এ বিষয়ে বাইবেলে সাংঘর্ষিক তথ্য বিদ্যমান। কোথাও বলা হয়েছে, কেউ অন্যের পাপের কারণে শাস্তি পাবে না। পাপের অপরাধ পরের কোনো প্রজন্মই ভোগ করবে না। এর বিপরীতে অন্যান্য স্থানে বলা হয়েছে যে, পিতার অপরাধে পুত্রদের শাস্তি হবে। আবার পুত্রদের শাস্তি কত প্রজন্ম পর্যন্ত হবে সে বিষয়েও বৈপরীত্য বিদ্যমান।
প্রথম অর্থে বলা হয়েছে: ‘‘সন্তানের জন্য পিতার, কিম্বা পিতার জন্য সন্তানের প্রাণদ- করা যাইবে না; প্রতিজন আপন আপন পাপ প্রযুক্তই প্রাণদ- ভোগ করিবে।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪/১৬)। অন্যত্র বলা হয়েছে: ‘‘প্রত্যেক জন আপন আপন অপরাধ প্রযুক্ত মরিবে’’ (যিরমিয় ৩১/৩০)। ‘‘যে প্রাণী পাপ করে সে-ই মরিবে।’’ (যিহিষ্কেল ১৮/৪)। ২ রাজাবলি ১৪/৬ এবং ২ বংশাবলি ২৫/৪ শ্লোকেও একই কথা বলা হয়েছে।
যিহিস্কেল ১৮/১৯-২৩ বলছে: ‘‘(কি. মো.) তবুও তোমরা বলছ, ‘বাবার দোষের জন্য কেন ছেলে শাস্তি পাবে না?’ সেই ছেলে তো ন্যায় ও ঠিক কাজ করেছে এবং আমার সমস্ত নিয়ম কানুন যত্নের সংগে পালন করেছে, তাই সে নিশ্চয়ই বাঁচবে। যে গুনাহ করবে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না। সৎ লোক তার সততার ফল পাবে এবং দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার ফল পাবে। কিন্তু একজন দুষ্ট লোক তার সব গুনাহ থেকে ফিরে আমার সব নিয়ম-কানুন পালন করে আর ন্যায় ও ঠিক কাজ করে তবে সে নিশ্চয়ই বাঁচবে, মরবে না। সে যেসব অন্যায় করেছে তা আমি আর মনে রাখব না। সে যেসব সৎ কাজ করেছে তার জন্যই সে বাঁচবে। দুষ্ট লোকের মরণে কি আমি খুশী হই? বরং সে যখন কুপথ থেকে ফিরে বাঁচে তখনই আমি খুশী হই।’’
কিন্তু বাইবেলেই অন্যত্র বলা হয়েছে যে, পূর্বপুরুষদের পাপের কারণে তিন বা চার পুরুষ পর্যন্ত পুত্ররা পিতার অপরাধের কারণে শাস্তিলাভ করবে। ঈশ্বর বলছেন: ‘‘আমি পিতৃগণের অপরাধের প্রতিফল সন্তানদের উপর বর্তাই, যারা আমাকে অগ্রাহ্য করে তাদের তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত বর্তাই। কিন্তু যারা আমাকে মহববত করে ও আমার সমস্ত হুকুম পালন করে, আমি তাদের হাজার পুরুষ পর্যন্ত অটল মহববত প্রকাশ করি।’’ (হিজরত/ যাত্রাপুস্তক ২০/৫-৬, মো.-১৩)। একই কথা বাইবেলে বার বার বলা হয়েছে। (হিজরত/ যাত্রাপুস্তক ৩৪/৭; শুমারী/গণনাপুস্তক ১৪/১৮; দ্বিতীয় বিবরণ ৫/৯)
উপরের উভয় বিষয়ের বিপরীতে লূক থেকে জানা যায় যে, ৭০/৮০ প্রজন্ম পরের মানুষেরাও পূর্বপুরুষদের পাপের শাস্তিভোগ করবেন। লূক ৩/২৩-৩৮ থেকে জানা যায় যে, আদম থেকে যীশু পর্যন্ত সাতাত্তর পুরুষ। আর যীশু বলেছেন, আদমের পুত্র হাবিলের রক্তের প্রতিশোধও তাঁর প্রজন্মের ইহুদিদের থেকে নেওয়া হবে। তিনি বলেন: ‘‘যেন দুনিয়ার পত্তনের সময় থেকে যত নবীর রক্তপাত হয়েছে, তার প্রতিশোধ এই কালের (this generation এই প্রজন্মের) লোকদের কাছ থেকে নেওয়া যায়- হাবিলের রক্ত থেকে সেই জাকারিয়ার রক্ত পর্যন্ত, যিনি কোরবান-গাহ ও বায়তুল-মোকাদ্দসের (the temple: মন্দিরের, মসজিদে আকসার) মধ্যস্থানে নিহত হয়েছিলেন- হাঁ, আমি তোমাদেরকে বলছি, এই কালের লোকদের কাছ থেকে তার প্রতিশোধ নেওয়া যাবে।’’ (লূক ১১/৫০-৫১, মো.-১৩)
