ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
ফাতাওয়া ও প্রশ্নোত্তর আকিদা, শিরক ও বিদআত আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
কথিত ‘শবে বরাত’ উপলক্ষে প্রচলিত কতিপয় বিদআত

আমাদের সমাজে ‘শবে বরাত’ নামক রাতটি খুব জমজমাট ভাবে উদযাপন করা হয়। আর এ উপলক্ষে সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে ছড়িয়ে আছে অনেক অজ্ঞতা, অনেক বিদআত ও শরিয়ত বিরোধী বিষয়। নিম্নে এমন কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরা হল:

১) কথিত শবে বরাত উপলক্ষে একশত রাকআত নামাজ আদায় করা:

এ রাতে এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে একশত রাকআত নামাজ আদায় করা হয়। পদ্ধতিটি হল নিম্নরূপ:
মোট একশত রাকআত নামাজ পড়তে হয়। প্রতি দু রাকাত পর সালাম ফিরাতে হবে। প্রতি রাকআতে সূরা ফাতিহার পর দশ বার সূরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। একশত রাকআত নামাজে সূরা ইখলাস পাঠ করতে হয় মোট এক হাজার বার। তাই এ নামাজকে ‘সলাতে আলফিয়া’ বলা হয়। [ইমাম গজালি রহ. এ পদ্ধতিটি এহিয়া উলুমুদ্দীন কিতাবে উল্লেখ করেছেন। দেখুন: ১ম খণ্ড ২০৩ পৃষ্ঠা]

কথিত শবে বরাতে একশত রাকআত নামাজ পড়ার বিধান:
ইসলামে এ ধরণের নামাজ পড়ার নিয়ম সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কৃত বিদআত। এ ব্যাপারে সর্ব যুগের সমস্ত আলেমগণ একমত। কারণ, তা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খুলাফায়ে রাশেদিন কখনো তা পড়েননি। তাছাড়া ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, আহমদ বিন হাম্বল, সুফিয়ান সাওরি, আওযাঈ, লাইস প্রমুখ যুগ শ্রেষ্ঠ ইমামগণ কেউ এ ধরণের বিশেষ নামাজ পড়ার কথা বলেননি। এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসটি হাদিস বিশেষজ্ঞদের মতে বানোয়াট এবং জাল। যেমন: ইবনুল জাওযী উক্ত হাদিসটি মাওযু’আত (জাল হাদিস সংগ্রহ) কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, "এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিকাংশরেই পরিচয় অজ্ঞাত। আরও কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দুর্বল। সুতরাং হাদিসটি নিশ্চিতভাবে জাল।" [আল মাউযূআত ২য় খণ্ড ১২৭-১৩০ পৃষ্ঠা]

এ নামাজ কে কখন কীভাবে চালু করল?
ইমাম তরতূশী রহ. বলেন, শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে একশত রাকআত নামাজ পড়ার পদ্ধতি সর্ব প্রথম যে ব্যক্তি চালু করে তার নাম হল ইবনে আবুল হামরা। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের অধিবাসী। তিনি ৪৪৮ হিজরি সনে বায়তুল মাকদিসে আসেন। তার তেলাওয়াত ছিল খুব সুন্দর। তিনি শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে মসজিদুল আকসায় এসে নামাজ শুরু করে। আর এক লোক তার পেছনে অনুসরণ করে। অতঃপর আর একজন আসে। কিছুক্ষণ পর আরে আরও একজন। এভাবে নামাজ শেষে দেখা গেল বিরাট জামাআতে পরিণত হয়েছে।
পরিবর্তী বছর শবে বরাতে সে ব্যক্তির সাথে প্রচুর পরিমাণ মানুষ নামাজে শরীক হয়। এভাবে এ নামাজটি মসজিদে আকসা সহ বিভিন্ন মসজিদে পড়া আরম্ভ হয়ে গেল। কিছু মানুষ নিজেদের বাড়িতে এ নামাজ পড়া শুরু করে দিল। পরিশেষে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যেন এটি একটি সুন্নত। [আত্‌ ত্বারতুশী রচিত আত্‌তাহযীর মিনাল বিদা। পৃষ্ঠা: ১২১ ও ১২২]

২) এ রাতে কুরআন অবতীর্ণ হওয়া এবং এ রাতেই মানুষের আগামী বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ার ধারণা:
কুরআন কোন রাতে অবতীর্ণ হয়? শাবান মাসের শবে বরাতে নাকি রমজান মাসের শবে কদরে? আল্লাহ তাআলা বলেন,


إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ * فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

“আমি এটি (আল কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। কেননা আমি মানুষকে সতর্ক কারী। এ রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞা পূর্ণ বিষয় স্থির করা হয়।” [সূরা দুখান: ৩-৪]

