ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
তাক্বদীরঃ আল্লাহ্‌র এক গোপন রহস্য তাক্বদীর বিষয়ে বিস্তারিত আব্দুল আলীম ইবনে কাওসার
জাবরিইয়াদের কতিপয় দলীল এবং তার জবাব

নীচে জাবরিইয়াদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দলীল এবং তার জবাব পেশ করা হল:

১. ‘আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা’ একথার প্রমাণ সম্বলিত আয়াতসমূহঃ যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

 ﴿قُلِ اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ﴾ [سورة الرعد: 16]

‘বলুন, আল্লাহই প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা এবং তিনি একক, পরাক্রমশালী’ (রা‘দ ১৬)। এ জাতীয় আয়াত প্রমাণ করে যে, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা, তিনি ব্যতীত আর কোন সৃষ্টিকারী নেই। আর বান্দার কর্ম যেহেতু আয়াতে উল্লেখিত ‘সবকিছু’-এর বাইরে নয়, সেহেতু সেটিও এককভাবে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। অতএব, বান্দার কর্মে তার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি কোনটিই নেই; বরং সে জড়পদার্থের মত এবং বাধ্যগত জীব।[1]

জবাবঃ আমরাও তোমাদের সাথে একমত যে, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা এবং এ জাতীয় আয়াতের বক্তব্যও ঠিক তাই। কিন্তু এসব আয়াতের কোথায় বলা হয়েছে যে, বান্দার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি কোনটিই নেই?‍! কোথায় বলা হয়েছে, বান্দার কর্ম আল্লাহ্‌র সৃষ্ট হলেও সে নিজে তার বাস্তবায়ন করে না?!

‘বান্দা তার কর্মের প্রকৃত বাস্তবায়নকারী নয়’ এমর্মে জাবরিইয়াহরা একটি দলীলও সাব্যস্ত করতে পারবে না। তারা সর্বোচ্চ যেটি প্রমাণ করতে পারবে, তা হল এই যে, আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা। কিন্তু এ চিরন্তন সত্য কথা তো আমরাও বিশ্বাস করি।[2]

২. আল্লাহ্‌র ইচ্ছা প্রমাণকারী আয়াতসমূহ এবং ‘বান্দার ইচ্ছা আল্লাহ্‌র ইচ্ছার অধীনে’ এমর্মে অবতীর্ণ আয়াতসমূহঃ যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ﴾ [سورة القصص: 68]

‘আপনার পালনকর্তা যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং পছন্দ করেন’ (ক্বাছাছ ৬৮)।  অন্যত্র তিনি বলেন,

 ﴿وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾ [سورة التكوير: 29]

‘তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অভিপ্রায়ের বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পারবে না’ (তাকভীর ২৯)। তিনি আরো বলেন,

 ﴿كَذَٰلِكَ يُضِلُّ اللَّهُ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ﴾ [سورة المدثر: 31]

‘এমনিভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথপ্রদর্শন করেন’ (মুদ্দাছ্‌ছির ৩১)। অতএব মানুষ যেহেতু ইচ্ছা শক্তিহীন জীব এবং আল্লাহই যেহেতু তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী কাউকে পথ দেখান আবার কাউকে পথভ্রষ্ট করেন, সেহেতু আল্লাহই বান্দার আমলের স্রষ্টা এবং বান্দা বাধ্যগত জীব; তার কোন ইচ্ছাশক্তি নেই, নেই কোন কর্মশক্তি।

জবাবঃ ক্বাদারিইয়াদের প্রথম দলীলের জবাব দ্রষ্টব্য।

৩. যেসব আয়াত প্রমাণ করে, আল্লাহই হেদায়াত দান করেন এবং পথভ্রষ্ট করেন আর তাঁর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত হয়ে গেছে যে, তিনি মানব এবং জিন জাতি দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবেন। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَلَوْ شِئْنَا لَآتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَٰكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّي لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ﴾ [سورة السجدة: 13]

