আমরা বলেছি যে, নতুন নিয়মের লেখকরা পুরাতন নিয়মের অনেক বক্তব্য যীশুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা মাঝে মাঝে বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছেন। এরূপ বিকৃতি রয়েছে ‘ইব্রীয়’ বা ইবরানী পুস্তকে। লেখক দাবি করেছেন যে, যীশু তাঁর দেহ বলিদানের মাধ্যমে তৌরাত ও মোশির শরীয়ত রহিত করেছেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি তার পুস্তকের ১০/৫-৭ শ্লোকে গীতসংহিতা/ জবুরের ৪০/৬-৮ শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু উদ্ধৃতির মধ্যে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে গীতসংহিতার বক্তব্যকে যীশুর বক্তব্য বলে চালানো হয়েছে।
মূল গীতে দাউদ বলেছেন: ‘‘(৫) হে মাবুদ, আমার আল্লাহ (O LORD my God) ... (৬) কোরবানী ও নৈবেদ্য তুমি চাও না।[1] তুমি আমার উন্মুক্ত কর্ণ দিয়েছ (তোমার কথা শোনার কান তুমি আমাকে দিয়েছ: প. বা.: ২০০০)। তুমি পোড়ানো কোরবানী ও গোনাহর জন্য কোরবানী চাওনি (burnt offering and sin offering hast thou not required); (৭) তখন আমি বললাম, দেখ, আমি এসেছি; যেমন পাক-কিতাবে আমার বিষয় লেখা আছে। (৮) হে আমার আল্লাহ, তোমার অভীষ্ট সাধনে আমি প্রীত: তোমার ইচ্ছানুসারে কর্ম করতে আমি আনন্দিত (I delight to do thy will), আর তোমার শরীয়ত আমার অন্তরে আছে।’’ (গীতসংহিতা ৪০/৫-৮, মো.-১৩)
ইবরানীর লেখক এ কথাগুলোকে যীশুর দেহ উৎসর্গের মাধ্যমে মূসা (আ.)-এর শরীয়ত বা তৌরাত রহিত করার প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। তিনি বলেন:
‘‘এই কারণ মসীহ দুনিয়াতে আসবার সময়ে বলেন, ‘তুমি কোরবানী ও নৈবেদ্য চাওনি, কিন্তু আমার জন্য একটি দেহ প্রস্তুত করেছ (but a body hast thou prepared me); পোড়ানো কোরবানী ও গুনাহ-কোরবানীতে তুমি প্রীত হওনি (thou hast had no pleasure)। তখন আমি বললাম, দেখ, আমি এসেছি, পাক-কিতাবে আমার বিষয় লেখা আছে- হে আল্লাহ, যেন তোমার ইচ্ছা পালন করি (to do thy will, O God)।’ উপরে তিনি বলেন, ‘কোরবানী, নৈবেদ্য, পোড়ানো-কোরবানী ও গুনাহ-কোরবানী তুমি চাওনি এবং তাতে প্রীতও হওনি- এসব শরীয়ত অনুসারে কোরবানী করা হয়-। তারপর তিনি বললেন, ‘দেখ, তোমার ইচ্ছা পালন করার জন্য এসেছি।’ তিনি প্রথম বিষয় লোপ করছেন, যেন দ্বিতীয় বিষয় স্থির করেন। সেই ইচছাক্রমে, ঈসা মসীহের দেহ একবার কোরবানী করার মধ্য দিয়ে আমাদের পবিত্র করা হয়েছে।’’ (ইবরানী/ ইব্রীয় ১০/৫-১০, মো.-১৩)
যে কোনো পাঠক জবুর শরীফ বা গীতসংহিতার গীতটা এবং ইবরানী পুস্তকের উদ্ধৃতি পাঠ করলে অবাক বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে পড়বেন যে, কিভাবে মূল পাঠ ও তার অর্থ পরিবর্তন করা হয়েছে। পাঠক সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