উপরের সকল বৈপরীত্যের বিপরীতে পবিত্র বাইবেলে অন্যত্র বলা হয়েছে যে, পিতার পাপের ফলে হাজার হাজার প্রজন্মের সকল সন্তানই শাস্তিভোগ করবে। সাধু পল বারবার লেখেছেন যে, আদমের পাপের কারণে সকল আদম সন্তানের জন্য মৃত্যু বা শাস্তি অবধারিত হয়ে যায় এবং সকলেই পাপী বলে গণ্য হয়।
পল বলেন: ‘‘একজন মানুষের গুনাহের দরুন মৃত্যু সেই একজনের মধ্য দিয়ে রাজত্ব করতে শুরু করেছিল। ... একটা গুনাহের মধ্য দিয়ে যেমন সব মানুষকেই শাস্তির যোগ্য বলে ধরা হয়েছে, তেমনি একটা ন্যায় কাজের মধ্য দিয়ে সব মানুষকেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে...। যেমন একজন মানুষের অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে অনেককেই গুনাহগার বলে ধরা হয়েছিল, তেমনি একজন মানুষের বাধ্যতার মধ্য দিয়ে অনেককেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে।’’ (রোমীয় ৫/১৭-১৯, মো.-০৬)
অন্যত্র তিনি বলেন: ‘‘কারণ আদমে যেমন সকলে মরে, তেমনি আর খ্রিষ্টেই সকলে জীবন প্রাপ্ত হইবে’’ (১ করিন্থীয় ১৫/২২)
পবিত্র পুস্তকের এ বক্তব্যগুলো পূর্বোক্ত বক্তব্যগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক।
প্রথমত: এ দ্বারা তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত শাস্তি প্রদানের কথা বাতিল বলে প্রমাণিত হল। যেখানে কিয়ামত পর্যন্ত সকল পুরুষের সকলেই পাপী বলে গণ্য হলেন সেখানে তৃতীয় বা চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করা একেবারেই অর্থহীন।
দ্বিতীয়ত: পলের কথা দ্বারা পিতাদের মহববত ও হুকুম পালনের ফলে হাজার হাজার পুরুষ পর্যন্ত দয়ারক্ষার বা অটল মহববত প্রদর্শনের কথাও ভিত্তিহীন বলে জানা যায়। কারণ সকলেই আদম-সন্তান এবং আদমের পাপের সাথে সাথে সকলেই পাপী বলে গণ্য হয়েছে এবং সকলের জন্যই শাস্তি বা মৃত্যু বরাদ্দ হয়ে গিয়েছে। ঈশ্বরকে মহববত করলে বা তাঁর হুকুম পালন করলে কারোই কোনো লাভ হবে না। উক্ত মহববতকারী ও হুকুমপালনকারী নিজেই মুক্তি পাবে না, তার হাজার হাজার উত্তর পুরুষ তো অনেক দূরের কথা! একমাত্র পথ যীশুর আত্মত্যাগে বিশ্বাস করা।
তৃতীয়ত: এখানে আরেকটা বৈপরীত্য লক্ষণীয়। পুরাতন নিয়মের বক্তব্যগুলোতে ঈশ্বরের শাস্তির অনেক কথা বলা হলেও ঈশ্বরের করুণাকে ব্যাপকতর দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে নতুন নিয়মে পলের বক্তব্যে ঠিক বিপরীত চিত্রটা বিদ্যমান। পলের বক্তব্যে ঈশ্বরের শাস্তি সর্ববা্যপী হলেও করুণা সীমিত। আদমের পাপে লক্ষকোটি প্রজন্মের শাস্তি পাওয়ার জন্য কোনো পূর্বশর্ত নেই। কিন্তু যীশুর মাধ্যমে করুণা পেতে পূর্বশর্ত বিদ্যমান: যীশুর আত্মত্যাগে বিশ্বাস। পলের বক্তব্য অনুসারে ঈশ্বর শাস্তিতে মহানুভব হলেও করুণায় কৃপণ! (নাঊযু বিল্লাহ) শাস্তি ফ্রি! কিন্তু মুক্তি শর্তসাপেক্ষ।