‘আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেককে সঠিক পথ প্রদর্শন করতাম; কিন্তু আমার পক্ষ থেকে অবধারিত হয়ে গেছে যে, আমি জিন ও মানব জাতিকে দিয়ে অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব’ (সাজদাহ ১৩)। যদি পথ প্রদর্শনের বিষয়টি আল্লাহ্‌র হাতেই থাকে এবং মানব ও জিন জাতিকে দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করার বিষয়টি যদি চূড়ান্ত হয়েই থাকে, তবে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি কোত্থেকে আসল?[3]

অনুরূপভাবে আল্লাহ বলেন,

﴿فَمَن يُرِدِ اللَّهُ أَن يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ ۖ وَمَن يُرِدْ أَن يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ﴾ [سورة الأنعام: 125]

‘অতঃপর আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্যে উম্মুক্ত করে দেন এবং যাকে বিপথগামী করতে চান, তার বক্ষকে অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন, যেন সে সবেগে আকাশে আরোহণ করে’ (আন‘আম ১২৫)। অতএব আল্লাহই হেদায়াত করতে চান অথবা বিপথগামী করতে চান। তাহলে মানুষের ইচ্ছাশক্তি কোথায়?[4]

জবাবঃ প্রথম আয়াতের অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন যে, কে সৌভাগ্যবান হবে আর কে দুর্ভাগা হবে। অতএব উক্ত আয়াত প্রমাণ করে না যে, ভাল-মন্দ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ মানুষকে বাধ্য করেন।[5]

দ্বিতীয় আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ যাকে হেদায়াত করতে চান, তিনি তার হৃদয়কে ইসলামের জন্য সহজ এবং প্রশস্ত করে দেন। ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, তাওহীদ এবং ঈমান গ্রহণের ক্ষেত্রে আল্লাহ তার হৃদয়কে প্রশস্ত করে দেন।[6] পক্ষান্তরে যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করতে চান, তার হৃদয়কে তিনি সংকীর্ণ করে দেন। ফলে আল্লাহকে চেনা এবং তাঁকে ভালবাসার ক্ষেত্রে তার হৃদয়টি হয়ে যায় খুবই সংকীর্ণ।[7]  কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তার উপর যুলম করা হয়েছে। বরং তাকে এই শাস্তি দিয়ে আল্লাহ ইনছাফেরই পরিচয় দিয়েছেন। কেননা পথভ্রষ্ট এই ব্যক্তিটির মধ্যে আল্লাহ ঈমান গ্রহণের সার্বিক ক্ষমতা প্রদান করা সত্ত্বেও সে ঈমান গ্রহণ করেনি। বরং সে আল্লাহ্‌র রুবূবিইয়াত বা প্রতিপালনকে অস্বীকার করেছে, তাঁর নে‘মতসমূহের শুকরিয়া সে আদায় করেনি এবং আল্লাহ্‌র দাসত্বের উপরে সে শয়তানের দাসত্বকে প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে আল্লাহ তার হেদায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং তার বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার পথ খুলে দিয়েছেন।[8]

অতএব এ আয়াতও কোনভাবেই বাধ্যবাধকতা প্রমাণ করে না। বরং এর সরল অর্থ হল, যে ব্যক্তি ঈমান আনে না, আল্লাহ তার হৃদয়কে সংকীর্ণ করে দেন।[9]

৪. যেসব আয়াত প্রমাণ করে যে, আল্লাহ বান্দার অন্তরে মোহর মেরে দেন। ফলে সেখানে আর ঈমান প্রবেশ করতে পারে না। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

﴿خَتَمَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَعَلَىٰ سَمْعِهِمْ﴾ [سورة البقرة: 7]

‘আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহে মোহর মেরে দিয়েছেন’ (বাক্বারাহ ৭)। তিনি আরো বলেন,

﴿بَلْ طَبَعَ اللَّهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُونَ إِلَّا قَلِيلًا﴾ [سورة النساء: 155]

