ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
মুখতাসার যাদুল মা‘আদ অনুচ্ছেদ সমুহের সূচী ও বিবরন ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)
তায়েফের যুদ্ধ হতে যে সমস্ত মাসআলা জানা যায়
- হারাম মাসেও যুদ্ধ করা জায়েয। প্রথমে হারাম মাসে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে তা রহিত হয়ে গেছে। কেননা রসূল (ﷺ) মদ্বীনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রমযান মাসের শেষের দিকে বের হয়েছেন। মক্কায় পৌঁছে ১৯ দিন অবস্থান করেছেন। অতঃপর হাওয়াযেন গোত্রের দিকে বের হয়েছেন এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। অতঃপর তায়েফে গিয়ে তা ১৮ দিন বা ২৩ দিন অবরোধ করে রেখেছেন। আপনি যদি এই দিন ও মাসগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেন, তাহলে জানতে পারবেন যে, অবরোধের কিছু দিন যুল-কাদ মাস পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এই কথার জবাবে বলা যায় যে, হারাম মাসে শুধু অবরোধ করা হয়েছিল। যুদ্ধ হয়েছিল শাওয়াল মাসে। সুতরাং যুদ্ধ যেহেতু শুরু হয়েছিল, তাই হারাম মাস চলে আসার কারণে তা বন্ধ করা হয়নি। তা ছাড়া এও বলা যেতে পারে যে, আপনাদের কাছে এমন কোন দলীল আছে কি, যা প্রমাণ করে নাবী (ﷺ) কোন হারাম মাসে যুদ্ধ শুরু করেছেন? সুতরাং শুরু করা এবং চালিয়ে যাওয়ার মাঝে পার্থক্য রয়েছে।
- তায়েফের যুদ্ধ থেকে এও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী-পরিবার সাথে নিয়ে যুদ্ধে বের হওয়া জায়েয আছে। কেননা নাবী (ﷺ) এই যুদ্ধে উম্মে সালামাহ এবং যায়নাব (রাঃ) কে সাথে নিয়েছিলেন।
- ভারী অস্ত্র (ক্ষেপণাস্ত্র) নিক্ষেপ করে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয আছে। যদিও তাতে নারী ও শিশু নিহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেননা নাবী (ﷺ) তায়েফের যুদ্ধে মিনজানিক (ক্ষেপণাস্ত্র জাতিয় অস্ত্র) ব্যবহার করেছিলেন।
- শত্রুপক্ষকে দুর্বল করার জন্য এবং তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তোলার জন্য তাদের গাছপালা ও সম্পদ নষ্ট করা জায়েয আছে।
- কাফেরদের ক্রীতদাসেরা পালিয়ে এসে মুসলিমদের সাথে যোগ দিলে তারা স্বাধীন বলে গণ্য হবে। ইবনুল মুনযির এ বিষয়ে আলেমদের ইজমা বর্ণনা করেছেন।
- এই যুদ্ধ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুসলিমদের ইমাম যদি শত্রুদের কোন ঘাটিকে অবরোধ করে, এরপর যদি দেখা যায় যে, অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে, তাহলে তার জন্য তা করা জায়েয আছে।
- এ থেকে জানা গেল যে, নাবী (ﷺ) ‘জিআর্রানা’ নামক জায়গা থেকে উমরার ইহরাম বেঁধেছেন। তায়েফের পথে যারা উমরার নিয়তে মক্কায় প্রবেশ করবে, তাদের জন্য এখান থেকে ইহরাম বাঁধা সুন্নাত। আর উমরার নিয়তে মক্কা হতে বের হয়ে জিআর্রানায় এসে ইহরাম বাঁধাকে কোন আলেমই মুস্তাহাব বলেন নি। নাবী (ﷺ) কিংবা তাঁর কোন সাহাবীই এমনটি করেন নি। মূর্খ লোকেরা মক্কা থেকে বের হয়ে জিআর্রানা নামক স্থানে (আয়িশা মসজিদে) এসে উমরার জন্য ইহরাম বাধাকে সুন্নাত মনে করে থাকে।
