নাবী (ﷺ) যখন তাবুক যুদ্ধে রওয়ানা হলেন এবং মাত্র এক ঘন্টার দূরত্ব অতিক্রম করে যু-আওয়ান নামক স্থানে অবতরণ করলেন। তখন মসজিদে যিরারের নির্মাণকারীগণ নাবী (ﷺ)-এর কাছে এসে উপস্থিত হল। তিনি তখন পুনরায় যাত্রা শুরু করার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। তারা বলল- হে আল্লাহর রসূল! দুর্বলদের জন্য এবং বৃষ্টিময় রাতে সলাত পড়ার জন্য আমরা একটি মসজিদ নির্মাণ করেছি। আমরা চাই যে, আপনি তাতে আসবেন এবং সলাত পড়ে মসজিদটি উদ্বোধন করে দিবেন। রসূল (ﷺ) বললেন- আমি সফরে বের হচ্ছি। ফেরত এসে ইনশা-আল্লাহ্ তোমাদের কাছে যাবো। তাবুক থেকে ফেরার পথে পুনরায় যখন যু-আওয়ান নামক স্থানে অবতরণ করলেন তখন আকাশ থেকে মসজিদটির প্রকৃত খবর চলে আসল। তখন তিনি মালেক বিন দুখশুম এবং মাআন বিন আদীকে ডেকে বললেন- তোমরা উভয়ে দ্রুত জালেমদের এই মসজিদে যাও এবং এটিকে ধ্বংস করে আগুন দিয়ে জালিয়ে দাও। তারা উভয়ে দ্রুত বের হয়ে বনী সালেম গোত্রের নিকট গেলেন। বনী সালেম ছিল মালেক বিন দুখশুমের গোত্র। তিনি তখন মাআনকে বললেন- তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি বাড়িতে গিয়ে আগুন নিয়ে আসি। তিনি খেজুর গাছের একটি ডাল নিয়ে তাতে আগুন ধরালেন। তারা উভয়ে দৌড়িয়ে গিয়ে মসজিদটিতে প্রবেশ করলেন। তখনও ঐ দুষ্টরা মসজিদেই ছিল। এরপর তারা উভয়েই মসজিদটি ধ্বংস করে ফেললেন এবং তাতে আগুন জালিয়ে দিলেন। মুনাফেকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আল্লাহ্ তা‘আলা তখন এই আয়াত নাযিল করলেন-
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَإِرْصَادًا لِمَنْ حَارَبَ اللهَ وَرَسُولَهُ مِنْ قَبْلُ وَلَيَحْلِفُنَّ إِنْ أَرَدْنَا إِلا الْحُسْنَى وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ
‘‘আর যারা নির্মাণ করেছে মসজিদ জিদের বশে এবং কুফরীর তাড়নায় মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ঐ লোকের জন্য ঘাঁটিস্বরূপ, যে পূর্ব থেকে আল্লাহ্ ও তার রসূলের সাথে যুদ্ধ করে আসছে, আর তারা অবশ্যই শপথ করবে যে, আমরা কেবল কল্যাণই চেয়েছি। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ সাক্ষী যে, তারা সবাই মিথ্যুক’’।[1]
তাবুক যুদ্ধ হতে বিজয়ী বেশে নাবী (ﷺ) মদ্বীনায় আসছেন। সফর ছিল অনেক লম্বা। বিপদাপদে ছিল পরিপূর্ণ। সকল বাধা উপেক্ষা করে বিজয়ী বেশে যখন মদ্বীনার একদম কাছে চলে আসলেন তখন মদ্বীনায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ এবং শিশু-কিশোর এক কথায় সকল শ্রেণীর মানুষ রসূলকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মদ্বীনার বাইরে চলে আসল। মদ্বীনার কিশোরী মেয়েরা নিম্নের এই কবিতাগুলো আবৃতি করে তাদের প্রিয় নাবীকে স্বাগত জানিয়েছিলঃ
طَلَـعَ البَــدْرُ عَلَيْنَا + مِـنْ ثَنِيَّاتِ الوَدَاعِ
وَجَـبَ الشُّكْرُ عَلَيْنَا + مَا دَعَــا للهِ دَاعِى