‘কুফরীর কারণে স্বয়ং আল্লাহ তাদের অন্তরের উপর মোহর এঁটে দিয়েছেন। ফলে তারা অতি অল্পসংখ্যক ব্যতীত কেউ ঈমান আনে না’ (নিসা ১৫৫)। অতএব স্বয়ং আল্লাহই যেহেতু বান্দার অন্তরে মোহর মেরে দেন, সেহেতু তারা বাধ্যগত জীব, তাদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি বলতে কিছু নেই।[10]

জবাবঃ এসব আয়াতের অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ বান্দা ও বান্দার ঈমান গ্রহণের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করেন, অতঃপর তাকে ঈমান আনার নির্দেশ দান করেন। বরং এসব আয়াতের মর্মার্থ হল, হক্ব জানার পরেও যেহেতু তারা তাত্থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সেহেতু তাদের এই কুফরীর শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাদের এবং তাদের ঈমান কবূলের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আল্লাহ বারংবার তাদেরকে সত্যের পথে আহ্বান করেছেন, তাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন; কিন্তু তারাও বারংবার আল্লাহ্‌র আহ্বানের বিরোধিতা করেছে। তাহলে কেন তিনি তাদেরকে শাস্তি দিবেন না? অতএব, এসব আয়াত কখনই জাবরিইয়াদের পক্ষের দলীল হতে পারে না।[11]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ্‌র এই শাস্তি কখনও ঐ বান্দার সারা জীবনের জন্য হতে পারে। ফলে সে আর কখনও ঈমান আনার সুযোগ পায় না। আবার কখনও অস্থায়ীভাবে হতে পারে। ফলে পরবর্তীতে সে ঈমান আনার সুযোগ পায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ কখনও কুফরীর কুফলস্বরূপ বান্দাকে অন্যান্য শাস্তিও দিতে পারেন।[12]

৫. যেসব আয়াত বান্দা কর্তৃক কর্ম সম্পাদন সাব্যস্ত করে না; বরং আল্লাহ কর্তৃক কর্ম সম্পাদন সাব্যস্ত করে। যেমনঃ আল্লাহ বলেন,

﴿وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ رَمَىٰ﴾ [سورة الأنفال: 17]

‘আর যখন তুমি মাটির মুষ্টি নিক্ষেপ করেছিলে, তখন তা মূলতঃ তুমি নিক্ষেপ করনি, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ’ (আনফাল ১৭)। এখানে আল্লাহ বললেন যে, তার নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাটির মুষ্টি নিক্ষেপ করেননি; বরং স্বয়ং তিনিই নিক্ষেপ করেছিলেন। অতএব, মানুষের কোন কর্মশক্তি নেই।[13]

জবাবঃ আয়াতটি বদর যুদ্ধ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়। এ যুদ্ধে আল্লাহ তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী দ্বারা মুসলিমদেরকে সাহায্য করেছিলেন। ফলে যুদ্ধে কাফেরদেরকে হত্যার ক্ষেত্রে মুসলিম বাহিনীর একক ভূমিকা ছিল না; বরং ফেরেশতামণ্ডলীর মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সরাসরি মদদ ছিল।[14]

দ্বিতীয়তঃ এ যুদ্ধে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক মুষ্টি মাটি কাফেরদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেছিলেন। এমন একজন কাফেরও ছিল না, যার দু’চোখ, মুখ এবং নাকের ছিদ্রে ঐ এক মুষ্টি মাটির অংশ আঘাত করেনি। আর সে কারণেই তারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়েছিল।[15] তাইতো মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর যখন তুমি মাটির মুষ্টি নিক্ষেপ করেছিলে, তখন তা মূলতঃ তুমি নিক্ষেপ করনি, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ’। এখানে আল্লাহ নিক্ষেপ ক্রিয়াটি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য সাব্যস্ত করলেন। কিন্তু নিক্ষিপ্ত মাটি সবার চোখে-মুখে পৌঁছানোর বিষয়টি নিজের জন্য সাব্যস্ত করলেন। কারণ কাফেরদের দূরত্বে অবস্থান সত্ত্বেও স্বভাবতঃ এক মুষ্টি মাটি এতগুলি কাফেরের চোখে-মুখে এবং নাকের ছিদ্রে পৌঁছানো কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।[16]

