মথির ইঞ্জিলের লেখক দাবি করেছেন যে, কুমারী মাতার গর্ভে তাঁর জন্মের বিষয়টা পুরাতন নিয়মের ভবিষ্যদ্বাণী বলে দাবি করেছেন তিনি। কুমারী মাতার গর্ভে জন্মের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন: ‘‘এই সব হয়েছিল, যেন নবীর মধ্য দিয়ে প্রভু এই যে কথা বলেছিলেন, তা পূর্ণ হয়: ‘একজন কুমারী মেয়ে গর্ভবর্তী হবে, আর তাঁর একটা ছেলে হবে; তার নাম রাখা হবে ইম্মানূয়েল’।’’ (মথি ১/২২-২৩)
কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬: ‘‘এই সব হয়েছিল, যেন নবীর মধ্য দিয়ে মাবুদ এই যে কথা বলেছিলেন, তা পূর্ণ হয়: ‘একজন অবিবাহিতা সতী মেয়ে গর্ভবর্তী হবে, আর তাঁর একটা ছেলে হবে; তার নাম রাখা হবে ইম্মানূয়েল’।’’
জুবিলী বাইবেল: ‘‘দেখ, কুমারীটি গর্ভবতী হয়ে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করবে আর লোকে তাঁকে ইম্মানুয়েল বলে ডাকবে।’’
উপরের তিন অনুবাদ মথির দাবি প্রমাণ করে। তবে অন্যান্য বাংলা অনুবাদ মথির দাবি প্রমাণ করে না। কেরি: ‘‘এই সকল ঘটিল, যেন ভাববাদী দ্বারা কথিত প্রভুর এই বাক্য পূর্ণ হয়, ‘দেখ, সেই কন্যা গর্ভবতী হইবে, এবং পুত্র প্রসব করিবে, আর তাঁহার নাম রাখা যাইবে ইম্মানুয়েল...।’’
কি. মো.-২০১৩: ‘‘এ সব ঘটলো, যেন নবীর মধ্য দিয়ে প্রভুর এই যে কালাম নাজেল হয়েছিল, তা পূর্ণ হয়, ‘দেখ সেই কন্যা গর্ভবতী হবে এবং পুত্র প্রসব করবে, আর তার নাম ইম্মানূয়েল রাখা হবে।’’
Anchorপাক-কিতাবের অনুবাদে এরূপ বৈপরীত্যের কারণ পর্যালোচনার আগে আমরা নবীর মাধ্যমে পাওয়া কালামটা অনুধাবন করি। সকলেই একমত যে, এখানে ‘নবী’ বলতে যিশাইয়/ ইশাইয়াকে বুঝানো হয়েছে। যিশাইয়/ ইশাইয়া ৭/১৪ নিম্নরূপ:
(১) কেরি: ‘‘অতএব প্রভু আপনি তোমাদিগকে এক চিহ্ন দিবেন; দেখ, এক কন্যা গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবে, ও তাঁহার নাম ইম্মানুয়েল রাখিবে।’’
(২) বাইবেল-২০০০: ‘‘কাজেই প্রভু নিজেই তোমাদের কাছে একটা চিহ্ন দেখাবেন। তা হল, একজন কুমারী মেয়ে গর্ভবতী হবে.....।’’
(৩) জুবিলী বাইবেল: ‘‘প্রভু নিজেই তোমাদের একটা চিহ্ন দেবেন। দেখ, যুবতীটি গর্ভবতী হয়ে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করবে, তাঁর নাম রাখবে ইম্মানুয়েল।’’
(৪) কি. মো.-২০০৬: ‘‘কাজেই দ্বীন-দুনিয়ার মালিক নিজেই তোমাদের কাছে একটা চিহ্ন দেখাবেন। তা হল, একজন অবিবাহিতা সতী মেয়ে গর্ভবতী হবে...।’’
(৫) কি. মো-১৩: ‘‘অতএব প্রভু নিজে তোমাদেরকে একটি চিহ্ন দেবেন; দেখ, এক জন কুমারী কন্যা গর্ভবতী হয়ে পুত্র প্রসব করবে ও তাঁর নাম ইম্মানূয়েল রাখবে।’’
এখানেও আমরা অনুবাদের বৈপরীত্য দেখছি। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম অনুবাদে কুমারী মায়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রথম ও তৃতীয় অনুবাদে যুবতী মেয়ের কথা বলা হয়েছে; ফলে এ বক্তব্য দ্বারা কুমারী মায়ের কথা প্রমাণ করা যায় না।
প্রশ্ন হল, অনুবাদে এত হেরফের কেন? পাঠক নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(ক) যিশাইয়র পুস্তকে কোনো কুমারী মাতার কথা বলা হয়নি; বরং যুবতী মাতার কথা বলা হয়েছে। যিশাইয়র বক্তব্য দিয়ে কুমারী মাতার ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করা যায় না। যিশাইয় ব্যবহৃত মূল হিব্রু শব্দ ‘আলামাহ’। শব্দটা ‘আলাম’ শব্দের স্ত্রী লিঙ্গ। ইহুদি পণ্ডিতদের নিকট এর অর্থ হল ‘‘যুবতী মেয়ে, সে কুমারী হোক অথবা কুমারী না হোক।’’ তারা বলেন, এ শব্দটা হিতোপদেশ-এর ৩০ অধ্যায়ে ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে শব্দটা ‘বিবাহিত যুবতী নারী’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