- ছাকীফ গোত্রের লোকদের জন্য হিদায়াতের দু’আ করা নাবী (ﷺ) এর দয়া ও কোমলতার প্রমাণ বহন করে। অথচ এর আগে তারা রসূল (ﷺ) এর সাথে যুদ্ধ করেছে, তাঁর একদল সাহাবীকে হত্যা করেছে এবং তাদের নিকট তাঁর প্রেরিত দূতকেও হত্যা করেছে।
- এই ঘটনায় নাবী (ﷺ) এর সাথে আবু বকর (রাঃ) এর গভীর ভালবাসা এবং যে কোন পন্থায় তাঁর নৈকট্য অর্জনের আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়। এ কারনেই তিনি মুগীরাকে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি যেন ছাকীফ গোত্রের আগমণের সুখবরটি নাবী (ﷺ) কে না দেন। যাতে করে তিনিই (আবু বকরই) নাবী (ﷺ) কে এই খবরটি দিয়ে খুশী করতে পারেন। এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মুসলিমের জন্য তার অপর মুসলিম ভাইয়ের কাছে এই আবেদন করা জায়েয আছে যে, সে যেন তাকে কোন নেকীর কাজ করার সুযোগ করে দেয়। এ রকম দাবী করা এবং দাবী মুতাবেক ভাল কাজের সুযোগ দেয়া উভয়টিই জায়েয। সুতরাং যারা বলেন যে, নেকীর কাজে অন্যকে প্রাধান্য দেয়া জায়েয নেই, তাদের কথা ঠিক নয়। আয়িশা (রাঃ) নিজ ঘরে উমার (রাঃ) কে রহমতের নাবী (ﷺ) এর পাশে কবর দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আয়িশা (রাঃ) এর মনোবাসনা ছিল যে, নাবী (ﷺ) এর কবরের পাশেই তাঁর কবর হবে। কিন্তু উমার (রাঃ) এর অনুরোধের প্রেক্ষিতে তিনি এই ফযীলত অর্জনের ক্ষেত্রে খলীফাতুল মুসলিমীন উমার (রাঃ) কে নিজের উপর প্রাধান্য দিলেন। তিনি উমার (রাঃ) এর আবেদনে কোন প্রকার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন নি; বরং তাতে সম্মতি দিলেন।
- তায়েফের ঘটনা থেকে প্রমাণ মিলে যে, ভেঙ্গে ফেলার ক্ষমতা থাকলে শিরক ও তাগুতের আড্ডাকে একদিনের জন্যও অবশিষ্ট রাখা জায়েয নেই। কেননা এগুলো হচ্ছে শিরক ও কুফরের নিদর্শন এবং সর্বাধিক গর্হিত কাজ। সুতরাং ক্ষমতা থাকলে এগুলোকে বহাল রাখা কখনই বৈধ নয়। মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মাজারগুলোর ক্ষেত্রে একই হুকুম। এগুলোকে কবরের উপর নির্মাণ করা হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে এই তাগুত ও মূর্তিগুলোর ইবাদত করা হচ্ছে। মাজারগুলোর প্রাচীর ও পাথরগুলোকে তা’যীম করা হচ্ছে, এগুলো থেকে তাবার্রম্নক হাসিল করা হচ্ছে, এগুলোর জন্য নযর-মানত পেশ করা হচ্ছে, লোকেরা এগুলোকে চুম্বন করছে। ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলার ক্ষমতা থাকলে পৃথিবীতে এগুলোর অসিত্মত্ব টিকে থাকতে দেয়া বৈধ নয়। এই মাজার ও গম্বুজগুলোর অধিকাংশই বর্তমানে লাত, মানাত ও উজ্জার স্থান দখল করে আছে। শুধু তাই নয়; কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলোকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত শিরক লাত ও মানাত কেন্দ্রিক শিরককে অতিক্রম করেছে। আমরা এগুলোর ফিতনা থেকে উদ্ধারের জন্য দয়াময় আল্লাহর সাহায্য চাই। আমীন।
- বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে অলী-আওলীয়ার কবরের উপর নির্মিত মাজার ও গম্বুজ কেন্দ্রিক শিরক লাত ও মানাত কেন্দ্রিক শির্কের মতই কিংবা তার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বরূপ এই যে, লাত, মানাত ও উজ্জার অনুসরীরা এই বিশ্বাস করতনা যে, এরা সৃষ্টি করতে পারে, রিযিক দিতে পারে, মৃত্যু দিতে পারে কিংবা জীবন দান করতে পারে। ঐ সময়ের তথা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের মুশরিকরা লাত, মানাত ও উজ্জার কাছে তাই করত, যা করছে বর্তমানে তাদের মুশরিক ভাইয়েরা (মাজার পূজারী মুসলিমরা) তাদের তাগুতসমূহের কাছে (মাজারসমূহে)। সুতরাং বর্তমানের এই লোকেরা (নামধারী মুসলিমরা) তাদের পূর্বসূরী মুশরিকদের অনুসরণ করছে এবং পদে পদে তাদের পথেই চলছে।
- দ্বীনের সঠিক শিক্ষা বিলুপ্ত হওয়ার এবং জাহেলিয়াতের প্রসার ঘটার কারণে মানুষের উপর শিরক চেপে বসেছে। সুতরাং তাদের কাছে ভাল বিষয় মন্দে পরিণত হয়েছে এবং মন্দই ভালতে পরিণত হয়েছে। সু্ন্নাতকে তারা বিদআত এবং বিদআতকেই সুন্নাত মনে করছে। এর উপরই তাদের ছোটরা প্রতিপালিত হয়েছে এবং যুবকেরা বৃদ্ধ হয়েছে। ইসলামের প্রকৃত নিদর্শন গায়েব হয়েছে, হিদায়াতের আলো নিভে গেছে, ইসলামের গুরবত (অপরিচিতি) ভয়াবহ ধারণ করেছে, আলেমদের সংখ্যা কমে গেছে, মূর্খদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, হতাশা ও নিরাশার ছাপ ফুটে উঠেছে এবং মানুষের পাপের কারণেই জলে ও স্থলে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এত কিছুর পরও উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে এমন একটি দল রয়েছে, যারা সব সময় হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং আল্লাহ্ তা‘আলা পৃথিবী এবং কিয়ামত পর্যন্ত তারা আহলে শিরক ও বিদআতীদের মুকাবেলায় জিহাদ করতে থাকবে। আর আল্লাহ্ তা‘আলাই সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী।
- গাযওয়ায়ে তায়েফ তথা তায়েফের যুদ্ধ হতে আরও জানা যায় যে, রাষ্ট্র প্রধানের জন্য জায়েয আছে যে, তিনি মাজার ও দরগাহ-এর সম্পদগুলো বাজেয়াপ্ত করে তা জিহাদ এবং মুসলিমদের অন্যান্য প্রয়োজনে খরচ করতে পারবেন। সেই সাথে সৈনিকদের মাঝে এগুলো ভাগ করে দেওয়া এবং ইসলামের অন্যান্য কাজেও ব্যয় করা জায়েয আছে। এগুলো বিক্রি করে মুসলমানদের কাজে তার মূল্য ব্যবহার করাও জায়েয। মাজারগুলোতে ওয়াক্ফকৃত সম্পদের হুকুম একই। অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রধানের জন্য তা বাজেয়াপ্ত করা ও তা মুসলমানদের কাজে খরচ করা জায়েয। কারণ এগুলোতে ওয়াক্ফ করার কোন ভিত্তি নেই। এখানে মাল খরচ করা অপচয় ব্যতীত অন্য কিছু নয়। সুতরাং তা এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে মুসলমানদের উপকারী কাজে খরচ করতে হবে। আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রসূলের আনুগত্যের কাজেই ওয়াক্ফ করা জায়েয। কবর ও মাজারে ওয়াক্ফ করা সহীহ নয়। কবরে বাতি জ্বালানো, কবরকে সম্মান করা, তাতে মানত করা, কবর যিয়ারতের জন্য ভ্রমণ করা, আল্লাহর পরিবর্তে কবরের উপাসনা করা এবং আল্লাহর বদলে এগুলোকে মাবুদ হিসাবে গ্রহণ করার কোন ভিত্তি নেই। এতে ইসলামের ইমামদের কোন ইমামই মতভেদ করেন নি।