৬. জাবরিইয়ারা বলে, আল্লাহ তাঁর চিরন্তর জ্ঞান এবং ইচ্ছার মাধ্যমে বান্দার কর্ম সৃষ্টি করেছেন এবং বান্দার কর্ম বিদ্যমান থাকার সাথে আল্লাহ্‌র শক্তি জড়িত। বান্দার যেকোনো কর্ম আল্লাহ্‌র তাক্বদীর অনুযায়ীই হয়। অতএব, বান্দার নিজস্ব কোন ইচ্ছাশক্তি নেই; বরং তারা বাধ্যগত জীব।[17]

জবাবঃ বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্‌র চিরন্তর জ্ঞান এবং ইচ্ছা জড়িত থাকলেও তা তাদেরকে তাদের কর্মে বাধ্য করে না। কারণ আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে বান্দার কর্ম সম্পর্কে জানেন এবং তিনি আরো জানেন যে, স্বেচ্ছায় কে কোন্‌টা বেছে নিবে। আর এই চিরন্তর জ্ঞান অনুপাতে তিনি তাদের কর্মও লিখে রেখেছেন। শায়খ ছালেহ আলুশ্‌-শায়খ[18] বলেন, আল্লাহ তাঁর চিরন্তর জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন যে, জাহান্নামবাসীরা স্বেচ্ছায় জাহান্নামে প্রবেশের উপযুক্ত আমল করবে। আর সে কারণেই তিনি তাদেরকে জাহান্নামবাসীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করেছেন।[19] অর্থাৎ তিনি জানেন যে, স্বেচ্ছায় কে সৎআমল করবে এবং কে অসৎ আমল করবে। আর তিনি তাঁর এই চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ীই এক দলকে জান্নাতবাসী এবং আরেক দলকে জাহান্নামবাসীর তালিকায় লিখে রেখেছেন। তিনি লিখে রেখেছেন বলেই যে তারা করতে বাধ্য তা নয়; বরং তারা স্বেচ্ছায় করবে জেনেই তিনি লিখে রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আল্লাহ দু’জন ব্যক্তির তাক্বদীর লেখার আগেই জানতেন যে, উভয়কে একজন দ্বীনদার আলেম সৎআমল করার এবং অসৎ কাজ থেকে বেঁচে থাকার নছীহত করবেন। কিন্তু তাদের একজন স্বেচ্ছায় উক্ত আলেমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সৎকাজ করবে। পক্ষান্তরে অপরজন কস্মিনকালেও তার ডাকে সাড়ে দিবে না; বরং স্বেচ্ছায় পাপ কাজে সে ডুবেই থাকবে। আর সেকারণেই তিনি প্রথম জনের জন্য জান্নাত এবং অপর জনের জন্য জাহান্নাম লিখে রেখেছেন। ফলে তাদের কর্ম আল্লাহ্‌র চিরন্তন জ্ঞান এবং তাক্বদীরের সাথে হুবহু মিলে গেছে।[20]

তাহলে এখানে বান্দার ইচ্ছাশক্তি না থাকার কি রইল? অনুরূপভাবে বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্‌র শক্তি বিদ্যমান থাকলেও তা প্রমাণ করে না যে, বান্দার কর্ম তাদের নিজস্ব কর্মশক্তির মাধ্যমে সংঘটিত হয় না এবং তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মের বাস্তবায়নকারী নয়।[21]

একদা এক ক্বাদারী এবং এক জাবরীর মধ্যে ভীষণ ঝগড়া হয়। ক্বাদারী বলে, বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। পক্ষান্তরে জাবরী এর বিপরীত মত প্রকাশ করে এবং বলে, বান্দা তার কর্মে বাধ্য, তার নিজস্ব কোন ইচ্ছাশক্তি নেই। এরপর তারা একজন যোগ্য সুন্নী আলেমের কাছে বিচার নিয়ে আসে।

সুন্নী বললেন, তোমরা যার যে বক্তব্য পেশ কর। আমি সূক্ষ্মভাবে তোমাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দিব। তোমাদের যার সাথে যতটুকু বাতিল রয়েছে, তা পরিত্যাগ করব এবং যতটুকু হক্ব রয়েছে, তা সাব্যস্ত করব।