(খ) বাইবেলের কোনো কোনো গ্রিক অনুবাদে ‘আলামাহ’ শব্দটাকে ‘কুমারী’ অর্থে অনুবাদ করা হয়েছে। সম্ভবত মথির লেখক এ ধরনের কোনো অনুবাদের উপর নির্ভর করেছিলেন। তবে লক্ষণীয় যে, বাইবেলের প্রাচীন তিনটা গ্রিক অনুবাদ নিম্নরূপ: (১) আকুইলা (Aquila of Pontus)-এর অনুবাদ, (২) থিওডোশান (Theodotian of Ephesus)-এর অনুবাদ এবং (৩) সীমাকাস (Symmachus)-এর অনুবাদ। বাইবেল গবেষকদের মতে এগুলো প্রাচীনতম গ্রিক অনুবাদ। তারা দাবি করেন যে, প্রথমটা ১৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, দ্বিতীয়টা ১৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এবং তৃতীয়টা ২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সম্পন্ন হয়। ইউসিবিয়াস (৩৪০ খ্রি.) তাঁর ÔThe Ecclesiastical History’ গ্রন্থে এ তিনজনের কথা উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা ১৮৯, ২৩৬)। এ তিনটা অনুবাদেই যিশাইয়র বাক্যে ব্যবহৃত ‘আলামাহ’ শব্দটার অনুবাদ করা হয়েছে ‘যুবতী কন্যা’। এতে প্রমাণ হয় যে, মথির ইঞ্জিলটা দ্বিতীয় শতকের পরে রচিত অথবা মথির লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে ‘আলামাহ’ শব্দটাকে ভুল অর্থে ব্যবহার করেছেন।
বর্তমানে বাইবেলের অধিকাংশ সংস্করণেই এ বিকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। অধিকাংশ সংস্করণে যিশাইয় ৭/১৪-এর অনুবাদে যুবতী (young woman) এবং মথি ১/২৩-এর অনুবাদে ‘কুমারী (virgin) লেখা হচ্ছে। এতে সুস্পষ্টতই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মথি যিশাইয়র বক্তব্যটা বিকৃত করেছেন। বর্তমানে প্রচলিত যে সকল সংস্করণে যিশাইয় ৭/১৪ শ্লোকে যুবতী (young woman) এবং মথি ১/২৩ শ্লোকে কুমারী (virgin) লেখা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: Common English Bible (CEB), Complete Jewish Bible (CJB), Good News Translation (GNT) Bible, New American Bible (Revised Edition) (NABRE), New English Translation (NET) NET Bible, New Life Version (NLV) Bible, Revised Standard Version (RSV) Bible, Revised Standard Version Bible, Catholic Edition (RSVCE), New Revised Standard Version (NRSV) Bible, New Revised Standard Version Bible, Anglicised (NRSVA), New Revised Standard Version Bible, Anglicised Catholic Edition (NRSVACE), New Revised Standard Version Bible Catholic Edition (NRSVCE) ইত্যাদি। পাঠক ইন্টারনেটে biblegateway.com ওয়েবসাইটে যিশাইয় ৭/১৪ ও মথি ১/২২-২৩ অনুসন্ধান করলেই তা জানতে পারবেন।[1]
বাংলায় কেরি বাইবেলে উভয় স্থানেই কুমারী বাদ দিয়ে ‘কন্যা’ লেখা হয়েছে। জুবিলী বাইবেলে যিশাইয় ১/১৪ ‘যুবতী’ এবং মথি ১/২৩ ‘কুমারী’ লেখা হয়েছে। পবিত্র বাইবেল (২০০০) উভয় স্থানে ‘কুমারী’ লেখেছে। কিতাবুল মোকাদ্দস উভয় স্থানে ‘অবিবাহিত সতী মেয়ে’, অর্থাৎ ‘কুমারী’ লেখেছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হল কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩। আমরা উপরে দেখলাম যে, এ সংস্করণে মথি ১/২৩-এ কন্যা এবং যিশাইয় ১/১৪ কুমারী কন্যা লেখা হয়েছে। জুবিলী বাইবেলের অনুবাদে মথির বিকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। কিতাবুল মোকাদ্দস-২০১৩ বিকৃতি প্রকাশ করেছে উল্টাভাবে।