এ ‘বরকতময় রাত‘ দ্বারা কোন রাত উদ্দেশ্য?
উক্ত আয়াতে উল্লেখিত রাত দ্বারা কোন রাত বুঝানো হয়েছে? শবে কদর না শবে বরাত?
● অধিকাংশ তাফসির বিশারদগণ বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল শবে কদর যা রমজান মাসে রয়েছে। যারা বলেন, শবে বরাত তাদের কথা ঠিক নয়। নিম্নে এ ব্যাপারে পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হল:
● তাফসিরে ইবনে কাসির রহ. বলেন, "উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ মর্মে সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি এ কুরআনকে এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছেন। আর সেটি হল কদরের রাত। যেমন: মহান আল্লাহ বলেন,


إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْر

“আমি তো তা (কুরআন) কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা ক্বদর: ১] আর এ রাতটি ছিল রমজান মাসে। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,


شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ

“রমজান মাস। যে মাসে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা বাকারা. ১৮৫]

এ প্রসঙ্গে হাদিসগুলো সূরা বাকারায় উল্লেখ করেছি যা পুনরুল্লেখ করার নিষ্প্রয়োজন মনে করছি। আর যারা বলে যে, উক্ত রাতটি হল অর্ধ শাবানের রাত-যেমন ইকরিমা বর্ণনা করেছেন-তাদের এ মত অনেক দূরবর্তী। কারণ, তা কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য বিরোধী। [তাফসিরে ইবনে কাসির, ৪র্থ খণ্ড ৫৭০ পৃষ্ঠা]

● ইকরিমা রহ. উক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন, “এ রাত হল অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতেই সারা বছরের সকল ফয়সালা চূড়ান্ত করা হয়…।” [আল জামিউল কুরতুবী ১৬/১২৬।]
কিন্তু এ দাবী মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তা সরাসরি কুরআন বিরোধী। আর এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো সহিহ তো নই বরং সেগুলো ভিত্তিহীন। যেমনটি ইবনুল আরবি প্রমুখ গবেষক আলেমগণ দৃঢ়তার সাথে করেছেন। সেই সাথে সেগুলো কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক (যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে)।
সুতরাং অবাক হতে হয় সে সকল মুসলমানদের অবস্থা দেখে যারা কুরআন ও সহীহ হাদিসের দলিল ছাড়া কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধিতা করে। [আযওয়াউল বায়ান ৭/৩১৯]

৩) হালুয়া-রুটি খাওয়া:
শবে বরাত উপলক্ষে ঘরে ঘরে হালুয়া-রুটি খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। শুধু তাই নয় বরং সে দিন গরিব মানুষও টাকা হাওলত করে হলেও এক বেলা গোস্ত কিনে খায়। কারণ, সে দিন যদি ভালো খাবার খাওয়া যায় তাহলে নাকি সারা বছর ভালো খাবার খাওয়া যাবে। আর হালুয়া-রুটি খাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদ যুদ্ধে দাঁত ভাঙ্গার পর শক্ত খাবার খেতে পারেন নি। তাই তাঁর প্রতি সমবেদনা জানানোর উদ্দেশ্যে এ দিন ঘটা করে হালুয়া রুটি খাওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? আমরা জানি ওহুদের এক রক্তক্ষয়ী ও অসম যুদ্ধে কাফেরদের আঘাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁত ভেঙ্গে গিয়ে ছিল। কিন্তু শাবান মাসে তো ওহুদ যুদ্ধ হয়নি। বরং তা হয়েছিল ৩য় হিজরি শাওয়াল মাসের সাত তারিখে। তাহলে এ সমবেদনা শাবান মাসের পনের তারিখে টেনে আনার অর্থ কী?

২য় কথা হল, তিনি নরম খাবার কি শুধু একদিন খেয়ে ছিলেন? তাহলে এ কেমন ভালবাসা? আপনি শাবান মাসের পনের তারিখে কিছু হালুয়া-রুটি খেলেন আবার কিছুক্ষণ পর গরুর গোস্ত তো ঠিকই চাবিয়ে চাবিয়ে ভক্ষণ করতে থাকেন?

৩য়ত: রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো কাফেরদের সাথে এক কঠিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বীরে মত যুদ্ধ করে তার পবিত্র দাঁত হারিয়েছেন কিন্তু আমাদের এসব নবী ভক্তদের (!) অধিকাংশের অবস্থা হল, এরা আল্লাহর নবীর রেখে যাওয়া সাধারণ সুন্নতগুলোও ঠিকমত পালন করে না! অনেকে তো ফরজ নামাজই ঠিকমত আদায় করে না। এটাই হল এদের তথাকথিত ভালবাসার নমুনা!