‘‘ছানিয়াতুল ওয়াদার দিক থেকে আমাদের উপর পূর্ণিমার চন্দ্র উদিত হয়েছে যতদিন আল্লাহর পথে আহবানকারী আহবান করবে, ততদিন আমাদের উপর শুকরিয়া আদায় করা আবশ্যক।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন- কোন কোন ঐতিহাসিকের ধারণা, রসূল (ﷺ) যখন হিজরত করে মক্কা হতে মদ্বীনায় আগমণ করলেন, তখন মদ্বীনাবাসীগণ এগুলো আবৃত্তি করেছিল। এটি ভুল ধারণা। কেননা ছানিয়াতুল ওয়াদা সিরিয়ার (তাবুকের) পথে অবস্থিত। মক্কা থেকে মদ্বীনায় প্রবেশের সময় ছানিয়াতুল ওয়াদা চোখে পড়ে না। মদ্বীনা থেকে বের হওয়ার সময় সিরিয়া বা তাবুকগামী লোক ছাড়া অন্য কেউ এই পথে অতিক্রম করেনা।
মদ্বীনায় প্রবেশের নিকটবর্তী হয়ে তিনি বললেন- এটি হচ্ছে ‘তাবা’ (পবিত্র শহর)। তিনি উহুদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন- এটি হচ্ছে উহুদ। এটি এমন পাহাড়, যা আমাদেরকে ভালবাসে। আমরাও এটিকে ভালবাসি।[2] মদ্বীনায় প্রবেশ করে তিনি প্রথমে সরসূরি মসজিদে গেলেন এবং দুই রাকআত সলাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি মানুষের সামনে বসলেন। যারা রসূল (ﷺ)-এর সাথে তাবুক যুদ্ধে যায়নি, তারা এসে ওযূহাত পেশ করতে লাগল এবং কসম খেতে লাগল। তাদের সংখ্যা ছিল আশির উপরে। বাহ্যিক দিকে লক্ষ্য করে তিনি তাদের ওজর (ওযূহাত) কবুল করলেন এবং অন্তরের বিষয়টি আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দিলেন। তাদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুরআনের এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়ঃ
يَعْتَذِرُونَ إِلَيْكُمْ إِذَا رَجَعْتُمْ إِلَيْهِمْ قُلْ لا تَعْتَذِرُوا لَنْ نُؤْمِنَ لَكُمْ قَدْ نَبَّأَنَا اللهُ مِنْ أَخْبَارِكُمْ وَسَيَرَى اللهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَى عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ سَيَحْلِفُونَ بِاللهِ لَكُمْ إِذَا انْقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ لِتُعْرِضُوا عَنْهُمْ فَأَعْرِضُوا عَنْهُمْ إِنَّهُمْ رِجْسٌ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ يَحْلِفُونَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنْ تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللهَ لا يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ
‘‘তোমরা যখন তাদের কাছে ফিরে আসবে, তখন তারা তোমাদের নিকট নানা ধরণের ওযর (ওযূহাত) নিয়ে উপস্থিত হবে; তুমি বলঃ তোমরা ওযর পেশ করোনা, আমরা কখনও তোমাদের কথাই বিশ্বাস করবোনা। আমাদেরকে আল্লাহ্ তোমাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে দিয়েছেন। আর এখন তোমাদের কর্ম আল্লাহ্ই দেখবেন এবং তার রসূলও। তারপর তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে তাঁরই দিকে যিনি প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছুই জানেন। তিনিই তোমাদের বাতলে দেবেন যা তোমরা করছিলে। তোমরা তাদের কাছে ফিরে এলে তারা তোমার সামনে আল্লাহর কসম খাবে, যাতে তোমরা তাদেরকে উপেক্ষা করো। সুতরাং তুমি তাদের পরিহার করো। নিঃসন্দেহে এরা অপবিত্র এবং তাদের কৃতকর্মের বদলা হিসাবে তাদের ঠিকানা হলো জাহান্নাম। তারা তোমার সামনে কসম খাবে যাতে তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হও। অতএব, তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ্ তা‘আলা কখনও এহেন ফাসেকের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না’’।[3]
[2]. বুখারী ও মুসলিম।
[3]. সূরা তাওবা-৯: ৯৪-৯৬