ক্বাদারী বলল, আমি বলতে চাই, মহান আল্লাহ নিতান্তই ন্যায়পরায়ণ, তিনি কারো প্রতি যুলম করেন না। সুতরাং এর আলোকে আমি বান্দা কর্তৃক ঘটিত পাপকাজ আল্লাহ থেকে মুক্ত রাখতে চাই। আমি বলতে চাই, এতে আল্লাহ্‌র কোন ইচ্ছা নেই। বরং বান্দাই স্বতন্ত্রভাবে তা করে।

যেসব আয়াত এবং হাদীছ প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি তিল পরিমাণও যুলম করেন না, সেগুলি আমার মতের পক্ষের দলীল। উল্লেখ্য যে, বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার সংশ্লিষ্টতা থাকা অবস্থায় যদি আল্লাহ তাকে শাস্তি দেন, তাহলে তাতে দুই দিক দিয়ে যুলম প্রমাণিত হয়:

১. বান্দার কর্ম আল্লাহ্‌র ইচ্ছার দিকে সম্বন্ধিত করলে তাতে যুলম সাব্যস্ত হয়।

২. আল্লাহ যেটা চেয়েছেন এবং সৃষ্টি করেছেন, তার কারণে কিভাবে তিনি বান্দাকে শাস্তি দিতে পারেন?!

এরপর যদি আমি বলি, বান্দার কর্ম আল্লাহ্‌র ইচ্ছার অধীনে, তাহলে আদেশ-নিষেধ, শরী‘আত নিরর্থক হয়ে যায়। সুতরাং এমন একটি ধৃষ্টতা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে আমার মতের পক্ষ অবলম্বন এবং এটিই হচ্ছে ন্যায় সঙ্গত পথ।

জাবরী বলল, আমি বলতে চাই, আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং তিনি সবকিছুর স্রষ্টা। তিনি যা চান, তা হয়। আর যা তিনি চান না, তা হয় না। আর যেহেতু সবকিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু বান্দার কর্মও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে পরিগণিত হবে।

আমরা যদি বলি, বান্দার কর্ম আল্লাহ সৃষ্টি করেননি বা তাতে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা নেই, তবে এর অর্থ হল, আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান নন এবং নন তিনি সবকিছুর স্রষ্টাও।

এর অর্থ হচ্ছে, বান্দা বাধ্যগত জীব, তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি বলতে কিছু নেই। কেননা বান্দাই যদি প্রকৃতপক্ষে তার কর্মের ইচ্ছা করত এবং বাস্তবায়ন করত, তাহলে তা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এবং সৃষ্টি বহির্ভূত গণ্য হত।

যেসব আয়াত এবং হাদীছ আল্লাহ্‌র ইচ্ছা, সৃষ্টি এবং শক্তি প্রমাণ করে, তার সবগুলিই আমার পক্ষের দলীল।

এবার বিচারক সুন্নী বললেন, তোমাদের দু’জনই তার মতামত ব্যক্ত করেছ এবং মতামতের পক্ষে দলীল পেশ করেছ। কিন্তু সমস্যা হল, তোমাদের কেউ সর্বমুখী দলীলের প্রতি লক্ষ্য করনি; বরং একদিক গ্রহণ করেছ এবং অপরদিক বর্জন করেছ। মনে রেখ, এমন ট্যারা দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই প্রচুর ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে। এখন আমি তোমাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দিচ্ছি:

হে ক্বাদারী! তোমার কিছু ভাল দিক রয়েছে। কারণ তুমি বলেছ, বান্দার ভাল-মন্দ কর্ম সে নিজেই করে থাকে। তোমার দলীলও ঠিক আছে। কারণ তুমি বলেছ, সেগুলি আল্লাহ বান্দার দিকে সম্বন্ধিত করেছে। তোমার আরেকটি ভাল দিক হচ্ছে: তুমি বলেছ, জাবরিইয়াহ মতবাদ ঠিক হলে শরী‘আত অনর্থক হয়ে যেত।

