঁর রসূুলের নির্দেশ মান্য কর, যখন তোমাদের সে কাজের প্রতি আহবান করা হয়, যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন। জেনে রেখো, আল্লাহ্ মানুষের এবং তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হয়ে যান। বস্ত্তত তোমরা সবাই তারই নিকট সমবেত হবে’’।[1] আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
وَنُقَلِّبُ أَفْئِدَتَهُمْ وَأَبْصَارَهُمْ كَمَا لَمْ يُؤْمِنُوا بِهِ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَنَذَرُهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ
‘‘প্রথম বারে যেমন তারা এর প্রতি ঈমান আনেনি ঠিক তেমনিভাবেই আমি তাদের অন্তর ও দৃষ্টিকে ফিরিয়ে দিচ্ছি এবং আমি তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার মধ্যে উদভ্রামেত্মর মত ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দিচ্ছি’’।[2] আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللهُ قُلُوبَهُمْ وَاللهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
‘‘অতঃপর তারা যখন বক্রতা অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ্ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না’’।[3] আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
وَمَا كَانَ اللهُ لِيُضِلَّ قَوْمًا بَعْدَ إِذْ هَدَاهُمْ حَتَّى يُبَيِّنَ لَهُمْ مَا يَتَّقُونَ إِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
‘‘আর আল্লাহ্ কোন জাতিকে হেদায়েত করার পর পথভ্রষ্ট করেন না, যতক্ষণ না তাদের জন্য পরিষ্কারভাবে বলে দেন সে সব বিষয় যা থেকে তাদের বেঁচে থাকা দরকার। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সব বিষয়ে ওয়াকেফহাল’’।[4]
রসূল (ﷺ)-এর সাথে যুদ্ধের সফরে বের হতে কেবল মুনাফেক, অসুস্থ কিংবা তাঁর পক্ষ হতে কোন কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত লোকেরাই পিছিয়ে থাকত।
ইমামুল মুসলিমীনের উচিৎ নয় যে, তিনি যুদ্ধে যাওয়া থেকে পিছিয়ে থাকা লোকদের কোন খোঁজ-খবর নিবেন না; বরং তাঁর উচিৎ পিছনে থেকে যাওয়া লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন এবং কৈফিয়ত তলব করবেন। যাতে সেই সাথী আনুগত্যের কাজে উৎসাহ পায়। কেননা তাবুকের পথে কা’ব (রাঃ) কে না দেখে নাবী (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন- কা'বের কি হয়েছে? তাকে সংশোধনের নিয়তেই তিনি এভাবে খোঁজ-খবর নিলেন। ঐদিকে যে সমস্ত মুনাফেক তাবুক যুদ্ধে আসেনি, তাদের প্রতি অবহেলার কারণে তাদের কারও নামটি পর্যন্ত তিনি উচ্চারণ করেন নি।
আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূলের খাতিরে ইজতেহাদের ভিত্তিতে কারও দোষ বর্ণনা করা জায়েয আছে। এর উপর ভিত্তি করেই মুহাদ্দিছীনে কেরাম হাদীছের রাবীদের দোষ বর্ণনা করেছেন বা তাদের ন্যায়পরায়নতার সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং সুন্নী আলেমগণ বিদআতীদের প্রতিবাদ করেছেন।
যদি যান্নে গালেব (প্রবল ধারণা) দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, শুধু ধারণার উপর ভিত্তি করেই কাউকে দোষারোপ করা হয়েছে, তাহলে দোষারোপকারীর জবাব দেয়া এবং তার প্রতিবাদ করাও জায়েয আছে। বিশেষ করে যখন জানা যাবে যে, দোষারোপকারী কোন মূলনীতির উপর ভিত্তি না করেই দোষারোপ করেছে এবং সে এ ক্ষেত্রে ভুল করেছে। যেমন মুআয (রাঃ) নাবী (ﷺ)-এর মজলিসে দোষারোপ কারীর প্রতিবাদ করেছেন। নাবী (ﷺ) তা শুনেছেন এবং চুপ থেকেছেন। মুআযের এই কাজকে তিনি অপছন্দ করেন নি।