প্রথমত: দাউদ (আ.)-এর বক্তব্যকে সাধু পল সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এবং অযৌক্তিকভাবে ‘যীশুর জগতে প্রবেশের সময়ের বক্তব্য’ বলে চালিয়েছেন। অথচ পুরো গীতটার মধ্যে এ বিষয়ে দূরবর্তী কোনো ইঙ্গিতও নেই।
পলের রচনাবলি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি যীশুর অলৌকিক জন্ম সম্পর্কে জানতেন না। তিনি যীশুকে দাউদের বংশধর ইউসুফের ঔরসজাত পুত্র বলে গণ্য করতেন এবং দাউদের অনেক বিষয়কে যীশুর উপর আরোপ করতেন। অথচ যীশুর অলৌকিক জন্ম নিশ্চিত করে যে, যোষেফের সাথে বা দাউদের সাথে যীশুর কোনোরূপ রক্তসম্পর্ক নেই। যীশুর মাতাও দাউদের বংশধর ছিলেন না। সবচেয়ে বড় কথা ধর্মগ্রন্থের পাঠের মধ্যে কোনোরূপ ইঙ্গিত ব্যতিরেকে এভাবে পূর্বপুরুষের বক্তব্যকে উত্তর পুরুষের কারো ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যুক্তি, বিবেক, জ্ঞান ও ধর্ম বিরোধী।
দ্বিতীয়ত: দাউদ গীতে বলেছেন: ‘‘কোরবানী ও নৈবেদ্য তুমি চাও না। ... তুমি পোড়ানো কোরবানী ও গোনাহর জন্য কোরবানী চাওনি...।’’ ইবরানী পুস্তকের লেখক সাধু পল বা অজ্ঞাত-পরিচয় ব্যক্তি বক্তব্যটা পরিবর্তন করে ‘প্রীত নও’ করেছেন। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ঈশ্বর শরীয়ত পালনে খুশী নন।
এখানেও শব্দের ও অর্থের বিকৃতি দেখা যায়। মহান আল্লাহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বারবার বলেছেন যে, মহান আল্লাহ আনুষ্ঠানিকতা চান না; বরং ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আত্মশুদ্ধি ও সততা সৃষ্টিই সৃষ্টিকর্তার মূল চাওয়া। কুরআনে আল্লাহ কুরবানি প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘‘এগুলোর মাংস বা রক্ত আল্লাহর নিকট পৌছায় না; কিন্তু তোমাদের তাকওয়া বা আল্লাহর প্রতি গভীর ভক্তি (devotion)-ই তাঁর নিকট পৌঁছে।’’ (সূরা-২২ হজ্জ: ৩৭ আয়াত) বাইবেলের ভাষায়: ‘‘আমি বিশ্বস্ততা চাই, পশু-কোরবানী নয়: পোড়ানো-কোরবানীর চেয়ে আমি চাই যেন মানুষ সত্যিকারভাবে আল্লাহ্কে চেনে।’’ (হোশেয় ৬/৬। মথি ৯/১৩ ও ১২/৭, মো.-১৩)
আমরা দেখছি যে, এ সকল বক্তব্যে শরীয়ত পালনকে রহিত বা লুপ্ত করা হয়নি; বরং শরীয়ত পালনের সময় অনুষ্ঠানসর্বস্বতা বাদ দিয়ে সততা ও আল্লাহ-ভক্তির প্রতি লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে ইব্রীয় পুস্তক দাবি করছে, যেহেতু হোম, নৈবেদ্য, কুরবানি ইত্যাদি শরীয়তের নির্দেশে পালন করা হয় এবং আল্লাহ এতে প্রীত নন; সেহেতু এ কথা দ্বারা শরীয়ত লোপ বা রহিত করা হয়েছে। কোনো চিকিৎসক যদি বলেন, খাদ্য চিবানো কোনো জরুরি বিষয় নয়; জরুরি হল পুষ্টি ও সুস্থতা অর্জন, আর চিকিৎসকের কথা থেকে যদি কেউ বুঝেন যে, এখন থেকে খাদ্য গ্রহণ লাগবে না; খাদ্য ছাড়াই পুষ্টি ও সুস্থতা অর্জিত হবে- তবে সে ব্যক্তিকে আপনি কী বলবেন?