তবে তোমার মারাত্মক ভুলের দিকটি হল এই যে, তুমি বলেছ, বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। এর মাধ্যমে তুমি বান্দার কর্মের সাথে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণকারী সকল দলীল অস্বীকার করেছ। মনে রেখ, প্রকৃত মুমিন সে-ই, যে বিশ্বাস করে আল্লাহই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও বান্দার কর্ম সে নিজেই বাস্তবায়ন করে।

হে জাবরী! তোমার ভাল দিক হচ্ছে, তুমি বলেছ, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনিই সবকিছুর প্রতি ক্ষমতাবান। তুমি আরো বলেছ, আল্লাহ যা চান, তা হয়। আর যা তিনি চান না, তা হয় না। তোমার পেশকৃত দলীলও সঠিক।

কিন্তু তোমার মস্ত বড় ভুল হচ্ছে, তুমি মনে করেছ, সবকিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন একথার অর্থ হল, বান্দা তার কাজ-কর্মে বাধ্য, সেগুলি তার ইচ্ছায় বাস্তবায়িত হয় না।

এরপর সুন্নী আলেম বললেন, তোমরা দু’জনই একটু করে হক্ব বললেও তার সাথে বাতিলের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছ। এখন এসো, আমরা দলীলের আলোকে তোমাদের ভাল-মন্দ উভয় দিক আবার একটু বিশ্লেষণ করে দেখি:

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿لِمَن شَاءَ مِنكُمْ أَن يَسْتَقِيمَ وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾ [سورة التكوير: 28-29]

‘(কুরআন ঐব্যক্তির জন্য উপদেশ) তোমাদের মধ্যে যে সোজা চলতে চায়। আর তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছার বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পার না (তাকভীর ২৮-২৯)। উক্ত আয়াতদ্বয় তোমাদের উভয়ের মধ্যে যথার্থ ফায়ছালা করে দিয়েছে। কেননা আয়াত দু’টি প্রমাণ করেছে যে, বান্দার ইচ্ছাশক্তি রয়েছে এবং এর মাধ্যমেই সে হয় সরল পথ বেছে নেয়, না হয় বক্রপথ। আয়াতদ্বয় এটাও প্রমাণ করেছে যে, বান্দার এই ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্‌র ইচ্ছার বাইরে নয়, বরং তাঁর ইচ্ছার অধীনে।

কুরআন-হাদীছের বক্তব্য যেমন একথা প্রমাণ করে, তেমনি সুষ্ঠু বিবেক এবং বাস্তবতাও একথার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। কেননা আল্লাহ যেমন বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তার ইচ্ছা ও কর্মশক্তি এবং নানা বৈশিষ্ট্যের স্রষ্টাও তিনি। বিবেকবান সবাই একথা স্বীকার করবে। তোমরা দু’জন কি একথা স্বীকার কর না?!

তারা দু’জনই বলল, হ্যাঁ।

সুন্নী বললেন, আল্লাহ বান্দাকে যেসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তন্মধ্যে বান্দার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তি অন্যতম। আর এতদুভয়ের মাধ্যমেই সে ভাল-মন্দ সবকিছু করে থাকে। অতএব বান্দার ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মশক্তির স্রষ্টাই তার কর্মেরও স্রষ্টা। অতএব সবকিছুই আল্লাহ্‌র সাধারণ সৃষ্টির মধ্যে গণ্য।

যদি তোমরা এই সঠিক এবং বাস্তব কথার সাথে একমত হও, তবে আমাদের মধ্যে আর দ্বন্দ্ব থাকে না। এক্ষণে তোমরা উভয়ে পরস্পরের বাতিল দিকটি পরিত্যাগ কর এবং একে অপরের ভাল দিকটি গ্রহণ কর।

