ইবনু তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ এবং ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর মূলনীতিই হল আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি। তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, প্রতিপালক এবং মালিক। আল্লাহ্র রাজ্যে বিদ্যমান সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত; এমনকি মানুষের কর্মের স্রষ্টাও স্বয়ং আল্লাহ।
তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহ যা চান, তা হয় এবং যা তিনি চান না, তা হয় না। আল্লাহ্র রাজ্যের কোন কিছুই তাঁর ইচ্ছা এবং শক্তি ছাড়া ঘটে না। তিনি চেয়েছেন অথচ ঘটেনি এমনটি হতে পারে না। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
তাদের বিশ্বাস মতে, যা কিছু হয়েছে এবং হবে, সবই আল্লাহ জানেন। আর যা হয়নি, তা যদি হত, তাহলে কিভাবে হত, তাও তিনি জানেন। তিনি তার সৃষ্টিকে সৃষ্টি করার আগেই তাদের তাক্বদীর নির্ধারণ করে রেখেছেন।[1]
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত বিশ্বাস করে, আল্লাহ সবকিছুই জানেন। সবকিছুই তিনি লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন। সবকিছুতে তাঁর পূর্ণ ইচ্ছা বিদ্যমান এবং এই চিরন্তন জ্ঞান, লিখন ও ইচ্ছা অনুযায়ীই তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেন। অতএব, তাঁদের আক্বীদা মতে, বিদ্যমান প্রত্যেকটি ব্যক্তি বা বস্তুতে নিম্নোক্ত চারটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটেছেঃ
১- আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে সেগুলি সম্পর্কে সম্যক অবগত।
২- আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে তিনি সেগুলিকে লাউহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।
৩- আল্লাহ চেয়েছেন যে, সেগুলি হোক।
৪- আল্লাহ্র শক্তি, ইচ্ছা এবং সৃষ্টির মাধ্যমেই সেগুলি হয়েছে।
বান্দাকর্তৃক যা কিছু ঘটে, তার কোনটাই আল্লাহ্র ইচ্ছার বাইরে ঘটে না। তবে একথার দ্বারা তারা এটা বুঝাতে চান না যে, মানুষ ইচ্ছাশক্তিহীন জড় পদার্থ। বরং সে তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি দিয়েই স্বাধীনভাবে কাজ করে যায়। তবে তার ইচ্ছা আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীনে। এক গায়েবী পরিস্থিতির সামনে বান্দার অবস্থান, সে জানে না আল্লাহ তার জন্য কি নির্ধারণ করে রেখেছেন। সে ব্যর্থ হবে নাকি সফল হবে। কোন কিছুর চেষ্টা সত্ত্বেও সে তা পাবে কি পাবে না। কেননা মানুষের প্রচেষ্টা এবং প্রচেষ্টার ফল দেওয়া না দেওয়া উভয়ই আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন। ভাগ্যের লিখন জানে না বলেই একজন মুমিন নিরলস ইবাদত-বন্দেগী করে যায়।
সেজন্য আপনি মুমিন বান্দাকে দেখবেন যে, সে তার আশা পূরণের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার আশা পূরণ হলে সে আল্লাহ্র প্রশংসা করে, আর না হলে ধৈর্য্যধারণ করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিদানের প্রত্যাশী হয়। সাথে সাথে সে দৃঢ় বিশ্বাস করে, ‘তাক্বদীরে যদি লেখা থাকে, সে সঠিক কিছু করবে, তাহলে তা কখনই ভুল হতে পারে না। পক্ষান্তরে তাক্বদীরে যদি লেখা থাকে, সে ভুল করবে, তাহলে তা কখনই সঠিক হতে পারে না’।
অনুরূপভাবে সে মনে করে না যে, তাকে কোন কাজে বাধ্য করা হয়েছে; বরং সে বারংবার বলতে থাকে, (مَا شَاءَ اللهُ كَانَ, وَمَا لَمْ يَشَأْ لَمْ يَكُنْ) ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন, তা হয়েছে; তিনি যা চাননি, তা হয়নি’। সে আরো বলে, (قَدَرُ اللهُِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ) ‘এটিই হচ্ছে আল্লাহ্র তাক্বদীর এবং তিনি যা চেয়েছেন, তা-ই হয়েছে’।
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের বিশ্বাস মতে, মানুষের কর্মকে তাদের নিজেদের দিকে সম্বন্ধিত করতে হবে। তবে তার মানে এই নয় যে, তারা নিজেরাই ঐসব কর্ম সৃষ্টি করেছে। বরং আল্লাহই সেগুলির একক স্রষ্টা। মানুষ সেগুলির সংঘটক বা বাস্তবায়নকারী মাত্র। মোদ্দাকথাঃ মানুষের কর্মের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা হিসাবে সেগুলি আল্লাহ্র দিকে সম্বন্ধিত করা হয়। আর মানুষ সেগুলির বাস্তবায়নকারী হিসাবে সেগুলি মানুষের দিকে সম্বন্ধিত করা হয়। আল্লাহ মানুষকে সেগুলি করার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এবং দৈহিক শক্তি প্রদান করেছেন। সেজন্যই মানুষের কৃতকর্ম তাদের দিকেই সম্বন্ধিত করা হয় এবং ভাল কাজ করলে তারা প্রশংসিত হয় আর মন্দ কাজ করলে হয় নিন্দিত।
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের এই মধ্যমপন্থী আক্বীদা কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহ্র নির্যাস। তারা ক্বাদারিইয়া-জাবরিইয়াদের মত শুধুমাত্র এক পক্ষের দলীল গ্রহণ করেনি; বরং তাক্বদীর সংক্রান্ত সবগুলি দলীলের শক্ত ভিত্তির উপর তাদের আক্বীদা সুপ্রতিষ্ঠিত। অতএব, যা আল্লাহ্র কামালিয়াত বা পরিপূর্ণতার সাথে খাপ খায়, তা তাঁর দিকে সম্বন্ধিত করতে হবে। পক্ষান্তরে যা বান্দার অবস্থার সাথে খাপ খায়, তা তার দিকে সম্বন্ধিত করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿لِمَن شَاءَ مِنكُمْ أَن يَسْتَقِيمَ وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾ [سورة التكوير: 28-29]
‘(কুরআন ঐব্যক্তির জন্য উপদেশ) তোমাদের মধ্যে যে সোজা চলতে চায়। তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছার বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পার না (তাকভীর ২৮-২৯)। উক্ত আয়াতে কারীমা স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, বান্দার নিজস্ব স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি রয়েছে, যা তার সাথে খাপ খায়। তবে আল্লাহ্র শক্তি হচ্ছে পরিপূর্ণ। আয়াতটি আরো প্রমাণ করে, বান্দার ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীনে। কেননা তিনি সবকিছুর স্রষ্টা।
অনুরূপভাবে রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম)কে প্রেরণ, আসমানী কিতাবসমূহ অবতীর্ণ, শরঈ হদ্দ বা দণ্ডবিধির প্রণয়ন প্রমাণ করে যে, বান্দার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। কারণ সে যদি ইচ্ছাশক্তিহীন জড়পদার্থের মত হত, তবে এসব কোন কিছুরই প্রয়োজন পড়ত না।[2]
[2]. আল-ই‘তিক্বাদুল ওয়াজিব নাহ্ওয়াল ক্বাদার/১৬-১৯।