সফর থেকে ফেরত আসার সময় ওযূ করে পবিত্র হয়ে নিজ মহল্লায় প্রবেশ করা সুন্নাত। সেই সাথে নিজ গৃহে প্রবেশের পূর্বে আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করে দুই রাকআত সলাত পড়বে।
মুসলিমদের শাসকের জন্য জায়েয আছে যে, কোন লোক ইসলামের মধ্যে বিদআত রচনা করলে শাসক তার সালামের জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকবেন। যাতে অন্যরা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
শাসকের জন্য জায়েয আছে যে, তিনি তার সাথী ও প্রিয়জনদেরকে সংশোধনের উদ্দেশ্যে দোষারোপ করতে পারবেন। কেননা নাবী (ﷺ) ঐ তিনজনকে দোষারোপ করেছেন। বাকীদেরকে দোষারোপ করেন নি। মানব ইতিহাসে প্রিয়জনকে দোষারোপের বহু কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ্ তা‘আলা কাব বিন মালেক এবং তাঁর সাথীদ্বয়কে সত্য বলার তাওফীক দিয়েছেন এবং মিথ্যা ওজর পেশ করা থেকে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তারা যদি মিথ্যা বলতেন, তাহলে অল্প সময় তারা আরামে থাকতে পারতেন; কিন্তু আখিরাত সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যেত। সত্যবাদীগণ দুনিয়াতে সামান্য সময় কষ্ট ভোগ করেন। কিন্তু তাদের আখিরাত খুব ভাল হয়। এর উপরই দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয় কায়েম রয়েছে। প্রথমে দুঃখ, পরে সুখ এবং প্রথমে অশান্তি, পরে শান্তি। নাবী (ﷺ) শুধু তাদের তিনজনের সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে, তারা তিনজন বাদে বাকীরা মিথ্যুক ছিলেন। সুতরাং কথা-বার্তা বন্ধের মাধ্যমে তিনি সত্যবাদীদেরকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। আর এই ঔষধ মুনাফেকদের কোন কাজে আসবেনা বলেই তাদের থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কারণ তাদের অপরাধ এত বড় যে, শুধু কথা বলা বর্জনের মাধ্যমে তার বিনিময় দেয়া সম্ভব নয়।
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে গুনাহ্-এর শাস্তি এ জন্যই দিয়ে থাকেন। তিনি তাঁর যেই বান্দাকে ভালবাসেন, তাকে সামান্য অপরাধের কারণেই পাকড়াও করেন ও শাস্তি দেন। যাতে পরবর্তীতে সাবধান ও সতর্ক হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যেই বান্দা আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার কারণে তাঁর ভালাবাসা হারায়, আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে অবকাশ দেন। ফলে সে নির্ভয়ে গুনাহ্-এর কাজে লিপ্ত হয়। যখনই সে একটি গুনাহ্ করে, তখনই আল্লাহ্ তার জন্য নতুন একটি নিয়ামাত বৃদ্ধি করেন। এই বিভ্রান্ত লোকটি মনে করে, এটি তার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে কারামত ও সম্মান স্বরূপ। সে জানে না যে, এই নিয়ামাতই তার অপদসেত্মর কারণ। আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে এর মাধ্যমে কঠিন শাস্তি দিতে চান। হাদীছে এসেছে, নাবী (ﷺ) বলেন-
إِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدِهِ الْخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ الْعُقُوبَةَ فِى الدُّنْيَا وَإِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى
يُوَفَّى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা যখন তাঁর কোন বান্দার কল্যাণ চান, তখন দুনিয়াতেই তাকে শাস্তি দেন। আর কোন বান্দার অকল্যাণ চাইলে পাপের কারণেও তার উপর থেকে দুনিয়ার শাস্তি উঠিয়ে নেন। যাতে করে পরকালে তাঁকে পরিপূর্ণ শাস্তি প্রদান করেন’’।[5]