৪) ছবি ও মূর্তি তৈরি:
শবে বরাত উপলক্ষে দেখা যায় নানা রং-বেরঙ্গের ছবি ও মূর্তি তৈরি কৃত মিষ্টান্নতে বাজার ছেয়ে যায়। অথচ ছবি ও মূর্তি-প্রকৃতি ইত্যাদি তৈরি করা ইসলামে হারাম। আবার আল্লাহর দেয়া রিজিক নিয়ে এভাবে খেল-তামাশা?!

৫) মিলাদ ও জিকির:
শবে বরাত উপলক্ষে মসজিদ, খানকা ও দরগায় সমূহে শুরু হয় মিলাদ মাহফিল। চলে মিষ্টি খওয়ার ধুম। চলতে থাকে বিদআতি পন্থায় গরম জিকিরের মজলিশ। এ সব কাজ দ্বীনের মধ্যে বিদআত ছাড়া কিছু নয়।

৬) কবর জিয়ারত:
এক শ্রেণির মানুষ এ রাতে গোরস্থান বা মাযার জিয়ারতে বের হয়। এমনকি কোথাও কোথাও এ প্রথাও দেখা যায় যে, একদল মানুষ এ রাতে ধারাবাহিকভাবে এলাকার সকল কবর যিয়ারত করে থাকে। এদের দলিল হল, শাবান মাসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাকি গোরস্থান যিয়ারতের হাদিস অথচ মুহাদ্দিসগণ উক্ত হাদিসটি জঈফ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।

নিম্নে কবর জিয়ারতের হাদিসটি এবং এ সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের বক্তব্য তুলে ধরা হল:
আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। এক রাতে আমি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে (আমার ঘরে) পেলাম না। তাই তাকে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে তাকে বাকি গোরস্থানে পেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, “তুমি কি এ আশংকা কর যে, আল্লাহ এবং তার রসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন?” আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল, আমি ধারণা করে ছিলাম যে, আপনি হয়ত আপনার অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। একথা শুনে তিনি বললেন, “আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে নিচের আসমানে নেমে আসেন এবং কালব গোত্রের ছাগল সমূহের লোম সমপরিমাণ মানুষকে ক্ষমা করে দেন।” - তিরমিযী। অনুচ্ছেদ: অর্ধ শাবানের ব্যাপারে যা এসেছে।

তবে তিনি নিজেই এর পরে উল্লেখ করেছেন, মুহাম্মদ অর্থাৎ ইমাম বুখারী রহ. কে বলতে শুনেছি তিনি এ হাদিসটিকে জঈফ বলেছেন। ইমাম দারাকুতনী (রাহ.) বলেন, এ হাদিসটি একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তবে সনদগুলো মুযতারাব এবং সু প্রমাণিত নয়। বর্তমান শতকের শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ আল্লামা আলবানী রাহ: ও এ হাদিসটিকে জঈফ বলে সাব্যস্ত করেছেন। দেখুন: সহীহ ওয়া জঈফ তিরমিযী, হাদিস নং ৭৩৯, মাকতাবা শামেলা

৭) আলোক সজ্জা:
শবে বরাত উপলক্ষে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মসজিদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি আলোকসজ্জা করা হয়। মূলত: এসব কাজ একদিকে লক্ষ লক্ষ টাকা শুধু অপচয় করা হয় না তেমনি এটা অগ্নি পূজকদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

৮) মৃতদের আত্মার দুনিয়ায় পুনরাগমনের বিশ্বাস:
এ উপলক্ষে দেখা যায়, মহিলাগণ ঘর-বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে আতর সুগন্ধি লাগিয়ে পরিপাটি করে রাখে। বিশেষ করে বিধবা মহিলাগণ এমনটি করেন। এমনকি তারা কিছু খাবার একটুকরো কাপড়ে পুরে ঘরে ঝুলিয়ে রাখে। কারণ তাদের বিশ্বাস হল, তাদের মৃত স্বামী-স্বজনদের আত্মা এ রাতে ছাড়া পেয়ে নিজ নিজ পরিবারের সাথে দেখা করতে আসে। এটা যে কত বড় মূর্খতা তা একমাত্র আল্লাহ জানেন। মানুষ মারা গেলে তাদের আত্মা বছরের কোন একটি সময় আবার দুনিয়াতে ফিরে আসা মুসলিমদের আকিদা নয়। বরং অনেকটা তা হিন্দুয়ানী বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আমাদের জন্য প্রয়োজন সকল প্রমাণ হীন অনুষ্ঠানাদী বর্জন করা এবং সঠিক দ্বীনের দিকে ফিরে আসা। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল বিদআত ও গোমরাহি থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

[আল বিদা আল হাওলিয়া গ্রন্থ থেকে মুল তথ্যগুলো সংগৃহীত]