তৃতীয়ত: ইব্রীয় পুস্তকের লেখক- পল বা অজ্ঞাত- মূল বক্তব্যের একটা বাক্য বাদ দিয়ে সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বাক্য সংযোজন করেছেন। মূল গীতে বলা হয়েছে: ‘‘তুমি আমার উন্মুক্ত কর্ণ দিয়েছ/ তোমার কথা শোনার কান তুমি আমাকে দিয়েছ। কিন্তু সাধু পল বলেছেন: ‘‘কিন্তু আমার জন্য দেহ রচনা করিয়াছ’’। একে পাঠক কি বলবেন? ‘পরিবর্তন’, ‘জালিয়াতি’ না ‘প্রতারণা’? বাহ্যত ‘যীশুর দেহ কোরবানীর মাধ্যমে পবিত্র হওয়ার’ তত্ত্ব প্রমাণের জন্য লেখক এরূপ করেছেন।
চতুর্থত: মূল গীতে বলা হয়েছে: ‘‘হে আমার আল্লাহ, তোমার অভীষ্ট সাধনে আমি প্রীত।’’ মূল ইংরেজি: I delight to do thy will। এর সুস্পষ্ট অর্থ: তোমার ইচ্ছানুসারে কর্ম করতে আমি আনন্দিত। ‘‘আর তোমার শরীয়ত আমার অন্তরে আছে।’’ সাধু পল কথাটা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে বলেছেন: ‘‘হে আল্লাহ, যেন তোমার ইচ্ছা পালন করি (to do thy will, O God)।’’
গীতের অর্থ সুস্পষ্ট। গীতিকার বলেছেন যে, হে আমার ঈশ্বর, তোমার তৌরাত ও শরীয়ত আমার অন্তরের মধ্যে রয়েছে, তোমার ইচ্ছানুসারে শরীয়ত পালন করে আমি আনন্দ লাভ করি। আর সাধু পল পুরো বক্তব্য পরিবর্তন করে বলেছেন যে, ‘‘আমি আসিয়াছি... হে ঈশ্বর যেন তোমার ইচ্ছা পালন করি (to do thy will, O God)।’’ বিয়োজন, পরিবর্তন ও সংযোজনের মাধ্যমে মূল অর্থ পরিবর্তন করে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, যীশু এসেছিলেন ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ করে নিজেকে বলি দেওয়ার জন্য।
বড় অবাক বিষয়! সাধু পল বা অজ্ঞাত পরিচয় এ লেখকই উল্লেখ করলেন যে, ঈশ্বর বলি, কোরবানী, উৎসর্গ ইত্যাদিতে প্রীত হন না। আবার তিনিই দাবি করছেন যে, যীশু ঈশ্বরের ইচ্ছায় নিজের দেহ উৎসর্গ করতে এসেছিলেন!
সাধু পল অন্যত্র বলেছেন: ‘‘রক্তসেচন (রক্তপাত) না হইলে পাপমোচন হয় না।’’ (ইব্রীয়: ৯/২২) পুনশ্চ: (রোমীয় ৪/২৫, ৫/১২, ১৪, ১০/৯; গালাতীয় ৩/১০-১৩; ইফিষীয় ১/৭; করিন্থীয় ১৫/২১-২২)। তাহলে কি ঈশ্বর পাপীদের তাওবা, ভক্তি ও অনুশোচনামূলক উৎসর্গে খুশি হন না। তবে নিষ্পাপকে ধরে বলি দিলে খুশি হন!! পাপীরা যখন পাপের কারণে অনুতপ্ত হয়ে নিজের অর্থ দিয়ে পশু ক্রয় করে তা কুরবানি করে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করেন তখন ঈশ্বর খুশি হন না। তবে নিষ্পাপ একজন মানুষকে জোর করে ধরে শুলে চড়িয়ে রক্তপাত করলে ঈশ্বর খুশি হন! বৈধ পশুর রক্তপাতে পাপমোচন হয় না কিন্তু মানুষের রক্তসেচনে পাপমোচন হয়!
পঞ্চমত: মূল গীতসংহিতায় এ গীতটা পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, এখানে পুরাতন ও নতুন কোনো বিষয় নেই। বিষয় একটাই। মহান আল্লাহর প্রশংসা করা, তিনি বান্দার কষ্ট চান না, বরং সততা চান। আর শরীয়ত পালনের মাধ্যমে এরূপ সততা অর্জনেই বান্দার আনন্দ ও তৃপ্তি। পক্ষান্তরে পল/ অজ্ঞাত ব্যক্তি বিভিন্নভাবে সংযোজন, বিয়োজন ও পরিবর্তন করে এ বক্তব্যটাকে পুরাতন ও নতুনে ভাগ করে বললেন: তিনি প্রথম বিষয় (মূসা আ.-এর শরীয়ত পালন) লোপ করছেন, যেন দ্বিতীয় বিষয় (ঈশ্বরের ইচ্ছায় নিজের রক্তপাত) স্থির করেন। সেই ইচ্ছাক্রমে, ঈসা মসীহের দেহ একবার কোরবানী করার মধ্য দিয়ে আমাদের পবিত্র করা হয়েছে।
পাঠক, এ ব্যাখ্যাটা কী নামে আখ্যায়িত করবেন তা আপনিই সিদ্ধান্ত নিন।