কাব বিন মালেক (রাঃ) বলেন- আমি আবু কাতাদার বাগানের দেয়াল বেয়ে উঠে বাগানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কোন লোক তার সাথী ও প্রতিবেশীর ঘরে বিনা অনুমতিতেই প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে যখন জানা যাবে যে, সাথী বা প্রতিবেশী এতে অসন্তুষ্ট হবেনা।
সুসংবাদ দানকারী যখন কাব বিন মালেক (রাঃ) তাওবা কবুল হওয়ার খবর নিয়ে আসল, তখন তিনি তা শুনে সিজদায়ে শুকরিয়া আদায় করলেন। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এটিই ছিল সাহাবীদের পবিত্র সুন্নাত। নতুন কোন নিয়ামাত প্রাপ্ত হলে অথবা কোন অকল্যাণ দূর হলে তারা সিজদায়ে শুকরিয়া আদায় করতেন। জিবরীল (আঃ) যখন নাবী (ﷺ) এর কাছে এই খবর নিয়ে আসলেন যে, কোন মুমিন তাঁর উপর একবার সালাত পেশ করলে আল্লাহ্ তা‘আলা সেই মুমিনের উপর দশটি রহমত নাযিল করবেন তখন নাবী (ﷺ) সিজদায়ে শুকর আদায় করেছেন। এমনি যখন তিনি জানতে পেরেছেন যে, উম্মাতের জন্য তাঁর শাফাআত কবুল হবে, তখনও তিনি সিজদায়ে শুকরিয়া আদায় করেছেন। উম্মাতের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা তিনবার তাঁর শাফাআত কবুল করেছেন। মিথ্যুক নাবী মুসায়লামা কাজ্জাব নিহত হওয়ার খবর আসার পর আবু বকর (রাঃ) সিজদায়ে শুকরিয়া আদায় করেছেন। আলী (রাঃ) যখন জানতে পারলেন যে, খারেজীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে নিহতদের মধ্যে যুল-ছাদইয়াকেও পাওয়া গেছে, তখন তিনিও সিজদায়ে শুকরিয়া আদায় করেছেন।
একজন সাহাবী হোড়া ছুটিয়ে এবং অন্য একজন ‘সালা’ নামক পাহাড়ের উপর উঠে কা’ব বিন মালেকের তাওবা কবুল হওয়ার সংবাদটি ঘোষণা করে সুসংবাদ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, তখন মুসলমানদের পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক অত্যন্ত গাঢ় ছিল, তারা নেকীর কাজে খুব অগ্রগামী ছিলেন, একে অন্যের কল্যাণ কামণা করতেন এবং অন্যের সুখে সুখী হতেন ও দুঃখের অংশীদার হতেন।
সু-সংবাদ দানকারীকে উপহার দেয়া উত্তম চরিত্রের আলামত। এটিও জানা যাচ্ছে, শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে সু-সংবাদ দানকারীকে দিয়ে দেয়াও জায়েয আছে। এই ঘটনা থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে, দ্বীন-দুনিয়ার যে কোন নিয়ামাত আসলে বন্ধুদেরকে মোবারকবাদ জানানো মুস্তাহাব। নেয়ামতপ্রাপ্ত লোকের জন্য দাঁড়ানো এবং তার সাথে মুসাফাহা করাও সুন্নাত। শুধু দ্বীনি ক্ষেত্রেই নয়; বরং পার্থিব কোন নিয়ামাত আসলেও নিয়ামাতপ্রাপ্ত লোককে মোবারকবাদ দেয়া জায়েয। এ ক্ষেত্রে এ ধরণের বাক্য উচ্চারণ করা উত্তম যে, আল্লাহ্ আপনাকে যা দিয়েছেন, তা বরকতময় হোক, আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামাত আপনার জন্য স্থায়ী হোক ইত্যাদি। এতে এক দিকে যেমন আল্লাহর কাছ থেকেই নিয়ামাত আসার কথা স্বীকার করা হল, অন্যদিকে নিয়ামাত অর্জনকারীর জন্য দু’আও করা হল।
একজন মানুষের কাছে সর্বোত্তম দিন সেটিই, যেদিন সে তাওবা করে এবং আল্লাহ্ তার তাওবা কবুল করেন। কা’ব ও তাঁর সাথীদের তাওবা কবুলে নাবী (ﷺ) অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে, তিনি তাঁর উম্মাতের উপর অত্যন্ত দয়াশীল ছিলেন।
তাওবা করার সময় ও তা কবুল হওয়ার সময় শুকরিয়া স্বরূপ সাধ্যানুযায়ী সাদকাহ করা মুস্তাহাব। যে ব্যক্তি তার সমস্ত মাল সাদকাহ করে দেয়ার মানত করল, তার সকল সম্পদ দিয়ে দেয়া আবশ্যক নয়। সেখান থেকে কিছু মাল রেখে দেয়াতে অসুবিধা নেই।