(গ) কখনো কেউ যীশুর নাম ‘ইম্মানুয়েল’ রাখেননি। তাঁর পিতাও না, মাতাও না। বরং তাঁরা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘যীশু’। ফেরেশতা যীশুর পিতাকে স্বপ্নে বলেন, ‘তুমি তাঁহার নাম ঈসা (ইয়াসূ, যিহোশূয়, ইউসা, যিশাইয় বা যীশু: নাজাতদাতা) রাখবে’ (মথি ১/২১)। জিবরাইল যীশুর মাতাকে বলেন: ‘‘তাঁর নাম ঈসা রাখবে’’ (লূক ১/৩১)। যীশু নিজেও বলেননি যে, তাঁর নাম ‘ইম্মানুয়েল’।
(ঘ) যিশাইয়ের পুস্তকে যে কাহিনীর মধ্যে এ কথাটা বলা হয়েছে, সে কাহিনীর প্রেক্ষাপটে দেখলে নিশ্চিত বুঝা যায় যে, এ কথাটা কখনোই যীশু খ্রিষ্টের আগমনের ইঙ্গিত বা ভবিষ্যৎ-বাণী হতে পারে না। কাহিনীটা নিম্নরূপ:
যিহূদা-রাজ আহসের সময়ে অরাম-রাজ রৎসীন ও ইসরাইল-রাজ পেকহ যিহূদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে একত্রিত হন। এ সংবাদে যিহূদা-রাজ আহস অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন। তখন ঈশ্বরের নির্দেশে যিশাইয় আহসকে আশ্বাস প্রদান করে বলেন, আপনি ভয় পাবেন না। তারা আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। শীঘ্রই তাদের রাজত্ব বিনষ্ট হবে। তাদের দু’ রাজ্য বিনষ্ট হওয়ার চিহ্ন হিসেবে যিশাইয় আহসকে জানান যে, একজন যুবতী নারী গর্ভবতী হবেন এবং পুত্র প্রসব করবেন। সে পুত্রটা ভালমন্দ জ্ঞান লাভ করার পূর্বেই এ দু’ রাজার রাজ্য বিনষ্ট হবে। (বিস্তারিত দেখুন: যিশাইয় ৭/১-২৫)
চিহ্ন প্রসঙ্গে যিশাইয়র (৭/১৪-১৬) বক্তব্য: ‘‘অতএব প্রভু আপনি তোমাদিগকে এক চিহ্ন দিবেন; দেখ, এক কন্যা গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবে, ও তাঁহার নাম ইম্মানুয়েল রাখিবে। যাহা মন্দ তাহা অগ্রাহ্য করিবার এবং যাহা ভাল তাহা মনোনীত করিবার জ্ঞান পাইবার সময়ে বালকটি দধি ও মধু খাইবে। বাস্তবিক যাহা মন্দ তাহা অগ্রাহ্য করিবার ও যাহা ভাল তাহা মনোনীত করিবার জ্ঞান বালকটির না হইতে, যে দেশের দুই রাজাকে তুমি ঘৃণা করিতেছ, সে দেশ পরিত্যক্ত হইবে।’’
পরবর্তী ঘটনা থেকে জানা যায় যে, এ সংবাদ প্রদানের ২১ বছরের মধ্যে পেকহ-এর রাজ্য ইসরাইল বিনষ্ট হয়[2]। কাজেই নিঃসন্দেহে এ সময়ের কিছু পূর্বে ‘ইম্মানুয়েল’ নামক এ পুত্রটা জন্মলাভ করেছিল এবং তার ভালমন্দ জ্ঞান লাভের পূর্বেই রাজ্যটা ধ্বংস হয়েছিল। আর যীশু জন্ম গ্রহণ করেন ইসরাইল-রাজ্য বিনষ্ট হওয়ার প্রায় সাড়ে সাত শত বছর পরে।
যিশাইয়র এ চিহ্নের ব্যাখ্যায় অনেকে বলেন, এখানে যিশাইয় ‘যুবতী নারী’ বলতে নিজের স্ত্রীকে বুঝাচ্ছেন। তিনি বলছেন যে, তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী হবেন এবং একটা পুত্র প্রসব করবেন। এ পুত্রটা বড় হয়ে ভালমন্দ জ্ঞান লাভ করার আগেই এ দু’ রাজ্য বিনষ্ট হবে। এ চিহ্নটার সাথে যীশুর প্রসঙ্গ কোনোরূপেই সম্পৃক্ত করা যায় না। এ শিশুর বিবরণও কোনোভাবে যীশুর সাথে মেলে না। এ বক্তব্যে জন্মগ্রহণ কোনো চিহ্ন নয়, শিশুটার বয়স হওয়ার আগেই রাজ্যদ্বয়ের বিনষ্ট হওয়াই চিহ্ন। বাইবেলের বক্তব্য অনুসারে এটা রাজা আহসের জীবদ্দশায় ঘটবে, কখনোই তার পরে ঘটবে না।
[2] খৃ. পূ. ৭৩০ বা ৭২৫ অব্দে অ্যাসিরিয়ানদের হাতে রৎসীন-এর অরাম রাজ্য বা সিরিয়া বিনষ্ট হয়। আর খ্রি. পূ. ৭২২ অব্দে অ্যাসিরিয়ানদের হাতে ইস্রায়েল রাজ্য বা সামারিয়া বিধ্বংস হয়। মতিওর রহমান, ঐতিহাসিক অভিধান, পৃ. ৭-৮।