‘বান্দা বাধ্যগত জীব’ এই ভ্রান্ত মতবাদ থেকে জাবরী ফিরে আসুক এবং ‘বান্দা নিজ ইচ্ছা প্রয়োগে তার কর্ম সম্পাদন করে’ এই সঠিক মতবাদ সে গ্রহণ করুক। পক্ষান্তরে ‘বান্দার কর্ম আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ও সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত নয়’ এই ভ্রান্ত মতবাদ থেকে ক্বাদারী ফিরে আসুক এবং ‘সবকিছুই আল্লাহ্‌র সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত’ এই সঠিক মতবাদ সে গ্রহণ করুক। সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আমরা আল্লাহ্‌র প্রশংসা করছি।[22]

[1]. আল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/৩২৮।

[2]. শিফাউল আলীল/১১২।

[3]. আল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/৩২৯।

[4]. প্রাগুক্ত, পৃ: ৩২৯-৩৩০।

[5]. প্রাগুক্ত, পৃ: ৩৪৮।

[6]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৩/৩৩৪।

[7]. আল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/৩৪৮।

[8]. শিফাউল আলীল/২২৬।

[9]. আল-ক্বাযা ওয়া ক্বাদার/৩৪৯।

[10]. প্রাগুক্ত, পৃ: ৩৩০-৩৩১।

[11]. শিফাউল আলীল/২২৬; আল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/৩৪৯।

[12]. শিফাউল আলীল/১৯৪।

[13]. জামে‘ শুরূহিল আক্বীদাতিত্‌ ত্বহাবিইয়াহ, ২/১১০৭।

[14]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৪/৩০।

[15]. প্রাগুক্ত, ৪/৩০।

[16]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৮/১৮; শিফাউল আলীল/১২৯।

[17]. ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে হুসাইন, আর-রদ্দু আলাল মুজবিরাতিল-ক্বাদারিইয়াহ, তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ আম্মারাহ, (কায়রো: দারুশ শুরূক্ব, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৮৮ ইং), পৃ: ৩৪ এবং এর পরবর্তী কয়েক পৃষ্ঠা।

[18]. ছালেহ ইবনে আব্দুল আযীয আলুশ্‌-শায়খ ১৩৭৮ হিজরীতে রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন। এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারে তিনি বেড়ে উঠেন। তাঁর দাদা শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম সঊদী আরবের এক সময়কার গ্র্যান্ড মুফতী ছিলেন। রিয়াযেই তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ইমাম মুহাম্মাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উছূলুদ্দীন’ অনুষদ থেকে লেখাপড়া শেষ করেন এবং ঐ একই অনুষদে ১৪১৬ হিজরীতে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। ১৪১৬ হিজরীতে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং ১৪২০ হিজরীতে মন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হন; অধ্যাবধি তিনি এই মহান দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছেন। ‘আত-তাকমীলু লিমা ফা-তা তাখরীজুহু মিন ইরওয়াইল গালীল’, ‘মাওসূ‘আতুল কুতুবিস সিত্তাহ’, ‘আত-তামহীদ ফী শারহি কিতাবিত-তাওহীদ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ (জামে‘ শুরূহিল আক্বীদাতিত্‌ ত্বহাবিইয়াহ-এর ভূমিকা, ১/২০-২২)।

[19]. জামে‘ শুরূহিল আক্বীদাতিত্‌ ত্বহাবিইয়াহ ২/৫২৭।

[20]. নাবীল হামদী, হালিল ইনসান মুসাইয়্যার আও মুখাইয়্যার? (দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৯১ইং), পৃ: ৪৩-৪৪, ৪৭, ১০১; কাশফুল গায়ূম আনিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/৩২।

[21]. ড. ফুয়াদ আক্বলী, আল-ইনসান: হাল হুয়া মুসাইয়্যার আম মুখাইয়্যার?, (কায়রো: মাকতাবাতুল খানজী, প্রথম প্রকাশ: ১৯৮০ইং), পৃ:১৪।

[22]. আল্লামা আব্দুর রহমান ইবনে নাছের সাদী, আদ-দুররাতুল বাহিইয়াহ শারহুল ক্বাছীদাতিত তায়িইয়াহ ফী হাল্লিল মুশকিলাতিল ক্বাদারিইয়াহ/৮৯-৯১, (রিয়ায: আযওয়াউস সালাফ, প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৮ ইং)।