কাব বিন মালেক (রাঃ) এর ঘটনা থেকে সত্য কথা বলার ফযীলত জানা যায়। শুধু তাই নয়; দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ সত্য বলার মধ্যেই নিহিত। আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। এক শ্রেণী হচ্ছেন সৌভাগ্যশীল। তারা হলেন সত্যবাদী এবং সত্যকে সত্যায়নকারী। আরেক শ্রেণী হচ্ছে হতভাগ্য। তারা হল, মিথ্যাবাদী ও মিথ্যার পথ অবলম্বনকারী। এটি হচ্ছে চূড়ান্ত শ্রেণী বিন্যাস। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
لَقَدْ تَابَ اللهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالأنْصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ مِنْ بَعْدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ إِنَّهُ بِهِمْ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
‘‘আল্লাহ্ তাঁর নাবীর এবং মুহাজির ও আনসারদের তাওবা কবুল করেছেন (তাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন), যারা কঠিন মুহূর্তে নাবীর সঙ্গে ছিল, যখন তাদের এক দলের অন্তর ফিরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অতঃপর তিনি দয়াবান হন তাদের প্রতি। নিঃসন্দেহে তিনি তাদের প্রতি দয়াশীল ও করুণাময়’’।[6]
এই আয়াতের মাধ্যমে সহজেই তাওবার গুরুত্ব বুঝা যায়। মূলতঃ তাওবা বান্দাকে একজন পূর্ণাঙ্গ মুমিনে পরিণত করে। জিহাদের ময়দানে আত্মত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাদেরকে তা প্রদান করেছেন। বিশেষ করে মুসলমানেরা যখন তাদের জান, মাল এবং ঘরবাড়ি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করেছেন। এগুলোর পিছনে তাদের একমাত্র মহৎ উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ্ তা‘আলা যেন তাদের দোষ-ত্রুটিগুলো মাফ করেন এবং তাদের তাওবা কবুল করেন। এ জন্যই নাবী (ﷺ) কাব বিন মালেকের তাওবা কবুলের দিন বলেছিলেন- জন্মের পর হতে আজকের দিনটিই তোমার জন্য সর্বাধিক আনন্দময়। এই প্রকৃত সত্যটি কেবল সেই সঠিকভাবে বুঝতে পারবে, যে আল্লাহর পবিত্র যাতকে (সত্তাকে) চিনতে পেরেছে, তার উপর আল্লাহর হকসমূহ উপলদ্ধি করতে পেরেছে, তিনিই যে ইবাদতের একমাত্র হকদার এটিও বুঝতে সক্ষম হয়েছে। সেই সাথে যে বান্দা তার নিজের সত্তা ও তার অবস্থাকে বুঝতে পেরেছে এবং এটি অনুভব করতে পেরেছে যে, তার উপর আল্লাহ্ তা‘আলার যে সমস্ত হক রয়েছে, সেগুলোর তুলনায় তার ইবাদত কেবল সামান্য এক বিন্দু পানির সমান, যা বিশাল সমুদ্রের মধ্যে ঢেলে দেয়া হয়। তাও আবার যখন রিয়া এবং অন্যান্য দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র হয়।
সুতরাং সেই যাতে ইলাহী অতি পবিত্র, যার অনুগ্রহ ও ক্ষমা ছাড়া বান্দাদের কোন উপায় নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে তাওবার বিষয়টি দুইবার উল্লেখ করেছেন। একবার আয়াতের প্রথমে আরেকবার শেষের দিকে। প্রথমে তাদেরকে তাওবা করার তাওফীক দিয়েছেন, আবার দ্বিতীয়বারে তারা যখন তাওবা করেছেন, তখন আল্লাহ্ তাদের তাওবা কবুল করেছেন। সকল প্রকার কল্যাণ কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতেই, তাঁর তাওফীকের ফলেই, তাঁর জন্যেই এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণেই। যাকে ইচ্ছা, তিনি তাকে স্বীয় অনুগ্রহে প্রদান করেন এবং ন্যায়বিচারার্থে এবং বিশেষ উদ্দেশ্যে যাকে ইচ্ছা তা থেকে বঞ্চিত করেন।
[2]. সূরা আনআম-৬:১১০
[3]. সূরা সাফ-৬১:৫
[4]. সূরা তাওবা-৯: ১১৫
[5]. তিরমিযী, অধ্যায়ঃ মুসীবতে সবর করা। ইমাম আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন, সিলসিলাহ সহীহা, হা/১২২০
[6]. সূরা তাওবা-৯:১১৭